X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

ঢাকা-১৭: কে কার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন?

আমীন আল রশীদ
১৩ জুন ২০২৩, ১৯:২১আপডেট : ১৩ জুন ২০২৩, ১৯:২১

সংসদ সদস্য আকবর হোসেন খান পাঠান ওরফে চিত্রনায়ক ফারুকের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন টেলিভিশনে সরকারের পক্ষে যুক্তিতর্ক দিয়ে জোরালো ভাষায় কথা বলে আলোচিত মোহাম্মদ এ আরাফাত—যিনি পেশাগতভাবে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। গত পয়লা জানুয়ারি থেকে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিরও সদস্য। এর আগে মোহাম্মদ আরাফাত ‘সুচিন্তা ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠনের প্রধান হিসেবে টেলিভিশনের টকশোতে উপস্থিত হতেন। আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা অনেকেই জানেন। ফলে রাজধানীর অভিজাত গুলশান-বনানী-ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ আসনে তার মনোনয়ন পাওয়ার সংবাদটি কারও কাছে হয়তো অস্বাভাবিক মনে হয়নি। যদিও এই আসনে নৌকার মাঝি হওয়ার জন্য আরও অনেকেই মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। যাদের মধ্যে বিনোদন জগতেরও কেউ কেউ ছিলেন।

যেহেতু এই উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি অংশ নিচ্ছে না, ফলে মোহাম্মদ আরাফাতের জয়ী হওয়াটা অনেক সহজ বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু এখানে আলোচনা হচ্ছে অন্য ইস্যুতে। সেই ইস্যুর নাম ‘হিরো আলম’।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত ইউটিউবার আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম। তার ভাষায়, ‘সদ্য অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। ঢাকা-১৭ আসনে চলচ্চিত্রের ‘মিঞা ভাই’ সংসদ সদস্য ছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি এলাকার তেমন উন্নয়ন করতে পারেননি। হিরো আলমকে সারা দেশের মানুষ ভালোবাসেন। জনগণ চান সংসদে গিয়ে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করি। উপনির্বাচনে বিজয়ী হলে ৪-৫ মাস এলাকার উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই।’ (প্রথম আলো, ৫ জুন ২০২৩)।

এর আগে গত পয়লা ফেব্রুয়ারি বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনে উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন হিরো আলম। এরমধ্যে বগুড়া-৪ আসনে তিনি ৮৩৪ ভোট কম পেয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত জাসদের প্রার্থী একেএম রেজাউল করিমের কাছে হেরে যান। আর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রাগেবুল আহসানের কাছে জামানত হারান বগুড়া-৬ আসনে।

যদিও বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার কাছে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেনি জাপা। এর আগে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও হিরো আলম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে না অভিযোগে দুপুরে বর্জন করেন। ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। তবে শেষমেশ মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।

হিরো আলমের পড়ালেখা, শিক্ষা, রুচি ও সাংস্কৃতিক মান কী সেটি তার ভিডিও কনটেন্টেই পরিষ্কার। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান যেহেতু কেবল মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত এবং মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি ছাড়া যে কাউকেই (২৫ বছর বয়স হলেই) নির্বাচন করার অধিকার দিয়েছে এবং শিক্ষাদীক্ষারও কোনও শর্ত নেই, এমনকি সংসদ সদস্য বা আইনপ্রণেতা হওয়ার জন্যও ন্যূনতম পড়ালেখা জানার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, ফলে সংবিধান ও আইনত হিরো আলমের আইনপ্রণেতা হতে কোনও বাধা নেই।

মূলত সংবিধানের এই সহজ বিধানের সুযোগ নিয়েই অশিক্ষিত লোকজনের সংসদ সদস্য বা আইনপ্রণেতা হওয়ার পথ সুগম হয়েছে। অথচ আইন প্রণয়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর খুঁটিনাটি দিকগুলো না বুঝলে আমলারা যে ধরনের খসড়া তৈরি করে দেন—হুবহু সেভাবেই আইনগুলো পাস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। অনেক সময় বলা হয়, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরে তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ ও ওরিয়েন্টেশন দেওয়া হয়। কিন্তু সেসব প্রশিক্ষণ ও ওরিয়েন্টেশনেও কতজন আইনপ্রণেতা হয়ে উঠতে পারেন—সেই তর্ক বহুদিনের।

বাংলাদেশের রাজনীতির আরেকটি বড় ট্র্যাজেডি হলো, নিতান্ত জনগণের সেবার ব্রত নিয়ে রাজনীতি যারা করেন, তাদের পক্ষে এখন দলের মনোনয়ন পাওয়া খুব কঠিন এবং বলা ভালো অসম্ভব। একটা সময় পর্যন্ত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তি যেমন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারতেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো দলীয় প্রতীকে করার পর থেকে সেই সুযোগটুকুও তিরোহিত হয়েছে। এখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্যও যে ধরনের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি এবং পয়সার খেলা খেলতে হয়, সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় কোনও সুস্থ মানুষের অংশ নেওয়ার রুচি থাকার কথা নয়। যে কারণে ধীরে ধীরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোও শিক্ষিত-সজ্জন ও ভালো মানুষের কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে গেছে। জাতীয় সংসদের কথা বলাই বাহুল্য।

সম্প্রতি গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে হেরে গেছেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আজমত উল্লা খান। এখানে জয়ী হয়েছে জায়েদা খাতুন। যিনি মূলত একজন গৃহিণী বা সাধারণ নারী। রাজনীতির সঙ্গে যার সেরকম কোনও যোগসূত্র ছিল না। কিন্তু তিনি এখানে কী করে নির্বাচিত হলেন সেটি সবার জানা। মূলত এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন এই সিটির সাবেক (বহিষ্কৃত) মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। কেননা, জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় তার পক্ষে ‘ডামি প্রার্থী’ হন মা জায়েদা খাতুন।

বলা হয়, গণতন্ত্র হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের শাসন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক মিলেও অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যখন কোনও একটি জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রুচির মান নিম্নমুখী—সেখানে কম পড়ালেখা ও নিম্ন রুচির লোকেরাই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। কেননা, প্রত্যেকে যার সঙ্গে নৈকট্য অনুভব করেন, তাকেই ভোট দেন। ফলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, একজন প্রথিতযশা লেখক কিংবা বিজ্ঞানীও একজন শ্রমিকের কাছে, একজন সাধারণ পেশাজীবীর কাছে, একজন অশিক্ষিত ব্যবসায়ী, যার অনেক টাকা ও পেশিশক্তি আছে, তার কাছে হেরে যেতে পারেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনি ব্যবস্থায় এটি জায়েজ এবং এটিই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি ও দুর্বলতা। অর্থাৎ হিরো আলমের মতো একজন কমেডিয়ান বা ইউটিউবারের কাছে যদি একজন অধ্যাপকও হেরে যান, সেটি পদ্ধতি হিসেবে গণতান্ত্রিক, কিন্তু দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর নাও হতে পারে।

সুতরাং ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে শেষমেশ হিরো আলম মনোনয়নপত্র জমা দেবেন কিনা এবং দিলেও তার মনোনয়ন বৈধ হয়ে তিনি ভোটের মাঠে টিকে থাকবেন কিনা; থাকলেও তিনি কী পরিমাণ ভোট পাবেন; মানুষ তাকে ভালোবেসে ভোট দেবে নাকি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে হারানোর জন্য এমন একজন প্রার্থীকে ভোট দেবেন, যিনি বিজয়ী হলে নতুন করে কিছু হাস্যরস সৃষ্টি হবে—সেটি সময়ই বলে দেবে।

মেম্বার অব পার্লামেন্ট বা সংসদ সদস্য মানে আইনপ্রণেতা। একজন প্রার্থীর রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাস যা-ই থাকুক না কেন, অন্তত আইনপ্রণেতা হওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা, মেধা, রুচি ও মনন তার আছে কিনা—সেটি বিবেচনায় নেওয়া দরকার। একজন টেলিভিশনের জোকারও একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন; একজন পড়ালেখা না জানা সংগীতশিল্পীও তার জনপ্রিয়তা ও অন্যান্য বিবেচনায় সংসদ সদস্য হতে পারেন—আইন ও সংবিধান তাকে বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু ব্যালট পেপারে সিল মারার আগে ভোটারের অন্তত এই চিন্তাটা করা উচিত যে তিনি ভোটটা কাকে দিচ্ছেন?

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতায় খেলোয়াড়-সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত ৩
জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতায় খেলোয়াড়-সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত ৩
রাজশাহীতে মকবুল হত্যা মামলার পাঁচ আসামিকে কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার
রাজশাহীতে মকবুল হত্যা মামলার পাঁচ আসামিকে কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে দ্রুত ও সমন্বিত উদ্যোগের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে দ্রুত ও সমন্বিত উদ্যোগের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
আ.লীগ নিষিদ্ধের উদ্যোগ আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল: এ্যানি
আ.লীগ নিষিদ্ধের উদ্যোগ আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল: এ্যানি
সর্বশেষসর্বাধিক