X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

রুচির দুর্ভিক্ষ: কার দায় কতটুকু

রেজানুর রহমান
০২ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:৫০আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:৫০

রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। শ্রদ্ধেয় নাট্যজন মামুনুর রশীদের একটি বক্তব্যকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ প্রচারমাধ্যমে এ নিয়ে বেশ তোলপাড় চলছে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম মামুনুর রশীদের সঙ্গে হিরো আলমের একই মাপের ছবি জুড়ে দিয়ে দেশের অনেক জনপ্রিয় দৈনিকেও খবর ছাপা হয়েছে এবং হচ্ছে। মামুনুর রশীদের সঙ্গে হিরো আলমের একই মাপের ছবি? তার মানে আমরা কি জাজমেন্ট দিয়ে ফেলেছি যে মামুনুর রশীদও যা, হিরো আলমও তাই! যদি তাই হয় তাহলে রুচির এই দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যাবে না। এখানেই আমার প্রশ্ন। অনেক শঙ্কা। অনেক উৎকণ্ঠা।

অনেকে হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, হিরো আলমরা এগিয়ে গেলে কার কী ক্ষতি? হিরো আলম তো এই দেশেরই নাগরিক। কাজেই তাকে এগিয়ে যেতে দিতে বাধা কোথায়? আমি এই কথার সঙ্গে পুরোপুরি একমত। আমিও চাই হিরো আলমরা এগিয়ে যাক। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা কী? আমরা কি মেধাবী মানুষ চাই নাকি মেধাহীন? ধরা যাক এই মুহূর্তে একটি স্লোগান উঠলো– আমরা সবাই হিরো আলম হবো। হিরোর মতো এগিয়ে যাবো... যে দিকে তাকাই শুধুই হিরো আলম। গানে হিরো আলম, নাচে হিরো আলম, শিক্ষায় হিরো আলম, রাজনীতিতেও হিরো আলম, নাটক সিনেমায়ও হিরো আলম। ঢাকার মঞ্চ নাটকেও হিরো আলমদের রাজত্ব। কেমন হবে ব্যাপারটা? তার মানে মামুনুর রশীদের কোনও প্রয়োজন নেই? কী ভয়ানক পরিস্থিতি? রুচির কি মারাত্মক পরিণতি? মামুনুর রশীদদের সঙ্গে হিরো আলমের তুলনা? একজন মামুনুর রশীদ কে? এই দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতিতে তাঁর যে অবদান আমরা কি বেমালুম তা ভুলে যাচ্ছি? আবারও বলি হিরো আলমের প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ নাই। রুচির দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে শুধু তাকেই অপরাধী ভাবলে ঠিক হবে না। কিন্তু মামুনুর রশীদের সঙ্গে হিরো আলমকেও এক পাল্লায় দাঁড় করাবো, এটা কতটা শোভন?

এ কথা সত্য, হিরো আলম বেশ জনপ্রিয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তিনি সুচতুরভাবে ব্যবহার করেছেন এবং করছেন। তথ্য বলছে, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ওপরে। মোবাইল ফোন যেন খেলনার মতো। যার দরকার নেই তার হাতেও দামি মোবাইল ফোন। কয়েক দিন আগে ঢাকার বাইরে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে কয়েকশ’ দর্শক উপস্থিত। তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। শতকরা ৭০-৮০ জনের হাতে দামি মোবাইল ফোন। অনুষ্ঠান শেষে একজন তরুণ আমার সঙ্গে ছবি তুলবে বলে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলাম– কী করো?

মৃদু হেসে বললো, কিছু করি না।

লেখাপড়া?

ম্যাট্রিক।

আর পড়ো নাই কেন?

এবার কোনও উত্তর দিলো না। তার হাতের মোবাইল ফোন দেখে জিজ্ঞেস করলাম– অনেক দামি ফোন? তুমি কিনেছো?

না। বাবা কিনে দিয়েছে।

এত দামি ফোন দিয়ে কী করো?

আবারও মৃদু হেসে বললো, কথা বলি। অনুষ্ঠান দেখি।

কার সঙ্গে কথা বলো?

এই... বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে...

তোমার বাবা বুঝি অনেক বড়লোক...

মৃদু হেসেই বললো– হ্যাঁ।

তোমার বাবা কি তোমাকে এমনি এমনিই একটা দামি মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছেন, নাকি তুমি তাকে প্রেসার দিয়েছো?

এবার সে একটু ভাবলো, কিন্তু কিছু বললো না।

জিজ্ঞেস করলাম– তার মানে তুমি আবদার করেছো। তাই বাবা ফোন কিনে দিয়েছেন।

হ্যাঁ।

তুমি যে বললে মোবাইলে অনুষ্ঠান দেখো, কী অনুষ্ঠান দেখো?

কত অনুষ্ঠান। নাটক দেখি। সিনেমা দেখি। টকশো দেখি। যে অনুষ্ঠান বেশি ভাইরাল হয় সেটাই দেখি...

ভাইরাল অনুষ্ঠান মানে?

বুঝলেন না। আপনি ফেসবুকে একটা গান গাইলেন। সেটা ভাইরাল হয়ে গেলো। সেটা দেখি।

সারা দিনই কি মোবাইল ফোন নিয়েই থাকো?

এবার সে কিছু বললো না। তবে ভাবে বোঝা গেলো সারাক্ষণ মোবাইল নিয়েই থাকে।

ছেলেটির ব্যাপারে আমার কৌতূহল বেড়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলাম– টিভি দেখো?

না। টিভি দেখা লাগে না। সবই তো মোবাইলে আছে...

পত্রিকা পড়ো? দৈনিক পত্রিকা?

পত্রিকাও তো পড়া লাগে না। সবই তো এই মোবাইল ফোনে আছে।

গান শোনো?

হ্যাঁ মোবাইলে?

কী ধরনের গান? দেশের না বিদেশের?

বিদেশি গানই বেশি শুনি...

দেশের গানে সমস্যা কী?

কোনও সমস্যা নেই। তবে দেশের গানে মজা পাই না। সিনেমা দেখো...

হ্যাঁ, দিনে অন্তত একটা?

বাংলাদেশের সিনেমা?

না। হিন্দি...

বাংলা সিনেমা দেখো না কেন?

দেখি তো... হাওয়া দেখেছি। পরাণ, দামাল দেখেছি...

আর কী কী দেখো...

বললাম না... আরও অনেক কিছু দেখি...

বাংলাদেশের ৫ জন জনপ্রিয় মানুষের নাম বলতে পারবে? আমার প্রশ্ন বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকালো। বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম–

জনপ্রিয় মানে বোঝো নাই? এই যে তুমি সারাক্ষণ ফেসবুকে থাকো, কাকে তোমার বেশি ভালো লাগে? এমন ৫ জন মানুষের নাম বলো?

প্রথম সে আমাদের ক্রিকেট অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের নাম বললো। তারপর একজন ধর্মীয় বক্তার নাম বললো।

জিজ্ঞেস করলাম– তুমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ো?

না। বিব্রত কণ্ঠে উত্তর দিলো।

তবে যে ধর্মীয় বক্তার নাম বললে?

এবার সে বেশ লজ্জা পেয়েছে ভাব দেখিয়ে বললো– হুজুরের ওয়াজ ভালো লাগে। অনেক কৌতুক বলেন। মেয়েদের নিয়ে কথা বলেন... শুনতে ভালো লাগে।

মেয়েদের নিয়ে কথা বলেন মানে?

ছেলেটি এই প্রশ্ন শুনে কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো– স্যার আমি যাই...

যাই মানে? দাঁড়াও, তোমার সঙ্গে কথা বলি। কথা তো শেষ হয় নাই। এরমধ্যে আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছে কিছু লোক। তরুণ, বৃদ্ধ, কিশোর, সব বয়সী লোক। সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছে। ছেলেটিকে বললাম– ৫ জনের মধ্যে মাত্র দুজনের নাম শুনলাম– বাকি তিন জন...

সে এবার যেন সত্যি সত্যি বিপদে পড়ে গেছে। মনে হলো তার কাছে আর কোনও জনপ্রিয় লোক নেই। কী মারাত্মক অবস্থা? দেশের একজন তরুণ ৫ জন গুণী মানুষের নাম বলতে পারে না? হঠাৎ ছেলেটি লটারির টিকিট পাওয়ার মতো খুশিতে প্রায় চেঁচিয়ে বললো– আরেকজনের নাম মনে পড়েছে। হিরো আলম...

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম– কার নাম বললে?

হিরো আলম।

হিরো আলমকে তোমার পছন্দ?

হ্যাঁ। সে বেশ ভাইরাল?

ভাইরাল বলেই পছন্দ?

হ্যাঁ। তার কথাবার্তা, অভিনয় ‘ক্ষ্যাত’ টাইপের। তবু ভালো লাগে। মনে করেন, তার শিক্ষাদীক্ষা নাই। একলাই শিক্ষিত মানুষদের সঙ্গে ফাইট দিতেছে। এই ব্যাপারটা আমার বেশ ভালো লাগে।

সেদিন ছেলেটির সঙ্গে আর কথা বাড়াইনি। ঢাকায় ফেরার পথে বারবার তার কথা ভেবেছি। শিক্ষিত মানুষদের সঙ্গে অশিক্ষিত মানুষ ফাইট দিতেছে। কী সাবলীল স্বীকারোক্তি? রুচির দুর্ভিক্ষ তো এখানেই স্পষ্ট। শিক্ষিত মানুষের বিরুদ্ধে অশিক্ষিত মানুষের লড়াই। এর ব্যাখ্যা কী আমি ঠিক জানি না। আমরা হয়তো অনেকেই অস্বীকার করবো। তবে এটা সত্য, আমি যে তরুণের কথা বললাম তার মতো তরুণের সংখ্যাই দেশে প্রতিদিন বেড়েই চলছে। মোবাইল ফোন এদের সঙ্গী। ফেসবুকে অখাদ্য কুরুচিপূর্ণ, অনৈতিক, অশ্লীল, অশোভন, বিতর্কিত ভাইরাল বিষয়ই এদের আগ্রহের বিষয়। এরা ফেসবুকে খায়, ফেসবুকে ঘুমায়, ফেসবুকেই সংস্কৃতি চর্চা করে। বড়দের প্রতি এদের সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভক্তি নেই বললেই চলে। এখন প্রশ্ন হলো– এটা কি দোষের কিছু? যদি তারা দোষ করেই থাকে অথবা দোষ করেই যাচ্ছে, তাহলে এদের ফেরাবে কে?

শ্রদ্ধেয় মামুনুর রশীদ সত্যিকার অর্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি হিরো আলমের নাম বলেছেন। তারপর থেকে যে ঘটনাগুলো ঘটলো এবং অব্যাহত গতিতে ঘটেই যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে রুচির দুর্ভিক্ষের প্রশ্নে দোষারোপের রাজনীতি শুরু হয়েছে। এতে লাভবান হচ্ছেন হিরো আলম। কারণ, মামুনুর রশীদ তার সম্পর্কে মন্তব্য করায় তিনি এখন শীর্ষ ভাইরাল তারকায় পরিণত হয়েছেন। অনেকে মন্তব্য করছেন, মামুনুর রশীদ স্বয়ং হিরো আলমকে ভাইরাল তারকা হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই পক্ষটি আরও ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তারা বলতে চাইছেন রুচির দুর্ভিক্ষের প্রশ্নে শুধু কি হিরো আলমই দায়ী। আমাদের নাটক, সিনেমার অনেক জনপ্রিয় তারকাও কি এর জন্য দায়ী নন? দেশের একজন জনপ্রিয় নারী তারকা, যিনি বাংলাদেশ ও ভারতে সমান জনপ্রিয়, তার বুকখোলা সিরিজ ছবির প্রতি ইঙ্গিত করেও অনেক বলছেন, জনপ্রিয় ওই নারী তারকার বুক দেখানো এই ছবি কি রুচির দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী নয়? আমাদের টিভি নাটকে অনেক জনপ্রিয় তারকার মুখে কুরুচিপূর্ণ অশোভন সংলাপের প্রতিও অনেকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, এসব নিয়ে কেন কথা ওঠে না? ইদানীং অনেক টেলিভিশন নাটক, বিশেষ করে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আধুনিকতার নামে এমন কিছু দৃশ্য ও সংলাপ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, যা পারিবারিকভাবে দেখতে বসলে বিব্রত হতে হয়। এটা কি রুচির দুর্ভিক্ষ নয়?

লেখাটি শেষ করি। তার আগে আমাদের নাটক, সিনেমার দুটি দৃশ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। একটি আমাদের দেশের টিভি নাটক।

অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাম উল্লেখ করছি না। গোপন অভিসারে এসেছেন তারা। ছেলেটি লম্বা। মেয়েটি ছেলেটির তুলনায় একটু খাটো। মেয়েটি ছেলেটির দুই পায়ের ওপর নিজের দুই পা তুলে দিয়ে সমান হওয়ার চেষ্টা করলো। হঠাৎ মেয়েটি ছেলেটিকে ধাক্কা দিয়ে রেগে বললো– তুমি তো দেখি টিপতেও জানো না? এভাবে টেপে?

পরের দৃশ্যটি পাশের দেশের একটি সিনেমার। তরুণ দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদ হয়েছে। তাদের একমাত্র সন্তান কার কাছে থাকবে তাই নিয়ে লড়াই শুরু। স্ত্রীকে তার পরামর্শকারী কী পরামর্শ দিচ্ছেন আসুন একবার শুনি...

পরামর্শকারী: গ্লাস আপনার, পানি আপনার, চিনিও আপনার। এক ফোঁটা লেবুর রস দিলো আর শরবত ওনার?

স্ত্রী: আমারও তো একই কথা।

পরামর্শকারী: সোজা হিসাব। বাচ্চা আপনার।

এবার আসুন দেখি স্বামী সঙ্গে তার পরামর্শকারীর কথাগুলো কেমন ছিল?

পরামর্শকারী: শোনেন, এটিএমে কার্ড মেশিনে ঢুকিয়ে টাকা বের করলে টাকা কার? মেশিনের না মালিকের?

স্বামী: অবশ্যই মালিকের।

পরামর্শকারী: সেটাই তো... সোজা হিসাব বাচ্চা আপনার?

জানি না নাটক, সিনেমার এসব দৃশ্য রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে কিনা?

সেই তরুণের কথাটি আরেকবার উল্লেখ করতে চাই– শিক্ষিত মানুষের বিরুদ্ধে অশিক্ষিত মানুষের লড়াই চলছে। কী ভয়াবহ পরিস্থিতি। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৮ এপ্রিল, ২০২৪)
সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর: শেখ হাসিনা
সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর: শেখ হাসিনা
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ