X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

ভোঁতা হয়ে গেছে মানবতাবোধ

মোস্তফা হোসেইন
১১ মার্চ ২০২৩, ১৩:৫৬আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৩, ১৩:৫৬

ঝড়-তুফান আর বন্যায় হাজারো মানুষের দুর্ভোগের চিত্র বাংলাদেশের সঙ্গে ছায়ার মতোই লেপ্টে ছিল। কালবোশেখী ঝড়, বর্ষায় নদীর ভাঙন কিংবা বন্যার তোড়ে ভেসে যাওয়া বাড়িঘর; সঙ্গে হয়তো নারী কিংবা শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণের সংবাদ ছিল অতি মামুলি ঘটনা। লক্ষণীয় যে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অবস্থা পরিবর্তন হতে থাকে। না, কোনও ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান কারও কৃপা কিংবা দয়ায় নয়। প্রকৃতিরই দান এটা।  আগের মতো অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, কালবৈশাখী কিংবা বন্যায় ওইভাবে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয় না।

তবে মানবসৃষ্ট দুর্যোগে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। ক্ষতি হচ্ছে সম্পদের। একইসঙ্গে মানুষের বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে সংস্কৃতি সেটাও যেন বিলুপ্ত হতে চলেছে। গত ৫০ বছরে সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখেছি ১৯৮৮ সালে। সে কী দুর্বিসহ চিত্র। গোটা বাংলাদেশই যেন বাণের পানিতে ভাসতে শুরু করেছিলো। রাজধানীর সড়কগুলো দখল করেছিলো দেশীয় নৌকা। কোথাও হাঁটু সমান পানি, কোথাও গলা সমান পানি। গ্রামবাংলার অবস্থাতো সহজেই অনুমান করা যায়। বঙ্গোপসাগরটাই যেন গিলে খেয়েছিলো গোটা দেশটাকে।

মহাপ্রলয় যেন আক্রমণ করেছিলো এই দেশে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে আক্রান্ত হয়েছিলো সেই বন্যায়। তবে লক্ষ্যণীয় ছিল আরেকটি বিষয়– তা হচ্ছে, মানুষের মধ্যে যে মানবতা আছে– তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো সেই সময়। গলির মুখে কোথাও একটু শুকনো জায়গা থাকলে সেখানে শুকনো খাবারের স্তুপ, কোথাও ভ্যানগাড়ি দাঁড় করিয়ে তার ওপর পুরনো কাপড়, দিয়াশলাই, শুকনো খাবার, খাওয়ার পানির জাড় এমনি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য জড়ো করা থাকতো দুর্গতদের সহযোগিতার জন্য। মহল্লার তরুণরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য প্রার্থণা করতো দুর্গতদের জন্য। ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে নৌকা কিংবা লঞ্চে করে রওনা হতো শহরের বাইরে– কোনও গ্রামে।

রাজনৈতিক নেতাদের দেখা যেত নিজ নিজ এলাকায় দিনরাত ত্রাণ নিয়ে ঘুরছেন। পাড়ার ক্লাবগুলো সরব হয়ে ওঠতো ত্রাণ বিতরণ সংশ্লিষ্ট কাজে। একবারে ঝুঁকিমুক্ত ছিল না সেসব কাজ। মনে আছে ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় ঢাকার কাঁঠালবাগান এলাকার এক তরুণ চিকিৎসক মানিকগঞ্জে বন্যার্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে নৌ-দুর্ঘটনায় নিজের জীবনটা হারিয়েছিলেন। এমন ঘটনা পুরো দেশেই কোথাও না কোথাও ঘটছে এমন সংবাদও চোখে পড়তো পত্রিকার পাতায়। কিন্তু তারপরও মানুষ সেখানে যেত, দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতো। তবে সবখানেই জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত।

আগের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বড় ধরনের ধাক্কা না দিলেও মানবসৃষ্ট দুর্যোগগুলোতে ক্ষতি কিন্তু কম নয়। সম্পদহানীর পাশাপাশি প্রাণহানীও ঘটছে।

সাম্প্রতিক দুর্যোগগুলোতে এর ব্যতিক্রম ঘটতে শুরু করেছে। কোনও দুর্যোগ ঘটলে সেখানে জনপ্রতিনিধিরা যেতে চান না কিংবা আদৌ যাওয়া প্রয়োজনও বোধ করেন কিনা সন্দেহ আছে।

সম্প্রতি বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন লিমিটেড কারখানায় ৬ জন মানুষ প্রাণ হারায়, আহত হয় প্রায় অর্ধশত মানুষ। কারখানা এলাকার প্রায় এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছিটকে পড়ে লোহার পাত কিংবা এমন শক্ত সামগ্রী। ঘটনার দ্বিতীয় দিনে এই নিবন্ধ লেখার কালেও স্থানীয় এমপি কিংবা ওই মাপের কোনও জনপ্রতিনিধি  গিয়েছেন এমন কোনও সংবাদ চোখে পড়েনি।

সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনার পরপর আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায়। এসি বিস্ফোরণের কারণে দেয়াল ধসে পড়েছে ওখানে। তাৎক্ষণিক নিহতের খবর হয়েছে তিন জনের। আহত অর্ধশত। যে দুর্ঘটনার সংবাদ সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে টেলিভিশনগুলোতে।  টেলিভিশনের সংবাদে আগুনের ছবি, আহতদের আর্তনাদ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের মন্তব্য দেখা গেলেও সেখানে কোনও জনপ্রতিনিধিকে দেখা যায়নি কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও।  

দুর্ঘটনা কি সিরিজ আকারে ঘটতে শুরু করেছে? সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার বিস্ফোরণের পরদিন মঙ্গলবার পুরান ঢাকার ছিদ্দিকবাজারে  আবারও বিস্ফোরণ। অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে ওই ঘটনায় মৃতের সংখ্যা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেড়ে গেছে। ভয়াবহ এই ঘটনাগুলোর পরিসমাপ্তি হোক। এমন প্রত্যাশা করি।

বস্তি এলাকায় অগ্নিকাণ্ড হলে মাঝে মাঝে জনপ্রতিনিধির উপস্থিতি দেখা যায়। জনগণের বিশেষ করে তরুণ সমাজের যে মানবকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড সেগুলো এখন নেই বললেই চলে। শুধু কি অগ্নিকাণ্ড, ভবনধস, নদীভাঙন কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেই মানুষের এগিয়ে আসা কমেছে? একটা মানুষ রাস্তায় দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে কাতরাচ্ছে, পাশে দিয়ে মানুষ হেঁটে চলে যায়, কেউ ফিরেও তাকায় না। গভীর রাতে হয়তো ২/৩ জন ডাকাত দেশীয় অস্ত্র নিয়ে একটা গাড়িতে ডাকাতি করছে, পাশে দিয়ে একের পর যাত্রী বোঝাই বাস চলে যাচ্ছে, হয়তো বাসের যাত্রীরা চিৎকার করলেই ডাকাতরা পালিয়ে যেতো। কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না।

মানুষের পাশে দাঁড়ানোকে কেউ সামাজিক দায়িত্ব বলেই মনে করছে না। আত্মকেন্দ্রিক হতে হতে কোন পর্যায়ে পৌঁছালে এমনটা হতে পারে ভাবতে গেলেও অবাক লাগে। সামাজিক অবক্ষয়ের উদাহরণ কি এগুলো?

প্রশ্ন আসতেই পারে, মানুষের এতটা আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার পেছনে কারণ কী? কেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষের বিপদে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না? আমি কোনও সমাজবিজ্ঞানী নই কিন্তু সমাজের একজন হিসেবে খুব চোখে পড়ে একটু একটু করে গোটা সমাজই সমাজকে ভেঙে নতুন দিকে যাত্রা করেছে। আর এই যাত্রার শেষ যে কোথায় কারো জানা নেই।

বিজ্ঞজনদের বিষয়টি নিয়ে ভাবা  খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কে কখন বিপদের মুখে পড়ি ঠিক নেই। আমি যদি মানুষের জন্য এগিয়ে না যাই মানুষও যে আমার  বিপদে এগিয়ে আসবে না। এটা যে প্রকৃতিরই নিয়ম। সেই বোধটুকু সবার মনে জাগুক।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধর্ষণের পর শিশুকে হত্যা, জড়িতদের গ্রেফতারে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম
ধর্ষণের পর শিশুকে হত্যা, জড়িতদের গ্রেফতারে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম
খালেদা জিয়াকে আজ আবার হাসপাতালে নেওয়া হবে
খালেদা জিয়াকে আজ আবার হাসপাতালে নেওয়া হবে
বেড়েছে রাবার উৎপাদন, আয় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা
হলদিয়া রাবার বাগানবেড়েছে রাবার উৎপাদন, আয় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা
টিভিতে আজকের খেলা (১ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১ মে, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ