X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান নিয়ে মিথ্যাচার

এম. এম. আর. জালাল এবং কৌস্তুভ অধিকারী
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১২:১৩আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০১৬, ১৪:১২

যৌথ লেখক এম এম আর জালাল এবং কৌস্তুভ অধিকারী ফেব্রুয়ারির শুরুতে একটা খবর একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রচার হয়। যেখানে বলা হয় যে ‘ক্যাপ্টেন মোস্তফা আজিম আওলাদ’ স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে তার কেনা একটি ডিসি-১০ বিমান বাংলাদেশ সরকারকে দান করতে চান, কারণ ওই বিমানেই নাকি বঙ্গবন্ধু প্রথমবার স্বাধীন বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছিলেন।
বাংলা ট্রিবিউনের খবরেই প্রকাশ করা হয়েছে,
জানা গেছে, ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের প্রকাশ্য নিলাম থেকে পুরনো ২৩টি বিমান কিনে ভেঙে ফেলা হলেও, ভাঙা হয়নি ওগুলোর মধ্যে থাকা সেই ডিসি ১০ বিমানটি।বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত বিমানটির বর্তমান মালিক রাজবাড়ীর ক্যাপ্টেন মোস্তফা আজিম আওলাদ। ব্রিটেন থেকে এই বিমানটি নিলামে কিনেছিলেন তিনি।
ক্যাপ্টেন আওলাদ জানিয়েছেন, ডিসি-১০ বিমানের ভিআইপি লগবুক পরীক্ষা করে দেখা যায়, বিমানটিতে চড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে করাচি থেকে লন্ডন ও পরে লন্ডন থেকে ভারত হয়ে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন।
...
পরদিন ৯ জানুয়ারি ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি ডিসি-১০ বিমানে দেশের পথে যাত্রা করেন বঙ্গবন্ধু। ১০ই জানুয়ারি সকালে নামেন দিল্লীতে। এরপর ঢাকায় এসে পৌঁছান।
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর নিলামে তোলা পুরনো তিনটি বিমান কিনে নেয় ব্রিটিশ এয়ারলাইনসের সিনিয়র ক্যাপ্টেন ও প্রশিক্ষক রাজবাড়ীর বাসিন্দা ক্যাপ্টেন মোস্তফা আজিমের মালিকানাধীন ইম্পেরিয়াল এভিয়েশন।

তিনটি বিমানের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকায় কেনা ডিসি-১০ বিমানটির ভিআইপি যাত্রী পরিবহন লগবুক পরীক্ষা করে ক্যাপ্টেন মোস্তফা আজিম জানতে পারেন ওই বিমানযোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এরপর তিনি বিমানটি আর ভাঙতে দেননি। বর্তমানে লন্ডনে থাকা এই বিমানটি তিনি রক্ষণাবেক্ষণ করছেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিযুক্ত হওয়ায় বিমানটি তিনি বাংলাদেশ সরকারকে উপহার হিসেবে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি সাবেক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খানকে জানিয়েছেন এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলেও যোগাযোগ করেছেন। সরকার থেকে তাকে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের জুন মাসে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিমানটি পরিদর্শন করার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই প্রসঙ্গে প্রথমেই স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া ভালো, এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা। বঙ্গবন্ধু ইসলামাবাদ বিমানবন্দর (ইসলামাবাদ/রাওয়ালপিন্ডি) থেকে লন্ডন যান পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭০৭ প্লেনে, এবং লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে ঢাকা আসেন ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর কমেট প্লেনে। কোথাও ডিসি-১০ বিমানের কোনও স্থান নেই। বিস্তারিত প্রমাণ নিয়েই এ আলোচনা করা হয়েছে।

ইসলামাবাদ থেকে লন্ডন আসার ঘটনাবলীর বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় ওই প্লেনেরই চালক, এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরীর স্মৃতিচারণমূলক Mosaic of memory : a personal narrative বইয়ে, যা নিয়ে আবার আলোচনা করা হয়েছে আহমাদ সালিমের Blood beaten track: Sheikh Mujib's nine months in Pakistani prison বইতেও। দ্বিতীয় বইটির এক অংশ নিচে তুলে দেওয়া হলো, যেখানে জাফর চৌধুরী বলছেন যে, পাকিস্তানের জাতীয় বিমানসংস্থা Pakistan International Airlines থেকে চার্টার করা একটি Boeing 707 বিমান নিয়ে তিনি ইসলামাবাদ থেকে লন্ডন উড়ে গেছিলেন শেখ মুজিবকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ওই বইয়েরই ৯ই জানুয়ারি ১৯৭২-এ প্রকাশিত সানডে মেল-কে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, মুজিব যে প্লেনে করে লন্ডন গেছিলেন তা ছিল Pakistan International Airlines flight 635 এর একটি বিশেষ উড়ান।

বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান নিয়ে মিথ্যাচার

এই বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য উইকিতে বা অন্যত্র PIA-র পুরোনো বিমানের তালিকা দেখে নেওয়া যেতে পারে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তাদের বোয়িং ৭০৭ প্লেনগুলো ১৯৬০-এর দশক থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে তারা তাদের প্রথম McDonnell Douglas DC-10 প্লেন চালায় ১৯৭৪ সালে। অতএব তা শেখ মুজিবের জন্য ব্যবহৃত হওয়া সম্ভব ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে ঢাকা যাত্রা ছিল একটি বহুল প্রচারিত ঘটনা, অতএব এই যাত্রাপথে কী প্লেন ব্যবহৃত হয়েছিল তা বহু সংবাদসূত্রে পাওয়া যায়। আমাদের কাছে বর্তমানে অন্তত পাঁচটি দেশি ও বিদেশি সংবাদপত্রের খবর রয়েছে – ১১ জানুয়ারি ১৯৭২-এর দৈনিক বাংলা, পূর্বদেশ, গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্ট এবং ২৪শে জানুয়ারির টাইম ম্যাগাজিন। স্কোয়াড্রন লীডার মিঃ কুক চালিত এই বিমানটি ছিল রয়াল এয়ার ফোর্সের কমেট (de Havilland DH 106 Comet) প্লেন। নিচে দৈনিক বাংলা ও টাইম ম্যাগাজিনের দুটি সংবাদের ছবি দেওয়া হলো।

দৈনিক বাংলা ও টাইম ম্যাগাজিনের দুটি সংবাদের ছবি
আরও বিস্তারিত দেখতে চাইলে সেই সময়ের ফুটেজ সম্বলিত এই ইউটিউব ভিডিওটি দেখে নিন।

যে বিমানে বঙ্গবন্ধু ফিরেছেন
সেখানে ভাষ্যকার যে শুধু স্পষ্টভাবে রয়াল এয়ার ফোর্সের কমেট বিমানের কথা উল্লেখ করে দিয়েছেন তাই-ই নয়, ভিডিওটির ১০ মিনিট অংশে যখন বিমানটিকে স্পষ্ট দেখা যায়, তখন সেটির ডানার মধ্যেই প্রবেশ করানো ইঞ্জিন দুটি খেয়াল করুন। এটি কেবল কিছু শ্রেণির কমেট প্লেনেই দেখা যায়, McDonnell Douglas DC-10 বিমানে নয়।

বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকা থেকে ওই যাত্রায় বঙ্গবন্ধুর সাথে থাকা ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক ব্যানার্জিকে প্রশ্ন করলে তিনিও কমেট বিমানের কথাই উল্লেখ করেন।

শেষে এটাও সংযোগ করে রাখা ভালো, যে তর্কের খাতিরে কেউ হয়তো বলার চেষ্টা করতে পারেন, যে আলোচিত বিমানটির মডেল নম্বর DC-10 নয়, VC-10, সাংবাদিকেরা শুনতে ভুল করেছেন। তাহলে এটা মনে রাখা উচিত হবে যে Vickers VC10 বিমানটি খুবই অল্পসংখ্যক নির্মিত হওয়া একটি বিমান, যা ব্রিটিশ বিমানবাহিনী এবং অল্প কিছু দেশের অসামরিক বিমানসংস্থা ব্যবহার করেছিল, এবং সেই তালিকায় পাকিস্তানের নাম পাওয়া যায় না। PIA-র বিমান তালিকায়ও VC10এর কোনও উল্লেখ নেই। অতএব ইসলামাবাদ-লন্ডন পথে কোনও VC-10 বিমান ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ নেই। আর লন্ডন-ঢাকা পথে যে কমেট বিমান ব্যবহার করা হয়েছিলো তা সর্বজনবিদিত।

এখানে তিনটা জিনিস খেয়াল করুন। প্রথমত, উপরে দেওয়া তথ্যসূত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, ইসলামাবাদ-লন্ডন ও লন্ডন-ঢাকা পথে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিমানসংস্থার দুটি ভিন্ন মডেলের বিমান ব্যবহার করা হয়েছিল, পুরো পথ একটি বিমানে যাত্রা করা হয়নি। কিন্তু প্রকাশিত খবরে পুরোটি পথ একই বিমানে যাত্রা করা হয় এমনটি দাবি করা হয়েছে: “ডিসি-১০ বিমানের ভিআইপি লগবুক পরীক্ষা করে দেখা যায়, বিমানটিতে চড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে করাচি থেকে লন্ডন ও পরে লন্ডন থেকে ভারত হয়ে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন।”

দ্বিতীয়ত, সংবাদে যেহেতু ওই বিমানটি ‘ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের প্রকাশ্য নিলাম থেকে’ কেনার কথা বলা হয়েছে, অতএব বিমানটি যদি বাস্তবিকই বঙ্গবন্ধুর যাত্রায় ব্যবহৃত হয়েই থাকত, তা হতে পারত শুধুমাত্র লন্ডন-ঢাকা পথেই। কারণ প্রথম অংশে পাকিস্তান-ইংল্যান্ড যাত্রার বিমানটি অসামরিক বিমানসংস্থা Pakistan International Airlines এর মালিকানাধীন ছিল।

তৃতীয়ত, সংবাদে করাচি থেকে লন্ডন যাত্রার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যাত্রা করেছিলেন ইসলামাবাদ-রাওয়ালপিন্ডি যুগ্ম শহরের লাগোয়া ইসলামাবাদ বিমানবন্দর থেকে, করাচি থেকে নয়।

অতএব ‘ওই বিমানটির ভিআইপি লগবুক পরীক্ষা করে’ বঙ্গবন্ধুর করাচি-লন্ডন ও লন্ডন-ঢাকা যাত্রার উল্লেখ খুঁজে পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত, যে ‘ক্যাপ্টেন মোস্তফা আজিম আওলাদ’ জেনে-শুনে সম্পূর্ণ মিথ্যা একটি দাবি সংবাদসংস্থাগুলোর ও সরকারের কাছে উপস্থাপিত করছেন। জানা যাচ্ছে তিনি ইতিমধ্যেই এই অসত্য দাবিকে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করা শুরু করে দিয়েছেন: “তিনি বিমানটি অনেকটা ফাংশন রুমের মতো করে সাজিয়েছেন এবং নানা অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দিচ্ছেন। আর ঢাউস আকারের ওই ডিসি-১০ বিমানে একসঙ্গে ১৩০ জন মানুষ বসে খাওয়া-দাওয়া করতে পারে। বর্তমানে ভাড়া বাবদ যে টাকা তার রোজগার হয় তার পুরোটাই তিনি ব্যয় করছেন বিমানটি রক্ষণাবেক্ষণের কাজে।”

এবং তার ‘মানবিকতা’র কথা শুনে আবেগে উৎফুল্ল হয়ে কিছু সাংবাদিক এরকম অনেক সংবাদও প্রকাশ করছেন। 

ক্যাপ্টেনের এই ইচ্ছাকৃত মিথ্যা মানবিকতা প্রদর্শনের পেছনে নাম-যশ অর্জন বা সরকারের নেক-নজর প্রাপ্তি ছাড়া আর কোনও কারণ থাকতে পারে কি না, সংবাদসংস্থাগুলোর তা খতিয়ে দেখা উচিত হবে।

লেখক:
মাহবুবুর রহমান জালাল, সেন্টার ফর বাংলাদেশ জিনোসাইড রিসার্চ এর প্রতিষ্ঠাতা ও গবেষক।
ডঃ কৌস্তুভ অধিকারী, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে পরিসংখ্যান ও জেনেটিক্স এর গবেষক।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ