রাজধানীর গ্রিন রোড এলাকার ফুটপাতে প্রতিদিন কয়েকজন বিক্রেতা মাছ নিয়ে বসেন। বুধবার (১০ মে) সকালে একজনের ডালায় মাঝারি আকারের দেশি চিংড়ি দেখে দাম জিজ্ঞেস করি। বিক্রেতা বললেন, ১৪০০ টাকা। পাশ থেকে একজন ক্রেতা কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘দুই হাজার চাইতেন!’ দোকানি রসিকতা করে বললেন, ‘দুই হাজারেই খাইবেন।’
প্রশ্ন হলো, নদী-খাল-বিল-জলাশয়ের দেশে, মাছের দেশে মাঝারি আকারের এক কেজি দেশি চিংড়ি কেন দেড় হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, দেড় হাজার টাকা যে হলো এবং ওই দোকানির ভাষ্য অনুযায়ী যদি দুই হাজার টাকাও হয়ে যায়, তারপরও কোনও চিংড়ি কি অবিক্রীত থাকবে? তৃতীয় প্রশ্ন, ফুটপাতের ডালায় যে মাছের দাম দেড় হাজার, সুপার শপে তার দাম কত এবং সেখানেও কি কোনও মাছ অবিক্রীত থাকে?
গ্রিন রোডের ওই দোকানির কথায় দুটি বার্তা আছে। ১. মাছের দাম বাড়তে বাড়তে হয়তো দুই হাজার টাকাই হবে এবং ২. যদি দাম এরকম হয়ও, তারপরও আপনি ‘খাইবেন’। মানে আপনি না কিনলেও কেনার লোকের অভাব হবে না।
বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো এই বৈষম্য। অর্থাৎ যে জিনিস একজন স্বল্প আয়ের বা মধ্য আয়ের লোকেরও ক্রয়সীমার বাইরে, সেই একই জিনিস মুহূর্তেই আরেকজন ক্রেতা এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যান। যার কাছে দাম কোনও বিষয় নয়। যিনি যেকোনও দামেই পছন্দের পণ্যটি কিনতে চান।
গ্রিন রোডের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে অদূরেই দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি পণ্যের বাজার কারওয়ান বাজারে যাই। বলা হয়, রাজধানীর অন্য বাজার, বিশেষ করে পাড়া-মহল্লার বাজারের চেয়ে এখানে সবজি, ফল ও মাছের দাম ২০-৩০ শতাংশ কম। কোনও কোনও পণ্যের দাম ভরা মৌসুমে আরও কম। বিশেষ করে একসঙ্গে বেশি পরিমাণে কিনলে।
যেমন, রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাজারে যখন সজনের কেজি ২০০ টাকা, তখন কারওয়ান বাজারে এটির কেজি ১০০ টাকার কম থাকে। কিন্তু এখন সেই পার্থক্যটিও নেই। অবাক ব্যাপার হলো, পাড়া-মহল্লার বাজারের সঙ্গেও এখন কারওয়ান বাজারের দামের পার্থক্য খুব একটা নেই। কারণ কী এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ কে করে বা আদৌ বাজার নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু আছে কি না?
এই বাজারে সবজি কিনতে গিয়ে দেখা গেলো, ৬০ টাকার নিচে কোনও সবজি নেই। এক কেজি ধুন্দল ও ঝিঙে ৮০ টাকা। একটা মাঝারি সাইজের মিষ্টি কুমড়া ৮০ টাকা। ছোট আকারের চালকুমড়া ৭০ টাকা। অথচ অন্য সময়ে এই কুমড়ার দাম এই বাজারে বড়জোর ৩০ টাকা।
বাজারে সবজির আমদানি কম নেই। প্রচুর সবজি। কিন্তু দাম নিয়ে দেখা গেলো বিক্রেতারাও বিরক্ত। কারণ তারাও ভোক্তা। বললেন, আড়তে রেট বেশি। আড়তদার বলেন, খরচা বেড়েছে। কোথায় খরচা বেড়েছে? যে ঝিঙে কারওয়ান বাজারে ৮০ টাকা, কৃষক কেজিতে কত টাকা পেয়েছেন? ২০ টাকার বেশি? বাজারটা তাহলে কে নিয়ন্ত্রণ করে? চারিদিকে শুধু অজুহাত আর উসিলা!
এটা ঠিক যে, কোনও কিছুর দাম বাড়ার জন্য একটির সঙ্গে আরেকটি যোগসূত্র থাকে। আন্তর্জাতিক বাজার ও পরিস্থিতিও সেখানে অনেক সময় ভূমিকা রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে সবজির দামের সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কি কোনও সম্পর্ক আছে? এই মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অস্থির নয়। এমন নয় যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকের ফলন বিপর্যয় হয়েছে। তাহলে বাজারে ৫০-৬০ টাকার নিচে কোনও সবজি মিলছে না কেন?
শুধু ঢাকায় নয়, জেলা-উপজেলা শহরের বাজারেও সবজির দাম নিয়ে মানুষ বিরক্ত। ফেসবুকে ফয়সাল আলম নামে একজন লিখেছেন, তিনি নরসিংদীর পলাশ উপজেলার একটি বাজার থেকে কাঁকরোল ৮০ টাকা, কাঁচামরিচ ২০০ টাকা, ঝিঙে ৮০ টাকা এবং পেঁয়াজ ৭৫ টাকা কেজি দরে কিনেছেন। দেখা যাচ্ছে, ঢাকার কারওয়ান বাজারের সঙ্গে এই বাজারের কোনও পার্থক্য নেই। এটা কী করে সম্ভব? এর কারণ কী? উৎপাদন কম হয়েছে নাকি উৎপাদনের খরচ বেড়েছে?
এই অভিযোগ বেশ পুরনো যে, গ্রাম থেকে এক ট্রাক সবজি ঢাকার বাজারে আসতে আসতে পথে পথে নানা জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। তার সঙ্গে আছে শক্তিশালী বাজার সিন্ডিকেট। তারাই দাম নিয়ন্ত্রণ করে। প্রশ্ন হলো, এই চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কি আদৌ কাজ করছে বা করতে পারছে?
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি সংস্থার বাজার মনিটরিং টিম কাজ করলেও তাতে সুফল আসে না। অভিযোগ আছে, মনিটরিং টিমগুলো বাজারের পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ না করে বাজারে যায়। আবার বাজারে প্রবেশের আগে বাজার সমিতি ও চেম্বারগুলোকে অবহিত করা হয়। বাজার সমিতি ব্যবসায়ীদের আগে থেকেই সতর্ক করে দেন। ফলে মনিটরিং টিম বাজারে গিয়ে কোনও ত্রুটি পায় না। আবার স্বল্প সময়ে বাজারে অবস্থান করে অনিয়ম বের করা কঠিন। যে কারণে বাজার মনিটরিং টিম চলে যাওয়ার পরই বাজার আগের অবস্থানে চলে যায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করা। কিন্তু অভিযোগ আছে, তারা ব্যবসায়ীদের পক্ষে অবস্থান নেয়।
বাংলাদেশের বাজার সম্পর্কে আরেকটি কথা বলা হয় যে, এখানে ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামতো পণ্যের দাম বাড়াতে পারেন। কারসাজি করতে পারেন। কালেভদ্রে কিছু অভিযান হলেও এবং ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হলেও দীর্ঘমেয়াদে তার কোনও প্রভাব বাজারে পড়ে না। কারণ ব্যবসায়ীরা যতটা সংগঠিত এবং রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী—সাধারণ ভোক্তার মধ্যে সেই ঐক্য নেই। তদারকি ও বাজার নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও খুব একটা শক্তিশালী নয়। তাদের জনবলেরও সংকট আছে।
বলা হচ্ছে জ্বালানি, সার ও বীজের দাম বাড়ায় সবজির উৎপাদন ও পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আবার নানা কারণে সারা বিশ্বেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, দেশের সবচেয়ে কম উপার্জনকারী ব্যক্তিটিও যাতে তার বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাদ্যপণ্যটি কিনতে পারে, সেই ব্যবস্থা রাখা। যেন বাজারে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম দেখে তাকে খালি ব্যাগ নিয়ে ফিরতে না হয়। যাতে এমন পরিস্থিতি তৈরি না হয় যাতে অবৈধ পথে কোটি টাকা উপার্জনকারী ব্যক্তির সঙ্গে তাকে বাজারে গিয়ে কমপিট করতে হয়।
সাংবাদিক নাজমুস সালেহী রাজধানীর হাতিরপুল বাজারের তথ্য নিয়ে লিখেছেন, কচু ১৬০ টাকা, পেঁপে ৮০ টাকা, ঝিঙে ১০০ টাকা, চিচিঙ্গা ৮০ টাকা, ছোট চাল কুমড়া ৭০ টাকা, ছোট লাউ ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ৭০ টাকা, সজনে ডাঁটা ১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখেছেন। শাকের দামও চড়া। এই বাজারে এক আঁটি পুঁই শাক ৬০ টাকা এবং যেকোনও জাতের বেগুনের কেজি ৭০/৮০ টাকা। তার প্রশ্ন, ‘বাজারভেদে সবজির দাম হেরফের হতে পারে। তাই বলে এত বেশি? কাঁচা বাজার দেখার কি কেউ নেই?’
কথাসাহিত্যিক আহমেদ মোস্তফা কামাল লিখেছেন: ‘আমি বাজার করি মালিবাগ বা শান্তিনগর বাজার থেকে। সবজিই আমার প্রধান খাবার। এখন কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সীমার বাইরে চলে গেছে সবকিছু।’
প্রশ্ন হলো, স্বল্প আয়ের মানুষের পাত থেকে কি তাহলে সবজিও উঠে যাবে? নাকি বর্ষার মৌসুম এলে সবজির বাজারে সাধারণ মানুষের স্বস্তি ফিরবে? ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কৃষক আবু বকর সিদ্দিক ফেসবুকে লিখেছেন: বছরের এই সময়ে কাঁচা পেঁপের দাম স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে। তবে দ্রুতই নতুন পেঁপে বাজারে আসবে। তখন কেজি ৩০/৪০ টাকা হবে। তিনি লিখেছেন: ‘আমার পেঁপে বাগান আছে। আগের বছরেরটা এই শীতেই শেষ। পেঁপে এক বছরের ফসল। নতুন পেঁপের ফুল আসা শুরু হয়েছে। এরপর এলে ৪০০ টাকা মণে (কেজি ১০ টাকা) বিক্রি করতে হবে।’ কিন্তু অন্যান্য সবজির কী হবে—সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কিন্তু তারপরও আশায় বুক বাঁধা ছাড়া স্বল্প আয়ের মানুষের আপাতত কী-ই বা করার আছে!
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।