X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

আইনজীবী ও বিচারকের আত্মঘাতী বিরোধ অশনি সংকেত

মো. জাকির হোসেন
১২ জানুয়ারি ২০২৩, ১৮:১৩আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ১৮:১৩

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুকের এজলাস চলাকালীন কতিপয় আইনজীবীর অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও অশালীন আচরণের ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এজলাস কক্ষে বিচারকের সঙ্গে শিষ্টাচারবহির্ভূত ও অশালীন আচরণ কেবল অনভিপ্রেত, ন্যক্কারজনক ও দুঃখজনকই নয়; এটি রাষ্ট্রের জন্যও অশনি সংকেত। এতে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও সম্মান মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।

আমি অশনি সংকেত বলছি এই কারণে–

এক. এই ঘটনা আকস্মিকভাবে ঘটেনি। এটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। নেপথ্যের ঘটনাপ্রবাহ থেকে জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরের ১ তারিখে নিম্ন আদালতের মাসব্যাপী ছুটি শুরু হওয়ার শেষ দিনে বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ ফারুক দিনের প্রথমার্ধে এজলাসের কাজ শেষ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারার বিধান অনুযায়ী দুটি মামলার সালিশ নিষ্পত্তিতে বসেছিলেন। এসময় একজন আইনজীবী বিচারকের খাস কামরায় উপস্থিত হয়ে নতুন মামলা গ্রহণের আবেদন করেন। সালিশরত বিজ্ঞ বিচারক সালিশ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু আইনজীবী অপেক্ষা না করে ওই মুহূর্তেই মামলা গ্রহণ করতে চাপ সৃষ্টি করেন। শপথ নিয়ে বাদীর জবানবন্দি নেওয়া বাধ্যতামূলক বিধায় খাস কামরায় মামলা নেওয়ার সুযোগ নেই। সালিশ বাদ দিয়ে বিচারক ওই মুহূর্তে এজলাসে উঠতে রাজি না হওয়ায় আইনজীবী সমিতির সভাপতি এসে বিজ্ঞ বিচারকের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। বাদানুবাদের একপর্যায়ে আদালত বর্জনের হুমকি প্রদান করেন আইনজীবী নেতৃবৃন্দ। ছুটি শেষে নতুন বছরের প্রথম দিনে আদালতের কাজ শুরু হয়। বিচারক মোহাম্মদ ফারুক দিনের প্রথমার্ধের বিচারিক কাজ শেষ করে এজলাস থেকে নেমে খাস কামরায় গেলে আইনজীবী নেতারা আদালতের পেশকারের কক্ষে ঢুকে চিৎকার করে বলতে থাকেন, আদালত বর্জনের ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও বিচারক এজলাসে কেন উঠলেন?

এজলাসে আর না ওঠার জন্যও হুমকি দিয়ে যান তারা। পরের দিন অর্থাৎ জানুয়ারির ২ তারিখে বিচারক এজলাসে বসা অবস্থায় আইনজীবী নেতারা তাকে এজলাস থেকে নেমে যেতে বলেন। বিচারক মোহাম্মদ ফারুক আইনজীবীদের বোঝাতে চেষ্টা করেন, আদালত বর্জন মানে আদালতকে পরিত্যাগ করা, পরিহার করা কিংবা আদালতে মামলা উপস্থাপন না করা। কিন্তু আইনজীবীরা তা শুনতে নারাজ। তারা এটাও মানতে নারাজ যে আদালত বর্জন মানে বিচারককে জোর করে, পেশিশক্তি ব্যবহার করে, অশ্লীল, অশোভন ভাষায় গালিগালাজ করে এজলাস থেকে নামতে বাধ্য করা নয়।

দুই. আইনজীবীদের আদালত বর্জন বেআইনি ও অবৈধ জানা সত্ত্বেও আদালত বর্জন ও বিচারককে এজলাস থেকে নামতে বাধ্য করা কেবল আইনের গুরুতর লঙ্ঘন নয়, শিক্ষা ও সভ্যতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের নগ্ন উদাহরণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আইনজীবীদের আদালত বয়কটকে সংবিধান পরিপন্থি উল্লেখপূর্বক হাইকোর্টের রায় রয়েছে। আদালত বয়কট কিংবা বিচারকের কাজে বাধা প্রদানের মতো যেকোনও কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে সারা দেশের সব আইনজীবীর ওপর ২০০৫ সালে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগ। বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন ও বিচারপতি এ এফ এম আব্দুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ২০০৫ সালের ২৩ মে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। (সূত্র:15 BLT, 2007, 66)। হাইকোর্টের একজন বিচারপতির এলএলবি ডিগ্রি বাতিল হলে বিষয়টি উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়। বিষয়টি বিচারাধীন থাকার পরও আইনজীবীরা ওই বিচারকের আদালতে প্রবেশ করে তাকে বিচারকাজ করা থেকে বাধা প্রদান করেন।

সুপ্রিম কোর্ট বারে রেজুলেশন পাস করে আইনজীবীদের একাংশ ওই বিচারপতির কোর্ট বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রধান বিচারপতির কোর্ট বয়কটেরও হুমকি দেন। আদালত চলাকালে আদালতের করিডোরে মিছিল করেন ওই আইনজীবীরা। এতে বিচারকাজ বিঘ্নিত হয়। আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির পথ রুদ্ধ করে দিয়ে পুরো কোর্ট অচল করে দেওয়ার হুমকিও দেন। এই পরিস্থিতিতে বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন ও বিচারপতি এ এফ এম আব্দুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোর্ট বয়কট ও কোর্টের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত করা থেকে বিরত থাকতে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ওই আদেশে কেবল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের নয়, বরং সারা দেশের সব আইনজীবীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন হাইকোর্ট। ফলে দেশের যেকোনও আদালত বয়কট করা কিংবা আদালতের কাজে বাধা প্রদান করা থেকে আইনজীবীরা হাইকোর্টের আদেশ দ্বারা বারিত। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে আদালত অবমাননা হিসেবেও উল্লেখ করেন হাইকোর্ট। আদেশে হাইকোর্ট বলেন, আইন ও আদালতে অবারিত প্রবেশাধিকার বিচারপ্রার্থীদের সাংবিধানিক অধিকার, যা রক্ষা করা আদালতেরই কর্তব্য। কোনও আইনজীবী এই অধিকারে বাধা দিলে বা আদালত বয়কট করলে সেটি হবে পেশাগত অসদাচরণ, বিচারকাজে বাধাদান, আদালত অবমাননা ও ফৌজদারি অপরাধ।

তিন. যদি যুক্তির খাতিরে ধরেও নিই, বিচারক মোহাম্মদ ফারুক ওই মুহূর্তে এজলাসে উঠে মামলা না নেওয়ায় অনিয়ম হয়েছে, কিংবা আইনের ব্যত্যয় হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রতিকারের বিধান রয়েছে। কোনও বিজ্ঞ বিচারক কোনও ভুল করলে, অন্যায় করলে, অপরাধ করলে তার প্রতিকারের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। বিজ্ঞ বিচারকের বিষয়ে কোনও অভিযোগ থাকলে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উপযুক্ত আইনানুগ কর্তৃপক্ষ রয়েছেন। কিন্তু আইনজীবীরা তা অনুসরণ না করে, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। আদালত বর্জনের কোনও লিখিত সিদ্ধান্ত বিচারককে জানানো ছাড়াই আইনজীবীরা বিচারকের প্রতি মারাত্মক অশোভন আচরণ করেছেন, এজলাস থেকে নেমে যেতে বাধ্য করেছেন। বিচারের অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক বিধান ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগদান ব্যতীত কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না’- এই নীতির প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন আইনজীবীরা।

চার. আইনজীবীরা বিচারক জনাব মোহাম্মদ ফারুকের প্রতি শিষ্টাচারবহির্ভূত ও অশালীন আচরণ করেই ক্ষান্ত হননি। বরং, বিচারক মোহাম্মদ ফারুককে অশালীন ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে এজলাস থেকে নামতে বাধ্য করার প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আদালত অবমাননার রুল জারি করার পর অভিযুক্ত আইনজীবীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গত ৫ জানুয়ারি ও ৮ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা ও দায়রা জজ বেগম শারমিন নিগারের এজলাস চলাকালে ওই বিচারকের বিরুদ্ধে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান প্রদান করেন। একজন নারী বিচারকের প্রতি এহেন আচরণ সভ্যতার কোনও মাপকাঠিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তদুপরি এমন আচরণ যখন আইনজীবীরা করেন তখন এসব অশনি সংকেত নয় তো কি?

পাঁচ. ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার পর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের কাছে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলাম। সবাই এমন ঘটনাকে সঠিক হয়নি কিংবা উচিত হয়নি বলেননি, বরং এমন আচরণকে গর্হিত বলে মত দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি মন্তব্য আমি উল্লেখ করছি, একজন লিখেছেন, ‘আদালতে হৈ চৈ এর ঐ দৃশ্য দেখে আমার George Orwell এর Animal Farm এর কোনো একটা দৃশ্যের মতো মনে হচ্ছিল’।

আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘দুঃখজনক! আইনজীবীরা যদি আইন না মানেন, তো চোর-ডাকাতদের দোষ দিয়ে লাভ কি!’

তৃতীয় আরেকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘আইনজীবিরা (আইনজীবীরা) কোনো ধরণের (ধরনের) রাজনীতি করতে পারবে না, রুল জারি করা হোক এবং আদালত অবমাননা করলে লাইসেন্স বাতিলসহ কঠিন শাস্তির বিধান করা হোক।’

অন্যান্য পেশার মতো বিজ্ঞ বিচারকগণ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে পারেন না, বিচারকার্য করা থেকে বিরত থাকতে পারেন না, আদালত বর্জন করতে পারেন না, সংবাদ সম্মেলন করতে পারেন না। তাই সংবেদনশীল ও সচেতন মানুষদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। আদালত পাড়ায় সব বিচারকের আচরণ বিচারকসুলভ নয় এটা সত্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু বিচারক এমনভাবে অন্যের মানহানি করেছেন, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য ফৌজদারি আইনে বিচার ও শাস্তিযোগ্য। কিন্তু বিচারক মোহাম্মদ ফারুক অনেকের থেকে আলাদা। তিনি কেবল মেধাবীই নন, অতি ভদ্র, নিরীহ ও সজ্জন ব্যক্তি। বিচারক মোহাম্মদ ফারুক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। জনাব ফারুকের ব্যাচ দিয়েই আমার শিক্ষকতা জীবনের শুরু। সেই হিসেবে বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে তিন দশকের সম্পর্ক। প্রথম ব্যাচের গ্র্যাজুয়েট হিসেবে আমার স্পষ্ট মনে আছে, জনাব ফারুক খুব শান্তশিষ্ট ও নিরীহ স্বভাবের ছিল। কোনও হৈ-হুল্লুড়ে ওকে দেখিনি। অনুচ্চ স্বরে কথা বলতো। শিক্ষকদের দেখলে বিনয়-ভক্তি-শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে যেত।

নিম্ন আদালতের অভিভাবক তুল্য বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে ফোনে কথা হলে এখনও অনুভব করি ফোনের অপরপ্রান্তে ভক্তি-শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়েছে। আদালত পাড়ায় কোনও কোনও বিচারকের অসততা ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার কথা জেনে ব্যথিত হলেও জনাব ফারুকের সততা শিক্ষক হিসেবে আমাকে গর্বিত করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে অনার্স মাস্টার্স করার পর ২৪তম বিসিএসের মাধ্যমে জুডিসিয়ারিতে সহকারী জজ হিসেবে যোগদান করেন ফারুক। ছোটবেলায় বাবা-মা হারানো ফারুক স্রষ্টার অপার কৃপায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তার মেধা আর পরিশ্রমের জোরে।

WIPO স্কলারশিপ নিয়ে তিনি ইতালির তুরিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক আইনে দ্বিতীয় মাস্টার্স করেছেন। এরপর ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপ নিয়ে নেদারল্যান্ড ও জার্মানির হামবুর্গ ইউনিভার্সিটি থেকে করেন তৃতীয় মাস্টার্স। লন্ডন থেকে সার্টিফিকেট কোর্স এবং আমেরিকা থেকে করেন আইনের ওপর ডিপ্লোমা। যেকোনও বিবেচনায় বিচারক মোহাম্মদ ফারুক বিচার বিভাগের জন্য সম্পদ। অত্যন্ত মেধাবী, সৎ ও অতি সজ্জন বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের প্রতি আইনজীবীদের এমন অশিষ্ট আচরণ বিচারকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও দারুণভাবে ব্যথিত করেছে।

আদালত বয়কট ও আদালতের কাজে বাধা প্রদান করা যে বেআইনি এবং এর ফলে গুরুতর আইনগত দায় সৃষ্টি হয় তা এই উপমহাদেশে ২৪৮ বছর আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোম্পানি শাসনামলে ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট প্রণীত রেগুলেটিং অ্যাক্টের আওতায় ১৭৭৪ সালে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন কোম্পানি সরকারের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বাল্যবন্ধু স্যার এলিজা ইম্পে। ১৭৭৫ সালে কামালউদ্দিনের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের জামিন আদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় নির্বাহী বিভাগ এবং আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কামালউদ্দিনকে জামিনে মুক্তি না দিয়ে অন্তরীণ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ১৭৭৭ সালের কসিজুরাহ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ও নির্বাহী বিভাগের সম্পর্ক চরম শত্রুতায় রূপ নেয়। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের নেতৃত্বে নির্বাহী বিভাগ সুপ্রিম কোর্টের আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়নে বাধা দিতে সামরিক শক্তি পর্যন্ত প্রয়োগ করে। মেদিনিপুরের অন্তর্গত কসিজুরার জমিদার রাজা সুন্দর নারায়ণ কাসিনাথবাবু নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের অর্থ ঋণ নেন।

বারবার তাগাদা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে কাসিনাথবাবু সুন্দর নারায়ণের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে টাকা উদ্ধারের মামলা দায়ের করেন। সুপ্রিম কোর্ট সুন্দর নারায়ণের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। জমিদার সুন্দর নারায়ণ গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে যায়। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব আদায় ব্যাহত হয়। গভর্নর জেনারেল ও তাঁর পরিষদ অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সাধারণ বিজ্ঞপ্তি জারি করে, জমিদারগণ সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারাধীন নয়। তাই তাদের সুপ্রিম কোর্টের আদেশ-নির্দেশ মানার প্রয়োজন নেই। পালিয়ে থাকায় গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল না হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট সুন্দর নারায়ণের সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেন। ক্রোকাদেশ তামিল করতে সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা শেরিফের নেতৃত্বে একদল লোক সুন্দর নারায়ণের বাড়িতে গেলে নির্বাহী বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী কর্নেল আহমুটি দুই প্লাটুন সৈন্য প্রেরণ করে ক্রোকাদেশ তামিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং শেরিফসহ ক্রোকাদেশ তামিলের জন্য আগত সবাইকে বন্দি করে কলকাতা কারাগারে প্রেরণ করেন।

এ অবস্থায় কাসিনাথবাবু গভর্নর জেনারেল, পরিষদ সদস্যবৃন্দ ও অ্যাটর্নি জেনারেলের বিরুদ্ধে মামলা করে। গভর্নর জেনারেল ও পরিষদ সদস্যবৃন্দ আদালতের সামনে হাজির হতে অস্বীকার করেন। আদালতের আদেশ অনুযায়ী অ্যাটর্নি জেনারেলকে আটক করে কারাগারে প্রেরণ করা হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলে কাসিনাথবাবু সব মামলা প্রত্যাহার করে নেন। সুপ্রিম কোর্ট ও নির্বাহী বিভাগের বিরোধের অবসান ও সুপ্রিম কোর্টের কাজে বাধাদানের ফলে সৃষ্ট নির্বাহী বিভাগের দায়মুক্তির জন্য অবশেষে ১৭৮১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘স্যাটেলমেন্ট অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাস করা হয়। তার মানে, আদালতের কাজে বাধাদানের ফলে যে গুরুতর আইনগত দায় সৃষ্টি হয় তা থেকে সাধারণভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। দায়মুক্তির জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি বিশেষ আইন পাস করতে হয়েছে। আমাদের আইনজীবীদের এই আইনের কথা অজানা থাকার কথা নয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুক এবং জেলা ও দায়রা জজ বেগম শারমিন নিগারের সঙ্গে অশালীন আচরণের ঘটনায় দুই দফায় আমাদের উচ্চ আদালত বেশ কয়েকজন আইনজীবীর ওপর আদালত অবমাননার রুল জারি করেছেন এবং ওই আইনজীবীদের আদালতে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দিয়েছেন।

আমি মনে করি আর সময়ক্ষেপণ না করে আইনজীবীদের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে এখনই বিষয়টির সুরাহা করা উচিত। বিচারক ও আইনজীবী একে অপরের পরিপূরক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একজন ছাড়া আরেকজন অচল। তাই আইনজীবী ও বিচারকের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সবসময় বজায় থাকা ন্যায়বিচারের স্বার্থেই আবশ্যক। সর্বাবস্থায় এই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকুক এই প্রত্যাশা নিরন্তর। বিচারক ও আইনজীবীর সম্প্রীতি নষ্ট হলে বিপন্ন হয় বিচার বিভাগ, আর এ কারণে আদালতের কার্যক্রম ব্যাহত হলে অপরিমেয় ক্ষতি ও দুর্ভোগের শিকার হন বিচারপ্রার্থীরা।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

   
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ