X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ওরা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল!

রেজানুর রহমান
০২ মে ২০২৩, ১৬:০৩আপডেট : ০২ মে ২০২৩, ১৬:০৩

এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে সকাল ১০টায়। একঘণ্টা পর দুই পরীক্ষার্থী হন্তদন্ত হয়ে কেন্দ্রে হাজির। ততক্ষণে পরীক্ষার নৈর্ব্যক্তিক অংশের সময় শেষ হয়েছে। কাজেই তাদের পরীক্ষার হলে ঢুকতে দেওয়া হলো না। তারা ছুটে গেলো ইউএনও কার্যালয়ে। ইউএনও মহোদয় তার কক্ষে ছিলেন না বিধায় তার সঙ্গে দুই পরীক্ষার্থীর দেখা হলো না। এবার কী করবে ওই দুই পরীক্ষার্থী? ১৫ বছরের জীবন। সহজেই আবেগ নিয়ন্ত্রণের বয়স নয়। দুজনই সিদ্ধান্ত নেয় এই জীবন আর রাখবে না। রাস্তায় গাড়ির সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবে। সেটা করতেও গিয়েছিল তারা। কথায় আছে ‘রাখে আল্লাহ মারে কে?’ একজন সংবাদকর্মী শুরু থেকেই ঘটনাটা অনুসরণ করছিলেন। তার আন্তরিক বুদ্ধিমত্তায় ওই দুই পরীক্ষার্থীকে আত্মহত্যার পথ থেকে ফেরানো গেছে। এটি কিশোরগঞ্জের ভৈরবের একটি পরীক্ষা কেন্দ্রের ঘটনা। পরীক্ষার্থী দুজনের নাম রোমান আহমেদ ও তিশা আক্তার। রোমান ভৈরব পৌর এলাকার হাজী ইউসুফ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। তিশা ভৈরব এমপি গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী।

খুবই ছোট ঘটনা। বোধকরি সে কারণেই প্রচারমাধ্যমে তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। তবে এটা সত্য, ওই দুই পরীক্ষার্থী যদি আত্মহত্যা করতো তাহলে এটি জাতীয় সংবাদে পরিণত হতো। ‘ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ’। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমের বন্ধুরা দলবেঁধে ছুটে যেতেন দুই পরীক্ষার্থীর স্কুলে, তাদের বাড়িতে। কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেন পরীক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রধান ব্যক্তিকে। মানবিক সংবাদও তৈরি হতো। না হয় একটু দেরিতেই পরীক্ষার্থী দুজন কেন্দ্রে হাজির হয়েছিল। তাদের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ কি দেওয়া যেত না? এমন প্রশ্নের উত্তরও খোঁজা হতো। যেহেতু প্রাণ যায়নি কাজেই বিষয়টি নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি কোথাও।

তবে বিষয়টি অনেকের কাছে গুরুত্বহীন হলেও আলোচনার দাবি রাখে। প্রথম প্রশ্ন হলো, এসএসসি পরীক্ষা একজন শিক্ষার্থীর জীবনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দশ বছরের শিক্ষা শেষে বোর্ডের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া যায়। সংগত কারণেই শুধু শিক্ষার্থীই নয়, তার বা তাদের অভিভাবকদের মধ্যেও একটা টেনশন কাজ করে। অনেক শিক্ষার্থীর রাতে ভালো করে ঘুমও হয় না। পরীক্ষার প্রবেশপত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা, কোথায় পরীক্ষা হবে তা আগের দিন দেখে আসা এই কাজগুলো শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকরাও করে থাকেন। কাজেই প্রশ্ন হলো, উল্লেখিত দুই পরীক্ষার্থী কেন জানলো না পরীক্ষা সকাল ১০টায় শুরু হবে? তাদের বাবা-মায়েরাই বা কেন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেন না। এসএসসি পরীক্ষা সন্তানের শিক্ষাজীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা। যার ভালো-মন্দে নির্ভর করে সন্তানের ভবিষ্যৎ। অথচ এ ব্যাপারে অভিভাবকের কোনও দায়-দায়িত্ব নেই? আমাদের সময় দেখেছি বোর্ডের যেকোনও পরীক্ষার আগে মূলত বাবা-মায়েরাই অস্থির হয়ে উঠতেন। কোথায় পরীক্ষা হবে, কখন পরীক্ষা শুরু হবে আগেই জেনে আসতেন। পরীক্ষার আগের দিনের রাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষার্থীর পাশাপাশি অনেক অভিভাবকও জেগে থাকতেন সারা রাত। পরীক্ষার প্রবেশপত্র গুছিয়ে রাখা, কোন কলমে পরীক্ষার খাতায় লিখবে প্রিয় সন্তান, কেন্দ্রের দূরত্ব অনুযায়ী বাসাবাড়ি থেকে কখন রওনা দিতে হবে, এসব আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হতো।

আমার ছোট্ট প্রশ্ন উল্লেখিত দুই পরীক্ষার্থীর অভিভাবক ও তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি। অন্যান্য অভিভাবক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের প্রতিও প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক। এই যে দুজন শিক্ষার্থী তাদের পরীক্ষার রুটিন সম্পর্কে ভালোভাবে জানলো না, এর দায় কার? শুধুই শিক্ষার্থীদ্বয়ের? এক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কি কোনোই দায়-দায়িত্ব নেই? এবার দেশের সব শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের আওতায় ২০ লাখ পরীক্ষার্থীর অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও প্রথম দিনেই সারা দেশে সাড়ে ৩১ হাজার পরীক্ষার্থী পরীক্ষার হলে আসেনি। অর্থাৎ ৩১ হাজার শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। হয়তো তারা আর পড়াশোনার মধ্যেই নেই। কেন এই ছাত্রছাত্রীরা ঝড়ে পড়লো? কী তাদের সমস্যা? এসব বিষয়ে আমরা কি আদৌ জানি? নির্ধারিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কি আদৌ খোঁজ নিয়েছে কেন পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার হলে এলো না? একটি সূত্রের মতে, ঝরে পড়া ৩১ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। হয় অভাবের তাড়নায় অথবা বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েরা আর পড়াশোনায় নিয়মিত হতে পারেনি। বাল্যবিবাহই যদি মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার মূল কারণ হয় তাহলে এ ব্যাপারেও আছে কি সামাজিক কোনও উদ্যোগ? নাকি আমরা সেই দুই অলস ব্যক্তির জীবনের গল্পের মতো দেখি না কি হয়- এই মানসিকতায় ঘটনা দেখার মধ্যেই রয়েছি? সম্প্রতি জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল ইউএনএফপিএ’র এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। এই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সহজেই অনুমান করা যায়, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাই। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে মালদ্বীপে। মাত্র ২ শতাংশ। শ্রীলংকায় ১০, পাকিস্তানে ১৮, ভারতে ২৩, ভুটানে ২৬, আফগানিস্তানে ২৮, নেপালে ৩৩ শতাংশ বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে।

এসএসসি পরীক্ষার কথায় আসি। এই লেখায় স্থান পাওয়া দুই শিক্ষার্থী একটি উদাহরণ মাত্র। অভিভাবক সচেতন থাকলে নিশ্চয়ই তারা পরীক্ষার হলে বসতে পারতো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে ইদানীং পারিবারিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। অনেকেই ছেলেমেয়ে অর্থাৎ সন্তানদের তেমন খোঁজ-খবর রাখেন না। ছেলেমেয়ের আবদার মেটাতে অনেকেই তাদের হাতে দামি মোবাইল ফোন তুলে দিয়েছেন। ফলে ক্লাসের পড়াশোনার চেয়ে মোবাইল ফোনেই ব্যস্ত সময় কাটায় অনেক শিক্ষার্থী। খাবার টেবিল হলো পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার শ্রেষ্ঠ জায়গা। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক পরিবারে খাবার টেবিলে সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যায় না। একসময় প্রতিটি পরিবারে ড্রয়িংরুম ছিল পারিবারিক বিষয় নিয়ে আলোচনার শ্রেষ্ঠ জায়গা। একটি টেলিভিশন সেট ছিল সবার প্রিয়। ড্রয়িংরুমে বসে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে ফাঁকে ফাঁকে পারিবারিক নানা বিষয়ে আলোচনা হতো। এখন ড্রয়িংরুম বলতে গেলে ফাঁকা পড়ে থাকে। সবার হাতেই মোবাইল ফোনে এখন শুধু টেলিভিশন অনুষ্ঠান নয়, আরও নানান মাধ্যমের অনুষ্ঠান দেখার অবারিত সুযোগ। ফলে পারিবারের মানুষগুলো বড্ড বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ভৈরবের দুই শিক্ষার্থী এই বাস্তবতারই শিকার।

ওই দুই শিক্ষার্থী প্রসঙ্গক্রমে তাদের বন্ধুদের কথা বলেছে। বন্ধুরা নাকি জানিয়েছিল পরীক্ষা সকালে নয় বিকালে হবে। তারা কেমন বন্ধু যে ভুল তথ্য দিলো? কাজেই প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তোমাদের সচেতন হতে হবে। আমি যদি বন্ধুর কথা বিশ্বাসই করতে না পারি তাহলে সে বা তারা প্রকৃত বন্ধু নয়। কাজেই বন্ধু খুঁজে নেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই সচেতন থাকতে হবে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সফল মানুষের জীবনে কোনও না কোনোভাবে বন্ধুর ভূমিকাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে কথায় বলে– যার বন্ধুভাগ্য ভালো সেই জীবনে সবচেয়ে সুখী।

তারুণ্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ধাপে ধাপে অনেক পরীক্ষা আসবে জীবনে। অন্যের কথায় নয়, নিজের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে পরীক্ষার মুখোমুখি হন, যদি পরাজিতও হন তাহলেও একটা সান্ত্বনা থাকবে। অন্যের কথায় কান দেবেন না। অন্যের কথায় কান দিলে কী হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ তো দুই পরীক্ষার্থীর বন্ধুরা। ওরা কি আদৌ বন্ধু?

লেখক: কথাসাহিত্যিক নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
বিপুল পরিমাণ নকল জুস জব্দ, কারখানার মালিকের কারাদণ্ড
বিপুল পরিমাণ নকল জুস জব্দ, কারখানার মালিকের কারাদণ্ড
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ