X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

কওমি মাদ্রাসা অভিভাবক আসলে কে?

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
২৬ জুন ২০২৩, ১৯:২৮আপডেট : ২৮ জুন ২০২৩, ১৯:৩৯

আমাদের কওমি মাদ্রাসাগুলোর অভিভাবক আসলে কে? বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক)? আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ (হাইয়া)? গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার? নাকি প্রতিটি মাদ্রাসা/মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল নিজেরাই নিজেদের অভিভাবক?

মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা ভালো কাজ। আমাদের দেশের বিপুল মুসলিম জনগোষ্ঠী ধর্ম পালন করে, ধর্ম বিষয়ে তাদের সহমর্মিতা আছে এবং তারা তাদের সন্তানদের ইসলাম ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত করাকে পুণ্যের কাজ মনে করেন। যারা তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়াতে পারেন না তারাও মাদ্রাসা ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে সম্মানের চোখেই দেখেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই যে দেশব্যাপী বিপুল পরিমাণ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং হচ্ছে, এসব মাদ্রাসা সুচারুরূপে পরিচালনার প্রাতিষ্ঠানিক অভিভাবক বা নজরদারি প্রতিষ্ঠান কে?

একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কারিক্যুলাম, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ, শিক্ষক নিয়োগ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার্থীদের খাদ্য ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের প্রাতিষ্ঠানিক বা আচরণগত অপরাধে শাস্তি প্রদান—এসব বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এবং সেটি ‍সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করবে কে? বেফাক? হাইয়া? সরকার? নাকি প্রতিটি মাদ্রাসা/মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল নিজেদের সুবিধামতো নিজেরা আলাদা আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন করে নেবে?

আমরা স্বাভাবিকভাবে জানি, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা বিষয়ক বিষয় দেখভালের জন্য ‘বেফাক’ নামে নখদন্তহীন একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেটি প্রায় অভিভাবক পর্যায়ের একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি এতটাই ‘লাজুক’ ও ‘বিনয়াবনত’ যে এরা কখনও কোনও মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় না। হোক সেটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিষয়ক বা আচরণগত যেকোনও পর্যায়ের। তাদের কাজ শুধু বছরে একটি পরীক্ষা পরিচালনা করা ও প্রাথমিক শ্রেণি পর্যায়ে কিছু পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা। পরীক্ষা পরিচালনাও সব শ্রেণির করতে হয় না। যদি মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক থেকে শেষ পর্যন্ত ১২টি শ্রেণি ধরা হয় তাহলে এরমধ্যে মাত্র পাঁচটি শ্রেণির প্রশ্নপত্র তৈরি ও পরীক্ষা পরিচালনা করে থাকে বেফাক। মাস্টার্স সমমানের সর্বশেষ শ্রেণি তাকমিল-এর (দাওরায়ে হাদিস) প্রশ্নপত্র তৈরি ও পরীক্ষা পরিচালনা করে থাকে হাইয়া।

এই পরীক্ষা পরিচালনা ছাড়া বেফাক বা হাইয়া মাদ্রাসা সংক্রান্ত আর কোনও কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করে না বা করার এখতিয়ার রাখে না। প্রতিটি মাদ্রাসা নিজেদের মতো পরিচালিত হয়। বিশেষত মাদ্রাসার যিনি প্রিন্সিপাল থাকেন, তার একক সিদ্ধান্তেই নির্ধারিত হয় এর সব কার্যাদি।

এখন প্রশ্ন হলো, বেফাকুল মাদারিস যদি কওমি মাদ্রাসার অভিভাবক বা নজরদারি প্রতিষ্ঠান হয়েই থাকে তাহলে সেটা কেন এমন নখদন্তহীন ‘নিধিরাম সর্দার’ সেজে থাকে? এর বড় কারণ হলো, বেফাকে অভ্যন্তরীণ পদ-পদবির ‘রাজনীতি’ এতটাই সরগরম যে এর পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তারা নিজেদের পদ কায়েম রাখতে মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনও নাক গলানোর মতো নীতিমালা প্রণয়ন করতে আগ্রহী হননি।

আরও মজার বিষয় হলো, বেফাকের উপদেষ্টা পর্ষদ, পরিচালনা পর্ষদ, নীতিনির্ধারণী পর্ষদ—এসব পর্ষদে যারা রয়েছেন, তারা সকলেই দেশের বড় বড় মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল/মুহতামিম। ফলে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে গেলে এই পর্ষদবর্গ তো বটেই সারা দেশের শত শত মাদ্রাসার প্রিন্সিপালরা বেফাকের ওপর নাখোশ হতে পারেন। আর মাদ্রাসার প্রিন্সিপালরা নাখোশ হলে বেফাকের অস্তিত্ব হারানোর ঝুঁকি শতভাগ। এ জন্য বেফাক প্রতিটি মাদ্রাসাকে তাদের নিজেদের ইচ্ছা-স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে। আপনারা আপনাদের মতো মাদ্রাসা চালান। শুধু দ্বিবার্ষিক পরীক্ষাটা আমাদের পরিচালনা করতে দেন। আমরা কখনও আপনাদের মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবো না।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেফাক নিজেও কখনও দেশের হাজার হাজার মাদ্রাসা পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনও প্রকার নীতিমালা বা কঠোর কোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বরাবরই অনীহা দেখিয়ে এসেছে। বেফাক মনে করে, এতে কওমি মাদ্রাসার ঐতিহ্য নষ্ট হবে, পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক থেকে ছিটকে যাওয়ার ভয়, আরও নানা হেনতেন যুক্তি আছে তাদের ঝুলিতে।

অথচ প্রতিষ্ঠার ৪০ বছরে বেফাকের উচিত ছিল একটি শক্ত গভর্নিং বডি তৈরি করা এবং প্রত্যেকটি মাদ্রাসার সত্যিকারের অভিভাবক হিসেবে নিজেদের ভিত্তি দৃঢ় করা। মাদ্রাসা পরিচালনা নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, আর্থিক হিসাব নজরদারি, শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নির্ধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধ ও ব্যক্তি পর্যায়ে আচরণগত অপরাধ—সকল বিষয়ে মনিটরিং করতে পারার মতো সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার বেফাকের থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা না করে বছরের পর বছর ধরে নানা ধানাই-পানাই করেছে এবং করেই চলেছে।

কওমি মাদ্রাসাগুলো কখনোই চায় না যে দেশের সরকার তাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ করুক। দেশ স্বাধীন হওয়ার বিগত ৫০ বছরে কোনও সরকার সে ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। এই বিরাট ধর্মীয় গোষ্ঠীকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সরকারি বাধ্যবাধকতায় আনতে গেলে সংগত কারণেই একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা থাকে। এ কারণে কোনও সরকারই তাদের আর বেশি ঘাঁটাতে যায়নি। সরকার বেফাক-হাইয়ার মতো প্রতিষ্ঠানকে তাদের প্যারেন্ট-প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্ধারণ করে এর থেকে দূরেই থেকেছে।

কিন্তু দুঃখের বিষয়ই বলতে হবে, কওমি মাদ্রাসা পরিচালনার প্যারেন্ট-প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারকগণ সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতি মোটেও শ্রদ্ধাশীল নন। তারা কখনোই মাদ্রাসাগুলোর ওপর নিজেদের নজরদারি ও নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। মাদ্রাসা পরিচালনার ব্যাপারে তাদের নির্দিষ্ট কোনও নীতিমালা রয়েছে কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকগণ কেবল নিজেদের পদ-পদবি রক্ষা এবং নামকাওয়াস্তে অভিভাবক সেজে বসে আছেন। দেশের সব মাদ্রাসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার একটি সমন্বিত ও কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তাদের কোনও আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।

আমরা কওমি মাদ্রাসায় কখনোই সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করি না। মাদ্রাসাগুলো যেরকম স্বাধীনভাবে দেওবন্দী ধারায় ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করে আসছে, তারা সরকারি হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে সেভাবেই তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করুক। কিন্তু বেফাক-হাইয়ার মতো অভিভাবক প্রতিষ্ঠান যখন মাদ্রাসাগুলোর অভ্যন্তরীণ শত শত অপরাধ, অনিয়ম, দুর্নীতি, আচরণগত পদস্খলন দেখেও না দেখোর ভান করে থাকে এবং সেগুলোর প্রতিকারে কোনও পদক্ষেপ নেয় না, তখন সরকার এখানে হস্তক্ষেপ করতে এগিয়ে আসবেই, আজ না হয় কাল।

সম্প্রতি সাভারের এক মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রিন্সিপালের অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশের একটি টিভি চ্যানেল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদন দেখার পর মাদ্রাসা-সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজন মন্তব্য করেছেন, এমন আরও অনেক অনৈতিক ও অনিয়ম চলছে দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায়। কিছু দিন পর হয়তো মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ নানা অপরাধ ও অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে এমন আরও প্রতিবেদন যখন প্রকাশ হতে থাকবে, তখন সরকার মোটেও বসে থাকবে না। সরকার বরং এমন সুযোগের অপেক্ষাতেই শিকারি ঈগলের মতো ওত পেতে বসে আছে। সুযোগ পাওয়ামাত্র সরকার মাদ্রাসাগুলোতে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসবে এবং পূর্ণ হস্তক্ষেপ কায়েম করতে সচেষ্ট হবে। তখন হাইয়া-বেফাকের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।

এজন্য হাইয়া-বেফাকের উচিত দ্রুত বাংলাদেশের সব মাদ্রাসার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিচালনা নীতিমালা প্রণয়ন করা এবং সেই নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে ছোট-বড় সব মাদ্রাসাকে বাধ্য করা। যার ইচ্ছা যখন তখন যেখানে সেখানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে বসলো, কোনও নিয়ম-নীতির বালাই নেই, কোনও পরিচালনা কমিটি নেই, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ ও প্রদানের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, প্রাতিষ্ঠানিক বা আচরণগত অপরাধের কোনও বিচার নেই—এভাবে তো চলতে পারে না। হাইয়া-বেফাক মাদ্রাসাগুলোর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। সুতরাং তাদেরই নির্ধারণ করতে হবে—তারা কি মাদ্রাসাগুলোতে সরকারি হস্তক্ষেপ চায় নাকি নিজেরাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী হয়ে শক্ত হাতে দমন করবে ধর্মশিক্ষার আড়ালে বেড়ে ওঠা লম্পটদের দৌরাত্ম্য! এ সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে।

 
লেখক: তরুণ আলেম

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের শান্তি আলোচনায় আমন্ত্রণ পায়নি রাশিয়া: সুইজারল্যান্ড
ইউক্রেনের শান্তি আলোচনায় আমন্ত্রণ পায়নি রাশিয়া: সুইজারল্যান্ড
দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে ঋণের শর্তে আটকে ফেলেছে: ক্যাব
দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে ঋণের শর্তে আটকে ফেলেছে: ক্যাব
বৃষ্টিতে লবণ তুলতে গিয়ে বজ্রাঘাতে প্রাণ হারালেন দুই শ্রমিক
বৃষ্টিতে লবণ তুলতে গিয়ে বজ্রাঘাতে প্রাণ হারালেন দুই শ্রমিক
‘যুক্তরাষ্ট্রে ৯০০ শিক্ষার্থী গ্রেফতারের ঘটনা বিএনপির অত্যাচারের কথা মনে করিয়ে দেয়’
‘যুক্তরাষ্ট্রে ৯০০ শিক্ষার্থী গ্রেফতারের ঘটনা বিএনপির অত্যাচারের কথা মনে করিয়ে দেয়’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ