X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে: কী বলতে চেয়েছেন লেখক?

লীনা পারভীন
০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:২৭আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:২৭

ফাহাম আব্দুস সালাম। এই নামটি এতদিন খুব একটা পরিচিতি না হলেও একটি বইয়ের কারণে এখন মোটামুটি দারুণ আলোচনায় আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার অনেক ফলোয়ার। প্রবাসী এই লেখক বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মেয়ের জামাই। মির্জা ফখরুলের বাবা একজন চিহ্নিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি। এই তথ্যগুলো অবশ্যই একজন মানুষের রাজনৈতিক দর্শন বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় বলেই উল্লেখ করা। আর এটা অবশ্যই স্বীকার করতেই হবে যে রাজনৈতিক দর্শন ব্যতীত কোনও লেখক তার বইয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও তার যৌক্তিকতা, শাহবাগের যুদ্ধাপরাধবিরোধী আন্দোলন, শেখ মুজিবের একক নেতৃত্ব, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সংবিধান, শেখ হাসিনার শাসনামল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করবেন না।

ফাহাম আব্দুস সালাম তার বইয়ে কেবল বাঙালির চরিত্র বা মনোজগৎ নিয়ে আলোচনা করেননি, যেমনটা নীরদ সি চৌধুরী, আহমদ ছফারা তাদের “আত্মঘাতী বাঙালী” ও “বাঙালি মুসলমানের মন” বইয়ে করেছেন। বাঙালির মনস্তত্ত্ব নিয়ে অনেক লেখকেরই বই আছে, যেগুলো আমাদের ভাবতে শেখায় বা নিজেদের চিনতে শেখায়।

ফাহাম সাহেব সেই ধারাটিকে আশ্রয় করে অত্যন্ত কৌশলী রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করেছেন। তিনি তার বইয়ের “বাঙালির বিপ্লব” প্রবন্ধে রাষ্ট্র, সমাজ আর নাগরিকের চাওয়া, পাওয়া, বিশ্বাস, চর্চা, আইন, সংবিধান ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন, যার সারাংশ করলে বোঝা যায় না যে তিনি আসলে কোন ব্যবস্থায় মানুষের মুক্তির কথা বলতে চেয়েছেন? তিনি আবার প্রচলিত আইনকেও প্রশ্নবিদ্ধ বলতে চাইছেন, যেখানে বিচারপতিরা শক্তিমানের (ধরে নিচ্ছি শক্তিমান বলতে রাষ্ট্রকেই বোঝাচ্ছেন) প্রতি পরমব্রতী বলছেন। অনেক ধরনের বিচ্ছিন্ন আলোচনা করে একরকম অপ্রাসঙ্গিকভাবেই তিনি বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে টেনে এনেছেন।

সভ্য, সভ্যতা, ভাষা, রাজনীতি ইত্যাদি প্রসঙ্গ টেনে বোঝাতে চেয়েছেন বাঙালিকে গালি দিলেও সেটা গায়ে লাগে না। কোনও প্রসঙ্গ ছাড়াই তিনি শুরু করেছেন, ‘অবশ্যই আমরা আওয়ামী লীগ থেকে নিস্তার পাবো, সেটা বিপ্লব না। স্বাভাবিক পরিবর্তন।’

তার মতে, বিপ্লব মানে কোনোভাবেই আর আওয়ামী লীগকে পছন্দের দল হতে দিতে না চাওয়া বা চাওয়াকে আটকে দেওয়া– এই মানসিকতায় উত্তীর্ণ হওয়া। বিপ্লবী মানসিকতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমর্থন করা বা না করা কেমন করে জড়িত সেটা বোধগম্য হয়নি। অত্যন্ত মজার বিষয় হচ্ছে, তিনি ৭১-এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকেও বিপ্লবোত্তীর্ণ বিষয় মনে করেন না। হঠাৎ করেই টেনে নিয়ে এলেন পরমতসহিষ্ণুতার কথা। উদাহরণ দিলেন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে ডিনার করতে পেরেছিলেন। আজকে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কোনও নেতা কাছাকাছি কোনও আহ্বান করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে জেলে ঢোকানো হবে।’

এই জায়গাটিকে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। যদি আমি সঠিক বুঝে থাকি তাহলে তিনি বোঝাতে চাইছেন পাকিস্তানি শাসকরা অনেক পরমতসহিষ্ণু ছিল বলেই শেখ মুজিবকে সেদিন গ্রেফতার করেনি বা রাষ্ট্রদ্রোহী বলেনি। এর তুলনা তিনি করেছেন বর্তমান শাসনামলের তথাকথিত মত প্রকাশের স্বাধীনতার অভাব তত্ত্বের সঙ্গে। অথচ জনাব ফাহাম একবারও বলেননি যে শেখ মুজিব ৭ মার্চের আগে ও পরে কতবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। কতদিন জেলে কাটিয়েছেন আর পাকিস্তানিরা তাকে কতভাবে নির্যাতন করেছিলেন। শেখ মুজিবের পরিবার কয়দিন একসঙ্গে রাতের খাবার গ্রহণ করতে পেরেছিল সেই হিসাব নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি? প্রকারান্তরে তিনি ‘পাকিস্তান আমল ভালো ছিল’ টাইপের ন্যারেটিভকে উসকে কি দিচ্ছেন না?

লক্ষণীয় যে তিনি বাঙালির মনন ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করছেন অথচ কোথাও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কিছু বাঙালির পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন, ৭৫-এর ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ড, বিএনপি আমলে সারা দেশে একসঙ্গে গ্রেনেড হামলা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে শেখ হাসিনার ওপর রাষ্ট্রীয় মদতে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের গ্রেনেড হামলা, সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযুক্তিকরণ ইত্যাদি এমন প্রচুর ঘটনা নিয়ে কোনও আলোচনা করেননি বা উদাহরণও দেননি।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে তিনি গণদাবি বলতে চান না। তিনি বলেছেন এটি একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। একপক্ষকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে আরেকপক্ষ বসার সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ, পাকিস্তানি শাসকের বদলে বাঙালি শাসকের দখল, যাদের কোনও অভিজ্ঞতা বা প্রস্তুতি ছিল না। অথচ আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি গণযুদ্ধ, যার দাবি অবশ্যই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অংশ, কিন্তু সেটি ছিল একটি জাতির পরিচয় নির্ধারণী রাজনীতির অংশ।

খুব সুচতুরভাবে ফাহাম আব্দুস সালাম আমাদের ভাষা আন্দোলনকে খারিজ করে দিতে চেয়েছেন। তিনি মনে করেন, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি আমাদের জাতিকে ক্ষতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। শহীদদের প্রতি খালি পায়ে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যে এক ধরনের ধর্মীয় বিষয় আছে।

ভাষা আন্দোলন আমাদের প্রথম স্বাধিকার আন্দোলনের স্মারক। ফাহাম আব্দুস সালামের এহেন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের দাবিতে প্রাণ দেওয়া জাতির সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। ভাষা আন্দোলনকে যিনি একটি রাজনৈতিক ‘ছলছাতুরি’ বলতে পারে এবং একটি ভুল ইম্প্রেশনের ঘটনা বলে ন্যারেটিভ দিতে চায়, তিনি আর যাই হোক বাঙালির চেতনাকে ধারণ করতে পারেন না।

ফাহাম সাহেবের অবস্থান একদম পরিষ্কার হয়ে ধরা পড়ে একই বইয়ের ‘শাহবাগীদের দেশপ্রেম’ প্রবন্ধে। প্রথমত তিনি ‘শাহবাগী’ শব্দটা ব্যবহার করেছে, যেটি স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ভাষা। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের তিনি ‘ইসলামিস্ট নেতা’ বলে সম্বোধন করেছেন। কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠেছে বলে তিনি শাহবাগের আন্দোলনকারীদের দেশপ্রেমিক বলতে রাজি না। অর্থাৎ ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গোটা পৃথিবীর লাখো কোটি বাঙালির মধ্যে দেশপ্রেম নেই, কিন্তু এই আন্দোলনের বিরোধিতাকারী ফাহাম সাহেবের আছে। ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকে প্রকারান্তরে ‘কোল্যাটারাল ডেমেজ’ বলে চালাতে চেয়েছেন। এ এক ধৃষ্টতার উদাহরণ বটে।

এমন প্রচুর উদাহরণ আছে যেগুলোকে ধরে ধরে প্রমাণ করা যাবে যে ফাহাম সালাম কোনোভাবেই তার বইয়ে বাঙালির মানসিকতা নিয়ে আলোচনা করেননি বরং তিনি আমাদের বাঙালি চেতনা, সংস্কৃতি, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো যেসব আত্মঅহংকারের ঘটনা আছে, সেগুলোকে বিতর্কিত করতে চেয়েছেন। তিনি সরাসরি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন। বাঙালিত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন। ওনার বইয়ের নাম বরং হওয়া উচিত ছিল “বাংলাদেশবিরোধী মানসিকতার সন্ধানে”।

এই বাংলাদেশে এহেন বক্তব্য সরাসরি আমাদের সংবিধান ও চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাস্তবে ফাহাম সালামের মতো বুদ্ধিজীবীরা আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। সরকারের বিরোধিতা করা আর রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা দুটি দুই বিষয়। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের মালিক নয়, তাই আওয়ামী লীগ বিরোধিতা করতে গিয়ে কেউ যদি আমার রাষ্ট্র বা সংবিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেষ্টা করে, তাহলে সেই মতবাদকে থামিয়ে না দেওয়া মানেই আপনি রাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছেন, যার মীমাংসা ১৯৭১ সালেই হয়ে গেছে।

আমরা বর্তমানে যে বাংলাদেশে অবস্থান করছি তার কেবল এগিয়ে যাবার সময়। পেছনে তাকানোর কোনও সুযোগ আর নেই। আর সেই এগিয়ে যাওয়ায় মূল ভিত্তি হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু। এখানে কোনও আপসের পথ খোলা থাকা উচিত না। আগামীর বাংলাদেশ গড়ে উঠবে এক চিন্তা ও এক বিশ্বাসের ভিত্তিতে। বিভাজিত পথে সেই রাষ্ট্র গড়ে তোলা যায় না। আর তাই যে মতবাদ বা ব্যক্তি এগিয়ে যাওয়ার রাস্তায় বিভাজনের চেষ্টা করবে, আমরা সাধারণ জনগণ সেটিকে রুখে দাঁড়ানোর দাবি করতেই পারি।

লেখক: কলামিস্ট

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঈদের ছুটি শেষে ফিরছিলেন ঢাকায়, পথেই শেষ ৪ সদস্যের পরিবার
ফরিদপুরে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ১৩ঈদের ছুটি শেষে ফিরছিলেন ঢাকায়, পথেই শেষ ৪ সদস্যের পরিবার
কাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
সিনেমা সমালোচনাকাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে নৌকাডুবিতে নিহত ৪
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে নৌকাডুবিতে নিহত ৪
উপজেলা নির্বাচনে যাচ্ছে না বিএনপি
উপজেলা নির্বাচনে যাচ্ছে না বিএনপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ