X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

অর্থনৈতিক পর্যালোচনা ২০২২: সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বছর

সুলতান মাহমুদ
০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ২২:৩৬আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ২২:৩৬

কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রাক্কালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে বাঁধাগ্রস্ত করেছে। বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট, বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, সার ও কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত, টাকার  দরপতন,  মূল্যস্ফীতি,  আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার, খেলাপি ঋণ, ইত্যাদি ২০২২ বছর  জুড়ে ছিল আলোচনার শীর্ষে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় হলেও রফতানিতে প্রথম, ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে ষষ্ঠ, মাছ  উৎপাদনে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে সপ্তম, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, ছাগলের দুধ ও মাংস উৎপাদনে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও চতুর্থ,  গবাদিপশু পালনে দ্বাদশ, মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম,  চা উৎপাদনে নবম, ফুলকপি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে নবম, পেঁপে উৎপাদনে চতুর্দশতম, এবং জলবায়ু (বন্যা, খরা, ও লবণ) সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনে শীর্ষে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৮৬ ভাগই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে।

বিশ্ব ব্যাংক-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধমান এবং দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় ক্রমবর্ধমান প্রধান অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে গড়ে জিডিপির ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লীগ টেবিল (২০২২)-এর তথ্য অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বে ৩৪তম (নমিনাল) স্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০২২) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জিডিপির পরিমাণ ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস ২০২২)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরটিতে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭  দশমিক ২৫  শতাংশে পৌঁছেছে, যা বিগত অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অর্থবছরটিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বিগত অর্থবছরের তুলনায় বেশি হওয়ায়, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের উন্নতি হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০২০-২১) মাথাপিছু আয় ছিল ২৫৯১ মার্কিন ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরটিতে মাথাপিছু আয় ২৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। পূর্ববর্তী অর্থবছরগুলোর মতো, প্রধানত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি ও অগ্রগতিতে অবদান রেখেছে যথাক্রমে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ, ৩৭ দশমিক ০৭ শতাংশ এবং ৫১ দশমিক ৪৪ শতাংশ, যা বিগত অর্থবছরে ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ০৭ শতাংশ, ৩৬ দশমিক ০১ শতাংশ এবং ৫১ দশমিক ৯২ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরটিতে জিডিপির শতাংশ হিসেবে দেশে এখন ভোগ ব্যয়ের শতকরা হার ৭৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ যা বিগত অর্থবছরে ছিল ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং মোট জাতীয় সঞ্চয়ের পরিমাণ ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা বিগত অর্থবছরে ছিল ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। দেশটিতে ২০২১-২২ অর্থবছরটিতে, জিডিপিতে বিনিয়োগের শতকরা হার ৩১ দশমিক ৬৮ শতাংশ  (ব্যক্তি খাত ২৪ দশমিক ০৬ শতাংশ + সরকারি খাত ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ) যা বিগত অর্থবছরে ছিল ৩১ দশমিক ০২ শতাংশ  (ব্যক্তি খাত ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ + সরকারি খাত ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ)। জিডিপিতে রাজস্ব আদায়ের শতকরা হার ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ (কর ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ + কর বহির্ভূত ১ দশমিক ০৯ শতাংশ) যা বিগত অর্থবছরটিতে ছিল ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ (কর ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ+ কর বহির্ভূত ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ)।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরটিতে মোট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৫ দশমিক ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩ দশমিক ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা বিশ্বের মোট বিদেশি বিনিয়োগের ০ দশমিক ২১ শতাংশ, উল্লেখ্য বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা বিশ্বের ২ দশমিক ১৩ শতাংশ। বিআইএসআর মনে করে, বাংলাদেশে আরও অধিক পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে, যদি ব্যবসায় এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।

২০২১-২২ অর্থবছরটিতে, মোট রফতানির পরিমাণ রেকর্ড ৫২ দশমিক ০৮  বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ২৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি এবং মোট আমদানির পরিমাণ রেকর্ড ৯২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (এলসি খোলার হিসেবে), যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ৫০ দশমিক ০৬ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর লেবার ফোর্স সার্ভের (মার্চ, ২০১৭) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ৬৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন (পুরুষ ৪৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন এবং মহিলা ২০ মিলিয়ন) শ্রমশক্তির মাঝে ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন জনবল বেকার রয়েছে, যা মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (২০২২)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট তরুণদের ১০.৬ শতাংশ বেকার। বাংলাদেশের বেকারত্বের হার প্রায় ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ, যা বিগত অর্থবছরটিতে ছিল ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। যদিও স্বাধীনতার পর থেকে বেকারত্ব, বিশেষ করে যুব বেকারত্ব (বর্তমানে ৪৭% বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকধারী বেকার) বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা, তথাপি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বেকারত্ব কমানোর বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনও পরিকল্পনা নেই। বিআইএসআর-এর পরামর্শ হলো, বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে রূপকল্প ২০৪১ অর্জনে সৃজনশীল পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নযোগ্য কৌশলগুলো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

কোভিড-১৯ এর কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ (প্রায় ১ কোটি ৬৪ লাখ) নতুন দরিদ্র হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এবং ইউনিভার্সিটি অফ বাথের মতে,  ২০২০ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ  যেখানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগের অনুমান অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত দেশের দারিদ্র্য বেড়ে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে।

কোভিড-১৯ অতিরিক্ত ১৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ "নতুন দরিদ্র" যোগ করেছে নিশ্চলতা-স্ফীতি  (ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি অবস্থা যখন উচ্চহারে বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতি পরিলক্ষিত হয়) এবং প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের চেয়ে ধীরগতি হওয়ার  কারণে (পিপিআরসি এবং বিআইজিডি ২০২২)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ  যা ২০০০ সালে ছিল ৪৮ দশমিক ০৯ শতাংশ। অর্থাৎ কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী, ২০০০-২০০১ অর্থবছর থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে গড়ে ১ দশমিক ৬২ শতাংশ হারে।

কোভিড-১৯ চলাকালীন এবং পরবর্তী বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে তথাপি দেশটি বিশ্বের মধ্যে ধনী শ্রেণির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির শীর্ষে অবস্থান করছে। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন ১৭ হাজারের ও বেশি নতুন কোটিপতি যোগ হওয়ায়, আর্থ-সামাজিক খাতগুলোতে অগ্রগতি সত্ত্বেও, দেশটিতে আয়বৈষম্য প্রকট হয়েছে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস-এ প্রকাশিত "বিশ্ব বৈষম্য রিপোর্ট ২০২২" অনুযায়ী, ৪০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ২১ শতাংশ, প্রথম ১০ শতাংশ  শীর্ষ ধনী ব্যক্তিরা দেশের মোট  আয়ের ২৭ শতাংশ  আয় করেন এবং  শীর্ষ ১ শতাংশ  ধনীরা আয় করে দেশের মোট আয়ের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। যদিও মোট জিডিপি এবং দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় গত এক দশক ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে, তবুও দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এর সুবিধা সমানুপাতিক হারে ভোগ করতে পারেনি। ইউএনডিপির ২০২০ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের গিনি সূচকের পয়েন্ট ০ দশমিক ৪৮। কোনও দেশের এই স্কোর ০ দশমিক ৫০-এর ঘর পেরোলেই উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

২০২১-২২ অর্থবছরটিতে, গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ, যা বিগত অর্থবছরটিতে ছিল ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যদিও অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে হচ্ছে, তথাপি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিশেষ করে ভোজ্য তেল, চাল, জ্বালানি তেল, ডাল, চিনি, আটা, ঔষধ এবং স্বাস্থ্যসেবা পণ্যের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি ছিল বহুল আলোচিত। বিবিএস ২০২২-এর হিসাব অনুসারে, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার যথাক্রমে ৯.৫২ শতাংশ এবং ৯.১০ শতাংশ যা ১৩৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

পোশাকশিল্পের পর চামড়া এবং পাট বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় শিল্পের মধ্যে অন্যতম। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে শিল্পদ্বয়ের তেমন কোনও অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি, বরং ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিককে অবসরে পাঠানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে সরকার। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল যুগের অবসান ঘটল। ২০২১-২২ অর্থবছরটিতে, পাট শিল্পের পাশাপাশি চামড়া শিল্পের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় নি। পূর্ববর্তী অর্থবছরগুলোর মতো, পবিত্র ঈদুল আজহার পূর্বে সরকার কর্তৃক কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য বেঁধে দেওয়া হলেও বেশিরভাগ চামড়া নামমাত্র দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে সাধারণ জনগণ।

২০২২-২৩ অর্থবছরটিতে মোট বাজেটের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা বিগত অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায়  ১২ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি এবং মোট জিডিপির ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ (মার্কিন ডলারের বর্তমান মূল্যে)। উন্নয়ন বাজেট ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৬ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং বিগত অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায় ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ বেশি। পূর্ববর্তী অর্থবছরগুলোর মতো, চলতি অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে বরাবরের মতো বাজেট ঘাটতি বিদ্যমান রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরটিতে মোট ঘাটতি বাজেট ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৬ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং বিগত অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায়  ১৪ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি ।

বিআইএসআর ট্রাস্ট মনে করে বাজেট বরাদ্দের অপচয় বা অব্যবহৃত থাকা রোধে চাহিদা ভিত্তিক বাজেট অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে তাই প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে চাহিদা ভিত্তিক বাজেট তৈরির বিষয়ে প্রস্তাব দিয়ে আসছে। বরাবরের ন্যায় এবার ও বাজেট প্রস্তুতির পদ্ধতিতে কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি। যদিও চাহিদাভিত্তিক বাজেট তৈরি না হওয়ার ফলে অর্থ অপচয়ের বা অব্যবহৃত থাকার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে, সরকারকে বাজেট বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নে আরো বেশি উদ্ভাবনী হতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক (জুন ২০২২)-এর তথ্য অনুযায়ী, বিগত অর্থবছরের মতো ২০২১-২২ অর্থবছরটিতে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমে যাওয়া এবং সরকারের অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে সঞ্চয়পত্রের প্রতি জনগণের আগ্রহ কমেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, রূপকল্প ২০৪১ অর্জনের মাধ্যমে উচ্চ মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার জন্য অর্থ পাচার (প্রকৃত অর্থে বৈদেশিক মুদ্রাপাচার) এবং খেলাপি ঋণ ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম।

২০২২ বছরটিতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা  যা বিগত বছর থেকে ২৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮ দশমিক ২৭  বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়, বিশেষ করে ২০১৫ সালে প্রায় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়েছে। গত এক বছরে, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা  মোবাইল ব্যাংকিং বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস যেমন নগদ, রকেট, উপায়, ও বিকাশ ব্যবহার করে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করেছে।  আমদানিতে "ওভার ইনভয়েসিং" এবং রপ্তানিতে" আন্ডার ইনভয়েসিং"-এর মাধ্যমে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৮% কোনও না কোনোভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসছে।

বাংলাদেশের মত উদীয়মান অর্থনৈতিক দেশে রেমিট্যান্সকে বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের (জুন, ২০২২) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরটিতে মোট রেমিট্যান্স প্রবাহের পরিমাণ ২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এই বছর বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্সের সপ্তম সর্বোচ্চ গ্রহীতা হতে পারে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (নভেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত)এর তথ্য অনুসারে, মোট ১০ লাখ ২৯ হাজার ৫৪ জন শ্রমিক (নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৯৯ হাজার ৬৮৪ জন) বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গিয়েছে কর্মসংস্থানের জন্য, যা বিগত অর্থবছরটিতে ছিল ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন (নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৮০ হাজার ১৪৩ জন)।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপির ২০২১-২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মানব উন্নয়ন সূচকে-এ বাংলাদেশের অবস্থান ১৯১টি দেশের মধ্যে চার ধাপ এগিয়ে ১২৯ তম । দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে মালদ্বীপ (৯০ তম), দ্বিতীয় ভুটান (১২৭ তম ), বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় (গত বছর ছিল পঞ্চম) এবং ভারত চতুর্থ (১৩১ তম)। সার্বিকভাবে, মানব উন্নয়ন সূচকে  বাংলাদেশের অবস্থান বিগত বছরের তুলনায় উন্নতি হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি অনুদানের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা কমেছে। দেশটির অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ায় বিদেশি সহায়তায় অনুদানের পরিমাণ কমে ৩ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ১৯৭১-৭২ অর্থবছরটিতে ছিল সর্বোচ্চ প্রায় ৮৪ থেকে ৮৬ শতাংশ ।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে দেশটিতে ই-কমার্স ব্যবসা-বাণিজ্যের বাজার প্রতিবছর প্রায় ১৫০ বিলিয়ন টাকারও বেশি, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন টাকা। গত ছয় বছরে দেশের ই-কমার্স ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২৬ গুণ।

অনলাইন কেনাকাটা এবং ই-কমার্স ব্যবসা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ চলাকালীন এবং পরবর্তীতে  কিন্তু ইভ্যালি, কিউকম, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং এবং রিং-আইডিসহ বেশ কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে সারা বছর ধরে ব্যাপকভাবে আলোচনার বিষয় বস্তুতে পরিণত হওয়ার ফলে এখন অনলাইন কেনাকাটার প্রতি মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। ই-কমার্স শিল্পের ভবিষ্যত বিপর্যয় রোধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে  আলাদা শিল্প নীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে দ্রুত কর্যকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। 

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটালাইজেশনের কারণে ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে দেশটি এখন বিশ্বের অন্যতম পথিকৃৎ। ভারতের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং উৎস এখন বাংলাদেশ (১৬ শতাংশ)। এই সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিনির্ভর আউটসোর্সিং খাতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিয়মিত কাজ করছে প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজারের ও বেশি যুবক। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট (ওআইআই) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে আউটসোর্সিংয়ে প্রতি বছর বাংলাদেশ প্রায় ১  বিলিয়নের ও বেশি মার্কিন ডলার আয় করছে।

উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী ডিজিটালাইজেশন এবং প্রযুক্তিগত বিকাশের জন্য দেশটি  দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলস্বরূপ বাংলাদেশ ২০২১-২২ অর্থবছটিতে প্রায় ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) পণ্য রফতানি করেছে এবং ২০২৫ সাল নাগাদ ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা করেছে কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিবেচনায় রাখলে এটা যথেষ্ট নয়। যদিও, এই সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিনির্ভর আইসিটি খাতে নিয়মিত কাজ করছে প্রায় ১ দশমিক ৩ মিলিয়নেরও বেশি যুবক।

২০২১ সালের নভেম্বরে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)-এর কাছ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে সফলভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে । মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে দেশটির ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি ধরে রাখা এখন সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।

২০২১-২২ অর্থবছরটিতে  ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব, ১৯টি জেলায় বন্যা, সিত্রাংসহ ১০টিরও বেশি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় এবং নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে,  বাংলাদেশের  অর্থনৈতিক অগ্রগতি শুধু ইতিবাচকই নয়, বরং দেশটি উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় গবেষণা এবং সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের কঠোর অব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। 

লেখক: গবেষক, অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট ।

Email: [email protected]

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ