X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় কীভাবে?

সাইফুল হোসেন
২৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৯:৪৮আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৯:৪৮

ব্যবসানির্ভর বর্তমান বিশ্বে টিকে থাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু হচ্ছে অর্থ বা টাকা। একটি বিষয় প্রায়ই দেখা যায়, বেশিরভাগ লোক টাকাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের পরিবর্তে শুধু আয় ও ব্যয় এই দুটি জিনিসের ওপরেই বেশি গুরুত্ব প্রদান করে। অর্থাৎ টাকার ব্যবহার, সম্পদ বৃদ্ধির পরিবর্তে শুধু আয় ব্যয়ের গণ্ডিতেই আটকে থাকে।

মনে রাখা প্রয়োজন, আপনি হয়তো অনেক টাকা আয় করছেন, কিন্তু সঠিক উপায়ে যদি টাকাগুলো ব্যবহার ও বিনিয়োগ না করেন, তাহলে যে কারও অবস্থা মাইক টাইসনের মতো হবে। মাইক টাইসনকে চিনতে পারছেন তো? এই বিখ্যাত বক্সার তাঁর ক্যারিয়ারে ৩০ কোটি ডলারেরও বেশি আয় করেন। তবু ২০০৩ সালে তিনি দেউলিয়ায় পরিণত হন। এর পিছনের মূল কারণ ছিল টাকার উপযুক্ত ব্যবহার করতে না পারা। মাইক টাইসন টাকা আয় করতে পেরেছেন, কিন্তু টাকার ব্যবহার করতে শিখেননি। যাহোক, টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে নিচের দশটি বিষয় অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।

এক. মাদককে না বলতে হবে। যেকোনও মাদক, এমনকি সিগারেটকেও না বলতে হবে। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় অনেকেই সিগারেটে দু-এক টান দিয়ে থাকি। তবে সেটা যদি অভ্যাসে পরিণত হয়, তার প্রভাব শুধু আপনার শরীরের ওপরেই নয়, মানিব্যাগের ওপরেও পড়বে। উদাহরণস্বরূপ ধরুন, একজন স্মোকার প্রতিদিন কমপক্ষে এক প্যাকেট সিগারেট খায়। এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ২৮০ টাকা। তাহলে সপ্তাহে তার খরচ হচ্ছে কত? ২৮০*৭= ১৯৬০ টাকা, বছর শেষে সেই খরচ দাঁড়াচ্ছে ৯৪,০৮০ টাকায়। এবার আপনি চিন্তা করুন, এই টাকা আপনার হাতে দিলে  কী করতে পারতেন? তাই সঙ্গদোষ বা কৌতূহল থেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকে না যাওয়াই ভালো।

দুই. আয়ের থেকে ব্যয় কম করুন। অনেক সময় আয় বৃদ্ধি হলেই ব্যয় করার একটি প্রবণতা জন্ম নেয়। কিন্তু আয় ও ব্যয় এই দুটি বিষয়েই নজরদারিতে রাখা খুবই জরুরি। এটি সত্য যে অধিকাংশ মানুষের টাকা হাতে পেলে আর কোনও হুঁশ থাকে না। অবশ্য এর পিছনে দুটি কারণ সবচেয়ে বেশি দায়ী। প্রথমত হচ্ছে, আত্মসম্মানবোধের অভাব, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অন্যকে ইমপ্রেস করার প্রবণতা। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের মতামত ও সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। যাদের আত্মসম্মানবোধ কম থাকে, তাঁরা মনে করে তাঁদের আশপাশের লোকজনের পেছনে খরচ না করলে চলবে না। এই চিন্তা থেকেই তারা আশপাশের লোকদের পেছনে অযাথিত খরচ করতে থাকে। তাই নিজের সম্মান বা আত্মসম্মান ধরে রাখুন, অন্যদের তুলনায় নিজেকে ছোট মনে করা বন্ধ করুন। অন্যকে ইমপ্রেস করার বিষয়টি আরও ভয়ংকর। একজন সফল উদ্যোক্তাকেও যদি আপনি কোনও মিটিংয়ে সবার সামনে বলে বসেন যে- আপনার ব্যবসা এর থেকে বেশি দাঁড়াবে না। সে হয়তো তার জমি বিক্রি করে একটা গাড়ি কিনে ফেলবে। কেন? শুধু আপনার কথাকে নাকচ করে সবাইকে ইমপ্রেস করার জন্য। মনে রাখতে হবে, সফল হতে হলে, এ ধরনের ভুল কখনোই করা যাবে না। 

এ প্রসঙ্গে পারসোনাল ফাইন্যান্স এক্সপার্ট ডেইভ রামজি একটা কথা বলেছেন, আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেক কিছু কিনি এবং সাধ্যের বাইরে অর্থ ব্যয় করি শুধু অন্যকে ইমপ্রেস করতে, যাদের আমরা নিজেরাও পছন্দ করি না। এই বিষয়টি গভীরভাবে খেয়াল রাখার চেষ্টা করুন।  

তিন. বিনিয়োগ করুন বুঝে-শুনে। বিনিয়োগে সবসময় হতে হবে কৌশলী। অনেকেই বন্ধুর পরামর্শে কিংবা বিভিন্ন স্টকের ওপর অযথা ভরসা করে বিনিয়োগ করে ফেলেন। অনেকেই আবার রিয়েল এস্টেটের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসী। অনেকেই মনে করেন, কোনোভাবে একটা প্রপার্টি দাঁড় করাতে পারলেই হলো, প্রতি মাসে ভাড়া আসবে কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দক্ষ বিনিয়োগকারীদের কাতারে নিজেকে নিয়ে যেতে হলে সবসময় বিনিয়োগের আগে আদ্যোপান্ত যাচাই করে নিতে হবে। যেখানে বিনিয়োগ করবেন, সে ব্যাপারে একটু গবেষণা করতে হবে।

চার. দ্রুত ধনী হওয়ার পরিকল্পনা খোঁজা থেকে বিরত থাকা ভালো। ধনী হবার ফন্দিতে পা দিলে তো নিশ্চিতভাবে টাকা হারাতে চলেছেন। বাস্তবতা হলো ধনী হওয়া মজার খেলা নয়। ইংরেজিতে একটি কথা প্রচলিত আছে, Quick money brings quick problems।  দ্রুত ধনী হবার যে স্কিমগুলো আছে, যেমন পঞ্জি স্কিম, পিরামিড স্কিম ইত্যাদি এই স্কিমগুলো থেকে দূরে থাকা জরুরি। এগুলোতে শুধু তারাই লাভবান হয়, যারা প্রলোভন দেখিয়ে বিনিয়োগ করাচ্ছে। ধরা যাক, আপনাকে কেউ অফার দিচ্ছে দশ হাজার টাকার বিনিয়োগ এক মাসে এক লাখ টাকায় পরিণত হবে। আপনি ভেবে দেখুন, এটা কি কখনও সম্ভব? এক লাখ টাকা আয় করতে  হয়তো সময় প্রয়োজন হয়েছে এক বছর। সেখানে তারা একমাসে দিয়ে দিচ্ছে, বিষয়টি কেমন না? সাবধানে দেখে-শুনে ব্যবসায় নামুন। কাউকে অযাচিত বিশ্বাস করা যাবে না।

পাঁচ. কিছু টাকা সবসময় জমিয়ে রাখা জরুরি। জীবন বড়ই অদ্ভুত, সবসময় আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী চলবে না। মাঝে মাঝে এমন সময় আসতেই পারে, যখন আপনার টাকা ওই মুহূর্তেই লাগবে। ধরুন, রাস্তায় গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলো, বিনা নোটিশেই চাকরি চলে গেলো, তখন টাকার প্রয়োজন। তাই কিছু টাকা সবসময় জমিয়ে রাখতে হবে, যাকে আমরা আপৎকালীন টাকা বলে থাকি। এক্ষেত্রে আপনার বসের সাথে বসে, নিজ বেতন থেকে দশ পার্সেন্ট অটোমেটিক ডিডাকশনের ব্যবস্থাটি আপনি গ্রহণ করতে পারেন। যার মাধ্যমে আপনার বেতনের একটা নির্দিষ্ট অংশ ইমারজেন্সি সেভিংস অ্যাকাউন্টে জমা হবে।

ছয়. আয়ের বিভিন্ন উৎস থাকতে হবে। অধিকাংশ মানুষের আয়ের একটি মাত্র উৎস থাকে। আর টাকা শুধু সেখান থেকেই আসে। কিন্তু চাকরি কখনোই অতটা নির্ভরশীল পেশা নয়, যতটা ধারণা করা হয়। শুধু ২০১৮ সালে ইউএস বিজনেস থেকে একুশ মিলিয়নেরও বেশি কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। কোভিডের কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কত মানুষের চাকরি চলে গেছে এই বাংলাদেশে। তাই অন্য উৎস ঠিক করে রাখতে হবে। নিজেকে গাছের সাথে তুলনা করুন। গাছ যেমন সবদিক থেকে ফল দেয়, তেমনি আপনার আয়েরও উৎস বিভিন্ন দিক থেকে থাকতে হবে।

সাত. ক্রেডিট কার্ডের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। অনেককেই দেখা যায় ক্রেডিট কার্ডের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে থাকেন। হয়তো কারও কারও জন্য ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন সুবিধাজনক। তবে সবার জন্য কিন্তু বিষয়টি একরকম নয়। বরং, ক্রেডিট কার্ড আর্থিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ক্রেডিট কার্ড আপনাকে যখন তখন খরচ করতে উৎসাহিত করে। তাই আপনার জন্য ক্যাশ পেমেন্ট করাই উত্তম। কারণ, ক্যাশে পেমেন্ট করলে যখন টাকা আপনার পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন চিন্তা মাথায় আসে। ক্রেডিট কার্ডে খরচ করলে মনে কোনও চিন্তাই আসে না।

আট. ক্যালকুলেটেড ঝুঁকি নিতে ভয় পাবেন না। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, নো রিস্ক নো গেইন। তাই টাকা উপার্জন করতে হলে ঝুঁকি নিতে হবে। তবে অবশ্যই সেটা মেপে মেপে, হিসাব করে। যেমন, আপনার সেভিংস অ্যাকাউন্টে টাকা রাখার থেকে যদি কোনও ভালো মিউচুয়াল ফান্ডে আপনি টাকা রাখেন তাহলে আপনার বেশি লাভ হবে। যদিও মিউচুয়াল ফান্ড ঝুঁকির বাইরে নয়।

নয়. টাকা জমা না রেখে বিনিয়োগ করুন। আপনি যদি টাকা ব্যাংকে জমান, সেটি একসময় মুদ্রাস্ফীতি জনিত কারণে মূল্য হারাবে। তাই দক্ষতার সাথে বিনিয়োগ করুন। শুধু খরচ ও ইমারজেন্সি ফান্ডের টাকাই সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখুন অথবা সেটি স্বল্পমেয়াদি এফডি করে রাখতে পারেন। কোনও পরিকল্পনা ছাড়া কোনও টাকা যদি কোথাও জমিয়ে রাখেন, তবে সেটি দিনে দিনে শুধু মুদ্রাস্ফীতি জনিত কারণে মূল্য হারাতে থাকবে।

দশ. অন্তত তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রাখুন। একের অধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রাখার চেষ্টা করুন। একটি ইমারজেন্সি ফান্ডের জন্য, একটি দৈনন্দিন বিল পরিশোধের জন্য, অন্যটিকে আমি বলি প্লে অ্যাকাউন্ট। যেখানে আপনি আপনার টাকা রাখবেন, এন্টারটেইনমেন্ট বা ভ্রমণের জন্য। চাইলে আরেকটি অ্যাকাউন্ট আপনি খুলতে পারেন, আনটাচেবল অ্যাকাউন্ট। এটা অনেকটাই হবে সেভিংস অ্যাকাউন্টের মতো। মাস শেষে আপনার বেতনের একটা অংশ সেখানে জমা হবে। কিন্তু আপনি ভুলেও সেখানে স্পর্শ করবেন না।

আশা করছি আমার এসব পরামর্শের সঙ্গে কেউ যদি চিন্তা করে যদি আরও নতুন কিছু খুঁজে পায় তাতে কোনও দোষ নেই।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
পাহাড় ধসে বাঘাইছড়ির সঙ্গে সারা দেশের যান চলাচল বন্ধ
পাহাড় ধসে বাঘাইছড়ির সঙ্গে সারা দেশের যান চলাচল বন্ধ
যুক্তরাষ্ট্রের ‘নেসা সেন্টার’ প্রতিনিধি দলের ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস পরিদর্শন
যুক্তরাষ্ট্রের ‘নেসা সেন্টার’ প্রতিনিধি দলের ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস পরিদর্শন
জাতিসংঘে বাংলাদেশের ‘শান্তির সংস্কৃতি’ রেজুলেশন গৃহীত
জাতিসংঘে বাংলাদেশের ‘শান্তির সংস্কৃতি’ রেজুলেশন গৃহীত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ