X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিপন্ন ‘প্রাণী’র নাম কেন নদী?

আমীন আল রশীদ
১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:০০আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:০০

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিপন্ন ‘প্রাণী’র নাম ‘নদী’। অথচ বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ—যাকে বলা হয় নদীমাতৃক। অর্থাৎ নদী যার মা। মা কখনও জড়বস্তু হয় না। মা একজন শরীরসর্বস্ব নারী। সেই নারী হচ্ছেন বাংলাদেশের নদীগণ এবং এই দেশের জনগণ তাদের সন্তান। কিন্তু এই মায়েদের এমনই দুর্ভাগ্য যে তাদের সন্তানরাই তাদের গলা টিপে হত্যা করে।

নদী যে প্রাণী, তার যে প্রাণ আছে এবং সংগত কারণে তারও যে মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার আছে, সেই স্বীকৃতি আমরা পাই ২০১৯ সালে হাইকোর্টের একটি রায়ের মধ্য দিয়ে—যে রায়ে আদালত বলেছেন, নদী হচ্ছে ‘লিভিং এনটিটি’ বা ‘জীবন্ত সত্তা’।

যদিও নদী যে জীবন্ত সত্তা বা তারও যে প্রাণ আছে, সেটি আমাদের প্রথম জানান রূপসী বাংলা ও প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ। তার অসংখ্য কবিতায় নদীকে তিনি ব্যক্তি বা মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

‘বঁইচির ঝোপ শুধু—শাঁইবাবলার ঝাড়

আম জাম হিজলের বন

কোথাও অর্জুন গাছ

তাহার সমস্ত ছায়া এদের নিকটে টেনে নিয়ে

কোন্ কথা সারাদিন কহিতেছে অই নদী?

বলেছেন, ‘এ নদী কে? ইহার জীবন হৃদয়ে চমক আনে।’ মানে নদী এখানে ব্যক্তি। ‘ইহার জীবন হৃদয়ে চমক আনে’। মানে নদীর জীবন আছে।

আরেকটি কবিতায় লিখেছেন:

‘জলপিপি চলে গেলে বিকেলের নদী

কান পেতে নিজের জলের সুর শোনে।’

মানে নদীর কান আছে। সে নিজের সুর শোনে। সুর তোলে। তার কণ্ঠ আছে।

প্রশ্ন হলো, যার প্রাণ আছে; যাকে বলা হচ্ছে মা—সেই মা কেন বিপন্ন? তার সন্তানরাই কেন তাকে গলা টিপে হত্যা করে? সেই সন্তানরা কি তাদের মাকে মা বলে স্বীকার করে না?

আমরা দেখতে পাই, ব্যক্তিজীবনে মানুষ এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দিতে চায় না। তার বসতবাড়ির সীমানায় প্রতিবেশী কেউ দেয়াল তুলতে গেলে সে সতর্ক থাকে যাতে তার জমির ভেতরে একটি ইটও না পড়ে। এমনকি তার ফসলের জমির আলেও কেউ কোদাল দিয়ে কোপ দিলে সে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ তার বাড়ির সামনে নদী, বাড়ির পেছনের খাল, বাড়ির পাশের বিল ও জলাশয় যখন দখল হয়; শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্যে দূষিত হয়—সে চুপ থাকে। সে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। কারণ, এই নদী, খাল, বিল ও জলাশয়কে সে তার নিজের মনে করে না। এখানে তার ওনারশিপ নেই। বরং সে নিজেও সুযোগ পেলে নদীর জায়গা দখল করে নিজের মালিকানা জমির পরিমাণ বাড়ায়।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৩(১) অনুচ্ছেদ বলছে, বাংলাদেশের যেকোনও ভূমির অন্তঃস্থ সকল খনিজ ও অন্যান্য মূল্যসম্পন্ন সামগ্রী; বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্বর্তী মহাসাগরের অন্তঃস্থ কিংবা বাংলাদেশের মহীসোপানের উপরিস্থ মহাসাগরের অন্তঃস্থ সকল ভূমি, খনিজ ও অন্যান্য মূল্যসম্পন্ন সামগ্রী; এবং বাংলাদেশে অবস্থিত প্রকৃত মালিকবিহীন যেকোনও সম্পত্তির মালিক প্রজাতন্ত্র বা রাষ্ট্র। আর ৭(১) অনুচ্ছেদ বলছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। ক্ষমতার মালিক জনগণ মানে হলো রাষ্ট্রের সকল সম্পদের পাহারা দেওয়ার মালিকও তারা। আবার ১৮ (ক) অনুচ্ছেদ বলছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। অর্থাৎ এখানে রাষ্ট্রকেও দায়িত্বশীল করা হয়েছে যে প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে।

সংবিধান অনুযায়ী দেশের সকল, সমুদ্র, প্রাকৃতিক জলাধার, বন (ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যতিরেকে), পাহাড়—সবকিছু মালিক হচ্ছে রাষ্ট্র, মানে জনগণ। সুতরাং এর রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষার দায়িত্বও তার। কিন্তু সেই জনগণেরই একটি অংশ যখন খাল, নদী, জলাশয়, পুকুর ভরাট করে; দখল করে; দূষণে বিপন্ন করে—তখন সংবিধান প্রদত্ত এই মালিকানাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তখন এটি প্রমাণিত হয় যে সংবিধান যাদের রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই জনগণ আসলে ক্ষমতা গ্রহণে রাজি নয় কিংবা তারা এই মালিকানা চায় না। চায় না বলেই সে তার মাকে বিপন্ন করে।

বাংলাদেশের নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি বিপন্ন হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোভিত্তিক উন্নয়নচিন্তা ও দর্শন। অর্থাৎ শুরু থেকেই নদী ও প্রাণ-প্রকৃতিবিরোধী একটি উন্নয়ননীতি ও দর্শন আমাদের নীতিনির্ধারকদের মগজে গেঁথে গেছে যে উন্নয়ন মানেই প্রকল্প। উন্নয়নের যে সংজ্ঞা বছরের পর বছর ধরে জনপরিসর তথা নাগরিকের মানসকাঠামোয় গেঁথে দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে কংক্রিট। যেমন, রাস্তা বানাও, সেতু ও কালভার্ট বানাও। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে দ্রুত যাও। মানুষও দ্রুত যেতে চায়। নৌপথে দ্রুত যাওয়া যায় না। ফলে রাস্তা বানাও। রাস্তা বানানো মন্দ কিছু নয়। কিন্তু সেই রাস্তা, সেতু ও কালভার্ট বানাতে গিয়ে কত শত নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট করা হলো—সেই পরিসংখ্যান কি রাষ্ট্রের কাছে রয়েছে?

সড়ক যোগাযোগ উন্নত করার নামে যে হাজার হাজার বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে, তার ফলে কত শত ছোট ছোট নদী ও খাল বিপন্ন হয়েছে; কত নৌপথ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে; কত শত খাল ও নদীতে মাছের প্রজনন ধ্বংস করা হয়েছে, সেই হিসাব করার সময় কি আসেনি?

যে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নেওয়া হলো হেমায়েতপুরে, সেখানে যাওয়ার পরে ওই ট্যানারি শিল্প যে এবার ধলেশ্বরী নদীকেও মেরে ফেলছে—তার জবাব দেবে কে?

আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার ওপর দিয়ে প্রবাহিত লবণদহ নদী একসময় লবলং সাগর নামে পরিচিত ছিল। কারণ, বর্ষার মৌসুমে একে সাগর মনে হতো। অথচ সেই সাগর এখন নদী বা খাল নয়, ড্রেন বা নর্দমা। নদী দখল করে এমনভাবে কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে যে এখন এই নদীকে দেখলে মনে হবে, এটি বোধহয় কারখানার ময়লা নিষ্কাশনের জন্য বানানো নিজস্ব ড্রেন। এটি এখন বিষের নহর। কারখানার ওয়াশিং, ডায়িং, কেমিক্যাল বর্জ্য, হাসপাতাল ও ওষুধ কারখানার বর্জ্য, মৃত পশুর দেহ থেকে শুরু করে আবাসিক এলাকার পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য—সবকিছুর গন্তব্য এই লবণদহ।

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেনের দাবি, পরোক্ষভাবে পাইপের মাধ্যমে লবণদহে দূষণ ঘটাচ্ছে আরও প্রায় পাঁচশ’ কারখানা। বাস্তবতা হলো, লবণদহ পাড়ে কতটুকু শিল্প কারখানা প্রয়োজন ছিল বা কী পরিমাণ কারখানা গড়ে তুললে এবং সেসব কারখানা থেকে কী পরিমাণ বর্জ্য এই নদীতে পড়বে, সেসব বিবেচনায় না নিয়ে ইচ্ছেমতো এই নদীর দুই তীরে এবং দখল করে কলকারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। সেই কারণে একদিকে দূষণ, অন্যদিকে দখল।

লবণদহ নদীর পূর্ব পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে একটি অ্যাসিড তৈরির কারখানা। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা কারখানায় তৈরি হচ্ছে অ্যাসিড। আর এই কারখানার তরল বর্জ্য গিয়ে সরাসরি পড়ছে নদীতে।

শিল্প-কারখানা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। কিন্তু শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার নামে গত তিরিশ বছরে দেশের কতগুলো নদী ও খাল হত্যা করা হয়েছে; বিপন্ন করা হয়েছে এবং ওই শিল্প-কারখানাগুলো গত তিন দশকে দেশের অর্থনীতির বিকাশে যে ভূমিকা রেখেছে তার বিনিময়ে পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির যে ক্ষতি করলো, তার পরিমাণ কত; টাকায় কনভার্ট করলে সেটি কত হাজার বা লক্ষ কোটি টাকা হবে—সেই হিসাব কি কারও কাছে আছে?

মুশকিল হলো, কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যে একটি বিরাট ইস্যু, সেটি উদ্যোক্তারা সচেতনভাবেই এড়িয়ে যান। কারণ, সঠিক নিয়মে বর্জ্য পরিশোধন করতে গেলে ইটিপি বসাতে হয়, যেটি বাড়তি খরচ। কারখানার মালিকরা অনেক সময়ই এই বাড়তি খরচ করতে চান না। যে কারণে তারা কলকারখানা গড়ে তোলেন নদীর পাড়ে, যাতে বর্জ্যগুলো সরাসরি নদীতে ফেলা যায়।

রাষ্ট্রের অনুমোদন নিয়েই এসব কলকারখানা চলে। রাষ্ট্রের চোখের সামনেই নদী-খাল-বিল-জলাশয় ভরাট হয়, দূষিত হয়। কিন্তু রাষ্ট্র কালেভদ্রে দুয়েকটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও এর বিরুদ্ধে জোরালো কোনও পদক্ষেপ নেয় না। কারণ, এসব শিল্প-কারখানা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। কিন্তু একটি নদী খুন হলে সেই দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং সামগ্রিকভাবে সমাজ ও সংস্কৃতিতে যে প্রভাব পড়ে—রাষ্ট্র কি সেটির হিসাব কখনও করেছে? নাকি রাষ্ট্র শুধু তার মাথাপিছু আয় আর জিডিপির প্রবৃদ্ধি দিয়েই উন্নয়ন ও অগ্রগতির পরিমাপ করবে?

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ