X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমার শিক্ষক কাজী শাহেদ আহমেদ

জুলফিকার রাসেল
২৯ আগস্ট ২০২৩, ১৫:২০আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২৩, ১৬:০৪

হাউজ ৪১, ধানমন্ডিতে জেমকন গ্রুপের চেয়ারম্যান কাজী শাহেদ আহমেদের বাসভবন। স্যারের বাসার রিসেপশন থেকে ফোন এলো।

ওপাশের কণ্ঠ: ‘চেয়ারম্যান স্যার ফোনে আছেন, আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।’

স্যার আমাকে এই জীবনে অসংখ্যবার ফোন দিয়েছেন। নানা কাজে, নানা বিষয় নিয়ে। তাই এবারও সেরকম কোনও ফোন ভেবে স্যারের জন্য অপেক্ষা করলাম।

কাজী শাহেদ আহমেদ: রাসেল, কেমন আছো?

– জি স্যার, আপনার দোয়ায় ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

কাজী শাহেদ আহমেদ: আমি তোমার চেয়েও ভালো আছি। বেশি ভালো। মন ভালো, শরীর ভালো, সব ভালো।

আমি ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম নতুন কোনও ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবেন নিশ্চয়ই। হয় নতুন কোনও উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আসবে, নয়তো আবারও আজকের কাগজ বের করতে কত খরচ পড়বে তার খোঁজ-খবর নিয়ে হিসাব করে জানাতে বলবেন!

কাজী শাহেদ আহমেদ: তোমাকে মন থেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আই অ্যাম রিয়েলি হ্যাপি ফর ইউ। গান লিখে তুমি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছো। মনে হচ্ছে আমি পেয়েছি!

অ্যাওয়ার্ডের খবর তখন দুই-তিন দিনের পুরোনো। স্যার হয়তো পরে জেনেছেন। আমি ভীষণ খুশি হলাম।

– অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার। আপনার দোয়া ছিল বলেই পেয়েছি।

এরপর স্যার আলাপ শুরু করলেন।

কাজী শাহেদ আহমেদ: শুধু দোয়ায় কাজ হয় না রাসেল। কারও যদি মেধা না থাকে, তার জন্য মক্কার ইমাম সাহেব দোয়া করলেও কাজ হবে না। তোমার বেড়ে ওঠা আমি দেখেছি। মেধা, মেধাকে কাজে লাগানোর দক্ষতা তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে! তোমার মনে আছে, আজকের কাগজে একবার একটা প্রশ্ন করেছিলে?

– কী প্রশ্ন স্যার?

কাজী শাহেদ আহমেদ: আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। তুমি প্রশ্ন করেছিলে, ১২ হাজার টাকা বেতনে কি কারও সংসার চলে?

এই প্রশ্ন কবে করেছিলাম তা যদিও তখন মনে পড়ছিল না। তবে সেটা ১৯৯৯ সালের দিকে হবে মনে হয়। মনে না পড়লেও আমি বললাম, ‘জি স্যার।’

কাজী শাহেদ আহমেদ: আমি কি উত্তর দিয়েছিলাম সেটা মনে আছে?

এবার তো আমি মহাবিপদে। আমার তো আসলে কিছুই মনে নেই!

– এটা তো স্যার মনে পড়ছে না! কী বলেছিলেন স্যার?

কাজী শাহেদ আহমেদ: বলেছিলাম, এখন চলছে না! একদিন এমন বেতন পাবে, যখন একটা না, দু’চারটা সংসার চালাতে পারবে! তখন ওটা শুধু জোকস ছিল না। আমি মিন করেই বলেছিলাম! তুমি এখন কত স্যালারি পাও?

স্যালারি নিয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলাটা বেয়াদবি হবে কিনা ভেবে আমি চুপ করে আছি।

কাজী শাহেদ আহমেদ: আমি জানি, তুমি কত পাও। গর্বে আমার বুক ভরে যায়। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ। নাবিল, আনিস, ইনাম– সবাই তোমাকে নিয়ে হ্যাপি। আমি ওদের চেয়েও হ্যাপি!

আমি আর আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। চোখ ভিজে গেলো। স্যারকে কিছু বুঝতে দিলাম না। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে স্যার ফোন রেখে দিলেন।

কাজী শাহেদ আহমেদের সঙ্গে জুলফিকার রাসেল সাংবাদিক হিসেবে আমার হাতেখড়ি দৈনিক জনকণ্ঠে, প্রদায়ক হিসেবে। এরপর সাপ্তাহিক দেশচিন্তা ও বাংলাবাজার পত্রিকা হয়ে সাপ্তাহিক খবরের কাগজ। ফিচার লেখায় হাত ভালো ছিল বলে একই পরিবারের আজকের কাগজে রেগুলার লেখা হতো। এটা থেকেই কাজী শাহেদ আহমেদ রিলেটেড ইভেন্ট হলেই আমাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হতো। এরপর একদিন নাবিল ভাই (কাজী নাবিল আহমেদ) ডেকে নিয়ে আজকের কাগজে বসালেন, রিপোর্টিং করতে বললেন।

আজকের কাগজে চাকরি না করলে, কাজী শাহেদ আহমেদ ও তার পরিবারের হিসেব-নিকেশ ছাড়া অবারিত স্নেহ না পেলে আমার এই অবস্থান কোনোভাবেই সম্ভব হতো বলে মনে হয় না।

গান লিখতাম বলে কাজের প্রয়োজনে সন্ধ্যার পর বিভিন্ন স্টুডিওতে যেতে হতো। কিন্তু সাংবাদিকতার চাকরি করে প্রায় প্রতিদিন রাত ৯টার আগে অফিস থেকে বের হওয়া এক কথায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। কিন্তু এই অসম্ভব একটি ছাড় আমি পেতাম। কাজী শাহেদ আহমেদ স্যার ও নাবিল ভাই এই সুযোগটি করে দিতেন। রিপোর্ট জমা দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই রাত আটটার দিকে বের হয়ে যেতাম। এই সুযোগ ক’জনের ভাগ্যে জোটে?

তবে এর জন্য নালিশ যেত। কিন্তু টাইমলি রিপোর্ট দিতাম বলে স্যার ও নাবিল ভাইয়ের কাছে সেই নালিশগুলো খুব একটা পাত্তা পায়নি। একের পর এক গান রিলিজ হয়েছে। একক অডিও অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। প্রশংসা ও উৎসাহবাক্য ছাড়া কোনোদিন একবারের জন্যেও ‘কাজে ফাঁকি দেই’ বলে ভর্ৎসনা করেননি। এই আশ্রয়-প্রশ্রয়ের সঠিক ব্যবহার করেছিলাম বলেই আজ আমার নামের পাশে গীতিকবি ও সাংবাদিক দুটোই জ্বলজ্বল করছে।

কাজী শাহেদ আহমেদ আধুনিক সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শক। তৎকালীন মুক্তমত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে তার প্রকাশিত খবরের কাগজ ও আজকের কাগজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আজকের কাগজ সাহসী ও নির্ভীক সাংবাদিকতা করতো। কারণ, এর প্রকাশক নিজেই ভীষণ সাহসী ও নির্ভীক ছিলেন। প্রকাশক ও সম্পাদক সাহসী না হলে কোনও গণমাধ্যমের পক্ষে এই ধরনের সংবাদ প্রকাশ সম্ভব নয়। অন্তত বাংলাদেশে তো নয়ই।

কাজী শাহেদ আহমেদ সবসময় চমক সৃষ্টি করেছেন। পত্রিকা, ব্যবসা কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছুতেই নতুনত্বের ছোঁয়া তার হাত দিয়ে।

আমার কাছে চমক আরও এক জায়গায়। তিনি আমাদের আধুনিক হতে শিখিয়েছেন। তার কঠিন নির্দেশে নব্বই দশকে কম্পিউটারে বাংলা কম্পোজ করতে শিখেছি। হয়তো শিখতাম না। যদি একদিন হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে না বসতেন, আজ থেকে ১৫ দিন পর হাতে লেখা আর কোনও রিপোর্ট নেওয়া হবে না। সবাইকে কম্পোজ করে রিপোর্ট জমা দিতে হবে। চাকরিটা বাঁচাতে কম্পোজ শিখেই ফেললাম সে সময়।

কাজী শাহেদ আহমেদ আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে জীবনযাপন করতে হবে। কোন পরিবেশে কোন ধরনের পোশাক পরতে হবে। কীভাবে কথা বলতে হবে। কী খেতে হবে। কখন, ক’বার খেতে হবে। কে, কতটা শিখেছে জানি না। কিন্তু আমি অনেক কিছু শিখেছি।

আজকের কাগজের সকালের মিটিং ছিল আমার কাছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু শিখবার সময়। কত-শত গল্প, পেছনের গল্প, অজানা কত ইতিহাস– জানা যেত সব। সবসময় কিছু না কিছু শিখতাম। নিউজ ফ্লোরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, সে সময় স্যার দু-একটা গল্প করতেন। সেখান থেকে শিখতাম। খাবার ক্যান্টিনে পায়চারী করছেন আর দু-একটা কথা বলছেন– শিখতাম সেখানেও।

কাজী শাহেদ আহমেদের কাছ থেকে এত কিছু শিখেছি বলেই আজ দেশের অন্যতম সেরা একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক আমি।

তাঁর কাছে আমার পাহাড়সমান ঋণ।

স্যার, ভালো থাকুন ওপারে।

লেখক: সম্পাদক, বাংলা ট্রিবিউন

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ