X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:৫২আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:৫২

উন্নয়ন একটি বহুমাত্রিক ধারণা। একটি দেশের উন্নয়ন বোঝাতে অর্থনীতি, সমাজনীতি অবকাঠামোসহ অন্যান্য সব ক্ষেত্রের উন্নয়নকে বোঝায়। যেকোনও দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার দায়িত্ব অর্পিত হয় সেই দেশের সরকারের ওপর। সরকার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে নীতি বাস্তবায়ন করে এবং সেই নীতি বাস্তবায়নের ফলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলমান থাকে। তবে, সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সর্বোপরি দেশের জনগণের সহায়তা উন্নয়ন প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পূর্বশর্ত। একটি দেশের সরকার বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নিতে পারে, কিন্তু সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সেই দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

দীর্ঘ সংগ্রামের পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার কাজ শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে। কিন্তু নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং সেনাবাহিনীর একটি অংশের হটকারিতার কারণে বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাতে। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল। ফলে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সালের সময়কালে বিভিন্ন সামরিক সরকার গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ করে দেশ পরিচালনা করার চেষ্টা করেছিল বিধায় দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হয়নি।
 
পরবর্তীতে, ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে সামরিক সরকারের পতনের পরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি বিভিন্ন সময় বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। এর মূল কারণ ছিল ক্ষমতার ধারাবাহিকতার অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসার পরে আগের সরকারের কর্মকাণ্ডকে কখনোই এগিয়ে নিয়ে যায় না। ফলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া বিভিন্ন সময় বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণেই ২০০৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত একটি ব্যতিক্রমী সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশকে পরিচালিত করেছিল। সেনাবাহিনী সমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিরাজনীতিকরণের বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলমান ছিল সেই সময়। কিন্তু জনগণের বাধার মুখে সেই সরকার তাদের নীতি বাস্তবায়ন করতে পিছপা হতে বাধ্য হয়েছিল।

বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে দিন বদলের সনদের যে প্রত্যয় আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্ত করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় গত প্রায় ১৪ বছরে বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ করছে গোটা পৃথিবী। বাংলাদেশের এই অভূতপূর্ব উন্নয়নের পেছনে যিনি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একই সঙ্গে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা তাঁকে নীতি বাস্তবায়নের স্বাধীনতা প্রদান করেছে।
 
তবে, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রায় তিন মাসব্যাপী হরতালের কারণে দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। একদিকে যেমন অর্থনীতির চাকা মুখ থুবড়ে পড়েছিল, ঠিক তেমনি জ্বালাও পোড়াওয়ের রাজনীতি এবং পেট্রোলবোমার আঘাতে হাজার হাজার মানুষ আগুনে পুড়েছে সেই সময়। কয়েকশ’ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে পেট্রোলবোমার আঘাতে এবং কয়েক হাজার মানুষ আগুনে পোড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে আজও  বেঁচে আছে। ঠিক তেমনিভাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও নির্বাচন কেন্দ্রিক এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল জনগণের মধ্যে। তবে, নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সেই আশঙ্কা দূর হলেও বিরোধী দলের নির্বাচনের ফলাফল বর্জনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনের অচলাবস্থা দূর হয়নি। এই ধরনের রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং অস্থিরতা উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়।

আমরা যদি বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতির দিকে তাকাই তাহলে দেখবো, বিভিন্ন দেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দলীয় স্বার্থের ওপরে দেশের স্বার্থকে স্থান দিয়ে রাজনীতি করে। তাদের কাছে দেশের স্বার্থ সবসময় আগে বিবেচিত হয়ে থাকে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে দেশের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দল একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে সবসময়। বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও দেশের স্বার্থে তারা সবসময় একসঙ্গে কাজ করে। ১৯৯৯ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যখন কারগিল যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেই সময় ভারতের সব রাজনৈতিক দল নিজেদের মতপার্থক্য ভুলে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল।

পরবর্তীতে, ভারত সরকারের দৃঢ়তা, সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপের কারণে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পাকিস্তান সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল। ভারতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে প্রতিটি রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া হলেও যে কোনও মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার পরিবর্তে দেশের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া উচিত। ফলে, ভারতের রাজনীতি থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা অনেক কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য সংসদের দ্বাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো এবারও বিরোধী রাজনৈতিক জোটগুলো বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যাপারে বিরোধী দল এখন পর্যন্ত দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংবিধানের আলোকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। ফলে, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক ধরনের অস্থিরতা জনগণের মধ্যে দানা বেঁধেছে।

তবে আশার কথা হচ্ছে, অতি সম্প্রতি রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্য থেকে  অনুমান করা যাচ্ছে পর্দার অন্তরালে হয়তো সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে নির্বাচন কেন্দ্রিক এক ধরনের সমঝোতা হতে চলেছে। যদি কোনও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে নির্বাচন কেন্দ্রিক দূরত্ব কমে যায় তাহলে তা হবে দেশের গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

যেকোনও দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুসংহত করা এবং উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলের একই রকম ভূমিকা রয়েছে। ফলে, রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য শুধু সরকারি দলকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। সরকারি দলকে যেমন কিছুটা ছাড় দিতে হবে, ঠিক তেমনি বিরোধী দলকে তাদের অযৌক্তিক দাবি থেকে সরে এসে বাস্তবধর্মী দাবি উত্থাপন এবং দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। ফলে, উভয় রাজনৈতিক দল এবং জোট যদি নিজেদের অবস্থানে কিছুটা পরিবর্তন এনে এবং নিজেদের দাবির ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দিয়ে দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে পারে তবে তা একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুসংহত করবে, ঠিক তেমনিভাবে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।

গত ১৪ বছরে বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিশ্বব্যাপী। উন্নয়নের এই প্রক্রিয়া চলমান থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ফলে, যেসব রাজনৈতিক দল দেশের জন্য রাজনীতি করবে তাদের উচিত নিজেদের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে রাজনীতি করা। কারণ, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার কারণে উন্নয়ন প্রক্রিয়া যদি ব্যাহত হয় তাহলে বাংলাদেশের জনগণ সেটি কখনোই মেনে নিবে না।

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রানা প্লাজায় নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ
রানা প্লাজায় নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৫
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৫
জেলা আ.লীগ সম্পাদকের প্রতিদ্বন্দ্বী সভাপতির ছেলে, আছেন ছাত্রলীগ সম্পাদকও
উপজেলা নির্বাচনজেলা আ.লীগ সম্পাদকের প্রতিদ্বন্দ্বী সভাপতির ছেলে, আছেন ছাত্রলীগ সম্পাদকও
নির্মাণাধীন ভবনমালিকদের মেয়র তাপসের হুঁশিয়ারি
নির্মাণাধীন ভবনমালিকদের মেয়র তাপসের হুঁশিয়ারি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ