X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

কেন এই লঙ্কাকাণ্ড?

মোস্তফা হোসেইন
০৩ জুলাই ২০২৩, ১৪:১৫আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৩, ১৪:১৫

পেঁয়াজ কাণ্ড শেষ না হতেই কাঁচা মরিচের ঝালে গাল বেয়ে চোখের পানি পড়ছে মানুষের। কোরবানির ঈদের আগে হঠাৎ করে কাঁচা মরিচ পাকা সিন্ডিকেট চর্চায় পড়ে ক্রেতার চুল পাকিয়ে ছেড়েছে। তাও যেমন তেমন বিষয় নয়, অকালের কাঁচা মরিচ যেখানে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা সেই মরিচ বিক্রি হতে থাকলো ৩৬০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা। অদ্ভুত ব্যাপার! ঢাকার একেক বাজারে একেক দর। চালডাল থেকে কিনলাম ৩৯০ টাকা দরে, সন্ধ্যায় একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে দেখি ৪৪০ টাকা। ওখান থেকে ফিরতে পথে গলিতে দেখলাম বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা। অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে দেখলাম একই মরিচ কোথাও কোথাও বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা কেজি দরে।

মাত্র ক’দিন আগে পেঁয়াজের ঝাঁঝ দেখেছি আমরা। সে কী কাণ্ড! হা হুতাশ, হইচই, বিশাল ব্যাপার। চরম মুহূর্তে সরকার সিদ্ধান্ত নিলো পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। আমদানি হলো। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বাজারে আসার আগে আগেই দাম কমে গেলো কেজিপ্রতি ২৫-৩০ টাকা।

ঈদের আগেই মরিচের মতিগতি ভালো না দেখে সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো কাঁচা মরিচও আমদানি করতে হবে। ১ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন কাঁচা মরিচ আমদানির জন্য এলসি খোলার অনুমোদন দেওয়া হলো। তার অংশ হিসেবে ২৬ জুন হিলি স্থলবন্দর দিয়েই ৭ মেট্রিক টন কাঁচা মরিচ প্রবেশও করে। যা অব্যাহত আছে এখনও।

দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের পরও বাজারে এর প্রতিফলন ঘটলো না। পেঁয়াজ কাণ্ডে যেমন আমদানি হওয়ার সময়ই দাম কমে গিয়েছিল, কাঁচা মরিচের বেলায় ঘটলো উল্টো। সেই যে ঈদের দিন ঘনিয়ে আসার সময় থেকে বাড়তে শুরু করে সেই ক্রমবৃদ্ধি ঈদের পরদিনও এমনকি এই নিবন্ধ লেখাকালেও অব্যাহত রয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা চলছেই। যারা সমালোচনা করছেন, তাদের সমালোচনার যৌক্তিকতা আছে। কারণ বাজারে গিয়ে তাদের কাঁচা মরিচ দেখেই বোম্বাইয়া মরিচের ঝালে পেয়ে যায়। সালাদে কাঁচা মরিচ ব্যবহারের স্বাদ মিটে যায় কাঁচাবাজারে থেকেই।

কাঁচা লঙ্কার এই লঙ্কাকাণ্ড কেন? যারা বলেন বর্ষা শুরু হলে কাঁচা মরিচ গাছ মরে যায়, গাছ বেঁচে থাকলেও কৃষক মরিচ ক্ষেতে যায় না, কাদামাটির ক্ষেতে মরিচ গাছের গোড়া মাটির চাপ সইতে পারে না বলে কিংবা শেষ মৌসুমে মরিচের অভাব হবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের কথার যুক্তি আছে। অবশ্যই এই মৌসুমে প্রতিবছর কাঁচা মরিচের দাম চড়া থাকে। যা স্বাভাবিক বাজারের দ্বিগুণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। গত বছরও যা ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছিল। এবারও তাই হওয়ার কথা ছিল। হয়তো তেমনই হতো– পত্রিকাগুলো সংবাদ করতো কাঁচা মরিচের দাম দ্বিগুণ বেড়ে আড়াইশ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এবার সংবাদ শিরোনাম হলো কাঁচা মরিচের বাজারে আগুন। ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে কোরবানির ঈদের বাজারে। মেনে নেওয়া যায় কি এমন অগ্নিমূল্য? সহজে মেনে নেয়নি কেউই। তবে বছরের একটা ঈদের খাওয়া বাদও দেওয়া যায় না। ১০০ গ্রাম ২০০ গ্রাম হলেও কিনেছেন সবাই। তবে ঝালটা জিহ্বা থেকে সরে গিয়ে পকেটে লেগেছে।

কিন্তু এটা কি অবশ্যই হওয়ার কথা ছিল? স্বাভাবিক ভাবার কারণ নেই। মৌসুমের শেষ কিংবা ঈদের বাড়তি চাহিদা ইত্যাদি, যতই যুক্তি দেখানো হোক তাকে যৌক্তিক ভাবার কারণ নেই। স্পষ্টত এর জন্য দায়ী ব্যবসায়ীরা। পেঁয়াজে ওদের কারসাজি আংশিক সফল হলেও কাঁচা মরিচে ওরা সাধারণ মানুষের চোখের পানি নাকের পানি এক করতে  সক্ষম হয়েছে। সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার পরও তাদের তাণ্ডব থামেনি। সহজ দৃষ্টিতে স্পষ্ট বোঝা যায়, কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমোদন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজার মনিটরিংয়ের যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল তা মোটেও হয়নি। যার পরিণতি বাজারের বেহাল দশা। সুতরাং সরকারের চেষ্টায়ও শেষ রক্ষা হলো না এটাই বলা যায়। পরিণতিতে সাধারণ মানুষের পকেটের ঝাল কিন্তু সরকারের সুনামেও ঘা দিয়েছে।

পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, কাঁচা মরিচের মতো কৃষিপণ্য নিয়ে প্রতিবছরই এমন কাণ্ড কি রোধ করা যায় না? কিংবা এই লঙ্কাকাণ্ড কি কমানো যায় না? নিশ্চিতভাবে বলা যায়– সম্ভব। উদ্যোগ নিলে এতটা ভয়াবহ অবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।

কীভাবে সম্ভব এর একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন হবে ভোক্তাদের একটু নড়েচড়ে বসা। উদাহরণটা আমার নিজের অভিজ্ঞতাপ্রসূত।

তিন বছর আগে একবার আমি গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে পাড়ার মুদি দোকানের সামনে দেখি একটা বস্তার তলানিতে কিছু শিকড় গজানো আদা পড়ে আছে। দোকানি সেগুলো ফেলে দেবে এমনই বোঝা গিয়েছিল। নামমাত্র মূল্যে সেগুলো কিনে নিই। মাত্র সাড়ে ৫শ’ গ্রাম। পথে একটি বাজার থেকে ৫ কেজি বীজ হলুদ কিনলাম। জুন মাসের শেষ তখন। আদা ও হলুদ লাগানোর কথা শুনে অনেকে টিপ্পনী কাটে। তাদের কথা, আদা-হলুদ লাগাতে হয় চৈত্রের শেষে। এমন বর্ষায় লাগালে হবে না।

এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে আদা ও হলুদগুলো লাগালাম পুকুর পাড়ে এবং ফল বাগানে গাছের ছায়ায়। পুকুর পাড় পুরোটাই পরিত্যক্ত। তিন বছর পর কিছু দিন আগে সেই সাড়ে ৫শ’ গ্রাম আদা আর ৫ কেজি হলুদ প্রতিটি ৩০ কেজির বেশি হয়ে গেছে। নিজেদের খাওয়ার জন্য কিছু রেখে বাকিটুকু এবারও লাগানো হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়ায় কোনও ওষুধ, কোনও সার কিংবা সেচ ব্যবহার করা হয়নি। শুধু লাগানো এবং তোলার জন্য শ্রমিক ব্যয়।

সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত জায়গায় বীজ ছাড়া অন্য কোনও ব্যয় ব্যতীত যদি আদা ও হলুদের এই ফলন হয় তাহলে সহজে বোঝা যায়, ইচ্ছা করলেই কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আদা হলুদ ইত্যাদি আমদানি করার প্রয়োজন হয় না। হলেও তা অনেকাংশে কমে আসবে।

অনেকেরই প্রশ্ন আসতে পারে, কাঁচা মরিচের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী? কাঁচা মরিচের বিষয়টিও এর চেয়ে আলাদা কিছু নয়। বয়স্কদের মনে থাকার কথা, একসময় মৌসুম ছাড়া সব জায়গায় কাঁচা মরিচ পাওয়া যেতো না। গ্রামে একবারেই পাওয়া যেতো না। শহরের ছোট বাজারগুলোতেও দেখা মিলতো না কাঁচা মরিচের। তখন গ্রামের গৃহস্থরা কি তাহলে কাঁচা মরিচ খেতো না? হ্যাঁ খেতো, তবে এখনকার মতো নিত্য নয়। আর সেই কাঁচা মরিচগুলো হতো কোনও ক্ষেতে নয়, তাদের বসতবাড়িতে ঘরের আঙিনায়। এমন কোনও বাড়ি ছিল না, যেসব বাড়ির ঘরের সামনে দুয়েকটা জিরা মরিচের গাছ না ছিল। বারমাসি এসব গাছ থেকে তাদের কাঁচা মরিচের চাহিদা পূরণ হতো।

পরিবর্তনটা খেয়াল করুন। এখন গ্রামের মানুষও নিত্য খায় কাঁচা মরিচ এবং সেটা বাজার থেকে কিনে। ব্যতিক্রম ছাড়া কোনও ঘরের আঙিনায় ওই জিরা মরিচ গাছ দেখা যায় না। তাহলে তাদের চাহিদা পূরণের জন্য একমাত্র মাধ্যম হলো বাজার। সেই অবস্থায় কাঁচা মরিচের ঝাল ক্রেতার পকেট ফুটো করবে না তো কী করবে?

এ প্রসঙ্গে আমাদের কৃষি ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে। গত ২০-২৫ বছর ধরে আমাদের কৃষকদের প্রায় সবাই ধান চাষে অধিক মনোযোগী হয়েছেন। এর কারণ চালের ক্রমবর্ধমান চাহিদা। বলাবাহুল্য, মানুষ ধানচাষে প্রায় শতভাগ সফল। খাদ্য উৎপাদনে বিশাল সাফল্য তাদের প্রচেষ্টার ফল। ধানচাষে কৃষকরা এতই মনোযোগী হয়েছে যে রবিশস্য চাষে ভাটা পড়ে গেছে। আগে বাড়ির আশপাশের জমিতে যারা পেঁয়াজ রসুন সরিষা ইত্যাদি চাষ করতো সেসব জমিতেও তারা ধান চাষ করে। একদিকে চালের চাহিদা পূরণ হওয়ার পর পেঁয়াজ রসুন জাতীয় কৃষিপণ্যের বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যে কারণে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সেগুলো আমদানি করতে হচ্ছে। চাষাবাদ ব্যবস্থাপনায় কৃষি বিভাগকে নতুন করে ভাবতে হবে। যেসব এলাকায় উদ্বৃত্ত ধান চাষ হয় সেখানে কিছু রবিশস্য করা জরুরি। অন্তত কৃষকের নিজের চাহিদা পূরণের জন্য কিছু করেও যদি চাষাবাদ হয় তাহলেও অন্তত এমন লঙ্কাকাণ্ড ঘটার সম্ভাবনা থাকে না।

সবশেষে বলা যায়, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মতো নিত্য পণ্যগুলোর আবাদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সেই কাজে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করার কাজটি করতে হবে কৃষি বিভাগকে। পরিত্যক্ত জমির সদ্ব্যবহার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাকে রাজনৈতিকভাবে না দেখে কার্যকর করা অতি জরুরি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব এমন লঙ্কাকাণ্ড রোধ করা।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেড়েছে রাবার উৎপাদন, আয় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা
হলদিয়া রাবার বাগানবেড়েছে রাবার উৎপাদন, আয় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা
টিভিতে আজকের খেলা (১ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১ মে, ২০২৪)
মন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কি অবস্থান পাল্টাচ্ছে?
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কি অবস্থান পাল্টাচ্ছে?
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ