X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ সূচকের উন্নয়নে পরিবারের ভূমিকা

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
২০ নভেম্বর ২০২২, ২০:০৪আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২২, ২০:০৪

পরিবার একটি সুপ্রাচীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিবারের সান্নিধ্যে থেকে জীবনযাপন করে। পরিবারে বাস করেই মানুষ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড অংশগ্রহণ করে। নানা সম্পর্কেও আবদ্ধ হয়। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে মানুষের যে দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ আমরা লক্ষ করি, তা নির্মাণে পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা পর্যায়ে কন্যাসন্তানের প্রতি যে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় তা দূরীকরণে পরিবারই প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্যের মূল কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। পারিবারিক শিক্ষা ও কার্যক্রম থেকেই কন্যাসন্তানের প্রতি এমন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। তাই পরিবারের সব সদস্য যদি নারীর প্রতি ইতিবাচক মনোভাবের শিক্ষা পায় তবে সমাজ ও রাষ্ট্রের কোথাও আর কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্য থাকবে না। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা কোনও না কোনও পরিবারের সদস্য। ফলে এ কথা জোরালোভাবেই বলা যায়, কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারকেই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।

এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, শিক্ষামন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নারীরা অবস্থান করলেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে কন্যাসন্তানের প্রতি শতভাগ বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব হয়নি। শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদানসহ নানা বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও শতভাগ কন্যাশিশুকে শিক্ষার সুযোগ প্রদান করা এখনও সম্ভব হয়নি। বিদ্যালয় থেকে ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হারও কম নয়। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২১-এর তথ্যমতে, দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষদের তুলনায় নারী বেশি। পুরুষ ৪৯.৫% আর নারী ৫০ % এবং আনুপাতিক হারে পুরুষ ও নারী ৯৮: ১০০। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীর শতকরা হার ৮১%: ৮৪% এবং অনুপাত ৪৯.৩: ৫০.৮৬।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তরে উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই অনেক ছাত্রীর শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটছে। তারা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। ২০২১ থেকে ২০২২ সালে প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তরে উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীর শতকরা হার ২৫%:২৮%, যেখানে ছাত্রীরা এগিয়ে থাকলেও বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে তাদের হার কম নয়। ওই অনুপাত ৩৪%:৩২%।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা সমানতালে শিক্ষাগ্রহণ করলেও উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে অল্প বয়সে কন্যাসন্তানকে বিবাহ দেওয়ার প্রবণতা এর জন্য প্রধানত দায়ী। পাশাপাশি আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের একাধিক সন্তান থাকলে অনেক অভিভাবকই মেয়েদের শিক্ষার বদলে ছেলেদের শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়। তাই শিক্ষায় কন্যাশিশুর সমান অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পরিবারকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে এসে ছেলে হোক মেয়ে হোক সবার উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতে অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে।

ইসলাম ধর্মের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘যার কন্যাসন্তান হয়, কিন্তু সে তাকে জীবিত কবর দেয় না, লাঞ্ছনা করে না এবং পুত্রসন্তানের ওপর স্থান দেয় না, আল্লাহ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।’ (আবু দাউদ)। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মুসলিম প্রধান এদেশে শিক্ষার পাশাপাশি মৌল-মানবিক চাহিদা অন্নবস্ত্রের ক্ষেত্রেও কন্যাসন্তানদের প্রতি বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। পরিবারের সদস্য হিসেবে পুত্রসন্তানের মতো কন্যাসন্তানেরও পুষ্টিকর ও সুষম খাবার প্রাপ্তির পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে অধিকাংশ পরিবারে সবচেয়ে ভালো খাবারটি পুত্রসন্তানকে প্রদান করা হয়। পুত্রসন্তানের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য অভিভাবকরা যতটুকু উদ্যোগী হন, কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে সেই তৎপরতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় নয়। ওই কারণে এ দেশের প্রায় ৭০ ভাগ মায়েরা আয়রনের অভাব জনিত রক্তশূন্যতায় ভোগে। তাই পরিবারের অভিভাবক হিসেবে পিতামাতার উচিত হবে কন্যাসন্তানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে পুত্রসন্তানের মতো কন্যাসন্তানকেও প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর ও সুষম খাবার প্রদান করা।

কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হলে সুযোগের সমতার পাশাপাশি পরিবারকেও দায়িত্ব নিতে হবে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে ওঠার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক প্রথা ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের দোহাই দিয়ে মেয়েদের কর্মে নিযুক্ত হতে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। মেয়েদের চেয়ে কম মেধা ও দক্ষতাসম্পন্ন পুরুষেরা কর্মে নিয়োগ লাভের সুযোগ পায়। কিন্তু মেয়েদের কর্মে নিযুক্তের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। আর এর জন্য কর্মের সুযোগের অভাবের দায় যতটা না, তারচেয়ে বেশি দায়ী পারিবারিক সংস্কার। তাই এক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণে পরিবারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য কর্মক্ষেত্রে যেন নারীর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে পরিবারকে তার সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নারীর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে পারিবারিক পর্যায়েও নারী ও পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা এবং পারিবারিক বলয়ে সেই বিষয়ের চর্চা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

পরিবারকে রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষুদ্র ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরিবার হচ্ছে মানব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষালয়। তাই পরিবারেই যদি নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা সম্ভব হয়; তবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পরিবারের সদস্যরাই নানাভাবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্যহীন পরিবার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্যহীন পরিবার প্রতিষ্ঠায় পরিবারের অভিভাবক হিসেবে পিতামাতাকে দায়িত্ব নিতে হবে।

নানা ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য থাকলেও সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে ধারাবাহিকভাবে ওই বৈষম্য কমে আসছে এ কথা সত্য। তবে সম্প্রতি তার অবনতিও লক্ষ করা যাচ্ছে। ডব্লিউইএফ-এর ২০২২ সালের প্রতিবেদন এমনটিই বলছে। ডব্লিউইএফ-এর ২০২২ সালের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ৬ ধাপ পিছিয়ে বিশ্বের ১৪৬ দেশের মধ্যে ৭১ নম্বরে নেমে গেছে। গত বছর ওই তালিকায় বাংলাদেশ ৬৫ নম্বরে ছিল। তার আগের বছর ছিল ৫০তম।

তাই সর্বক্ষেত্রে কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্য দূর করা সম্ভব হয়েছে সে বিষয়টি দাবি করার সময় এখনও আসেনি। আর ওই বৈষম্য দূরীকরণ তখনই সম্ভব হবে যখন কন্যাসন্তানের প্রতি তার পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ পরিবারেই কন্যাসন্তান পুত্রসন্তানের সমান অধিকার লাভ করবে। আর অমনটি সম্ভব হলে আগামী বছরগুলোয় ক্রমান্বয়ে ডব্লিউইএফ-এর গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উন্নতি হবে তা বলা যায়। সবকিছু রাষ্ট্রের ওপর ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম ইউনিট পরিবারকেও নারীর উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে। পরিবার তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে রাষ্ট্রের ওপর দায়িত্বের বোঝা তখন কমে যাবে। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী ও পুরুষের বৈষম্য দূর হবে। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ