X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমি জানি না’

প্রভাষ আমিন
২২ মে ২০১৬, ১২:২০আপডেট : ২২ মে ২০১৬, ১২:৩০

প্রভাষ আমিন বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নানা ঘটনাপ্রবাহে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। পরে তিনি ধাপে ধাপে বিএনপি গঠন করে রাজনীতিতে আসেন। আওয়ামী বিরোধী শক্তির জগাখিচুড়ি করে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় দলটি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ঘটনাচক্রে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার গৌরব অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পেয়েছেন বীরউত্তম খেতাব। কিন্তু ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেন। প্রধানমন্ত্রী বানান রাজাকার শাহ আজিজকে। মন্ত্রিত্ব দেন একাত্তরে ‘মানুষ খেকো’ হিসেবে পরিচিত আবদুল আলিমকে।
সেই ধারাবাহিকতায় বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয় মতিউর রহমান নিজামী আর আলী আহসান মুজাহিদের। মোটা দাগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী অংশের আশ্রয়স্থল, আর আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পক্ষের। কিন্তু বীরউত্তর জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দলটি কেন স্বাধীনতা পক্ষের মাঠটি আওয়ামী লীগকে ছেড়ে দিল, তা আমার কাছে আজও এক রহস্য। আদর্শিক অবস্থান যাই হোক, বিএনপি বাংলাদেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীর প্রিয় দল। কমবেশি ৩৫ শতাংশ ভোট আছে তাদের। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। কিন্তু গত ৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকে বড় বেশি ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে।
এই ছন্নছাড়া দশা দেখে দলটির জন্য আমার মায়াই লাগছে। একের পর এক ধাক্কায় দলটি রীতিমত বিপর্যস্ত। সরকারি দল বিএনপিকে বিপাকে ফেলতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। রাজনীতি অনেকটাই কৌশলের খেলা। এই খেলায় বারবারই হেরে যাচ্ছে বিএনপি। তবে বিএনপিকে বিপাকে ফেলতে সরকারকে খুব একটা কিছু করতে হচ্ছে না। বিএনপি বারবার নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই আটকে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের পর আমি তার কোনও ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে লেখাও লিখেছিলাম। কিন্তু পরে দেখা গেল শফিক রেহমান ঠিকই যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে এফবিআই এজেন্টের সঙ্গে সজিব ওয়াজেদ জয়ের বিষয়ে কথা বলেছেন, তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তিনি নিজে বাসায় রাখা গোপন দলিল পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন।

আরও পড়তে পারেন: সম্প্রতি সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডে আ.লীগ জড়িত: খালেদা জিয়া

তবে সর্বশেষ ধাক্কাটা বিএনপিকে টালমাটাল করে দিয়েছে। বিএনপি এমনিতে মুসলিম মৌলবাদীদের আশ্রয়স্থল। কিন্তু এই বিএনপির এক নেতা যখন ইসরায়েলের ক্ষসমতাসীন লিকুদ পার্টির এক নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন, তখন ইসলাম নিয়ে বিএনপির কথাবার্তাকে মায়াকান্নাই মনে হয়, মনে হয় পুরোটাই বিএনপির মুখোশ। প্যালেস্টাইনে ভূমি দখল করে গড়ে ওঠা ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ইসরায়েল যেভাবে যুগের পর যুগ ফিলিস্তিনিদের ওপর নিষ্পেষণ চালিয়ে আসছে, তাতে দূর ভবিষ্যতেও কখনও ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গড়ার সম্ভাবনা নেই। বরং ইসরায়েলের জন্য বাংলাদেশের জনগণ হৃদয়ে শুধু ঘৃণাই পোষণ করে। তো এই ইসরায়েলের সঙ্গে বিএনপির নবমনোনীত যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর বৈঠকের খবর বিএনপির জন্য গুরুতর ধাক্কা, সন্দেহ নেই। আসলাম চৌধুরী বিএনপির খুব পরিচিত মুখ নন। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুগ্ম মহাসচিব পেয়ে আলোচনায় চলে আসেন তিনি। পত্রিকায় পড়েছি, রাজপথে বিএনপির নাশকতার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন আসলাম চৌধুরী। আর এর পুরস্কার হিসেবেই তিনি এত বড় পদ পেয়েছেন। আসলাম চৌধুরী ভারতের আগ্রায় ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির নেতা মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করেছেন, এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। কারণ সাফাদির সঙ্গে আসলামের নানা ছবি এখন সবার হাতে হাতে। ছবি শুধু একটি বৈঠকের নয়। সেমিনারে, ডিনারে, ঘোরাঘুরিতে নানা ভঙ্গির অসংখ্য ছবি আছে। তার মানে সাফাদির সঙ্গে আসলামের দেখা হওয়াটা হুট করে নয়, তারা ভারতে দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাটিয়েছেন। গ্রেফতার হওয়ার আগে আসলাম চৌধুরী সাফাদিও সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা অস্বীকার করেননি। তবে দাবি করেছেন, সেখানে কোনও ষড়যন্ত্র ছিল না। সত্যিই আসলাম চৌধুরী সাফাদির সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন কিনা, তা প্রমাণের অপেক্ষায়। তবে ইসরায়েলের কারও সঙ্গে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের একজন সিনিয়র নেতার বৈঠকই যথেষ্ট আপত্তিকর, ষড়যন্ত্র হোক আর না হোক। তবে সাফাদি যে অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক মহলে লবিং বা ষড়যন্ত্র করছেন, তা প্রমাণিত। গতবছর সাফাদি এক সাক্ষাৎকারে তা স্বীকারও করেছেন। সাফাদি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সমালোচনা করে বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা, সংখ্যালঘু নির্যাতনের নানা কথা বলেছেন। বর্তমান সরকারকে উৎখাত করলে, নতুন সরকার এসে ইসরায়েলের স্বার্থ দেখবে; এমন আশাবাদের কথাও বলেছেন সাফাদি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে বিএনপিই আসার কথা। তার মানে সাফাদির আশাবাদের ভিত্তি বিএনপিই। সাফাদি তার সাক্ষাৎকারে মি. রহমান নামে বিএনপির এক নেতার সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলেছেন। এই মি. রহমান কে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে তারেক রহমানের নাম।

সাফাদি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। খুবই ভালো কথা। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নানা নির্যাতন চলছে, এটা মিথ্যা নয়। আমরাও সবসময় এর বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু ইসরায়েলের কেউ যখন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন আমার খালি মনে হয়, মাছের মায়ের পুত্রশোক, প্রবচনটি। আর যেই হোক, অন্তত ইসরায়েলের কারও বিশ্বের কোথাও কোনও ধরনের নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক অধিকার নেই। আর তিনি সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য কথা বলছেন কার সঙ্গে? বিএনপির একজনের সঙ্গে। হা হা হা...

আরও পড়তে পারেন: শ্যামল কান্তিকে ঢাকা মেডিক্যালে ঢুকে হত্যার আহ্বান ফেসবুকে!

মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। সংখ্যালঘুদের নানাভাবে নির্যাতন করে, হেয় করে, কোনঠাসা করে দেশছাড়া এবং তাদের জমিজমা দখল করা বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এই প্রবণতা। এর বিরুদ্ধে আমরা সবসময়ই সোচ্চার। আমার ঠিক আগের লেখা ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের গ্লানি’তেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছি। কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে আওয়ামী লীগ তুলনামূলকভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয়। এই রাগে বিএনপি বরং সংখ্যালঘুদের সবসময় সন্দেহের চোখে দেখে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরপর দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের যে স্টিম রোলার চলেছিল, তা এখন আতঙ্ক ছড়ায়। সাফাদি কি জানেন, সেই নির্যাতনের কথা। কেউ যেন ভাববেন না, আমি বর্তমান সরকারের আমলে সংখ্যালঘু নির্যাতনের পক্ষে সাফাই গাইছি। বরং আমি সবসময় চাই, বাংলাদেশে সব ধর্মের, সব গোত্রের, সব বর্ণের মানুষ মিলেমিশে থাকুক। সব মানুষকে যেন মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু, এভাবে যেন মানুষকে আলাদা করা না হয়। আমরা চাই, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন এবং তাদের দেশত্যাগ শূন্যের কোটায় নেমে আসুক। কিন্তু বিএনপি যখন সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের কারও সঙ্গে বৈঠক করে, তখন সেটাকে ষড়যন্ত্রই মনে হয়।

আরও পড়তে পারেন: বিএনপি-ইসরায়েল ষড়যন্ত্র কতটা সত্য?

বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা সবসময় জনগণের শক্তির ওপর বিশ্বাস করেন। কোনও ষড়যন্ত্রে নয়। কিন্তু বিএনপির অতীত ইতিহাস এই দাবির পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয়েছিল বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে এবং এখন জানা যাচ্ছে, সরকারের শীষ মহলও জড়িত ছিল সেই ষড়যন্ত্রে। তাই বিএনপি এখন যতই বলুক, তারা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব অস্বীকার করুক, মানুষ তা বিশ্বাস করবে না। বিএনপি এখন যতই বলুক, আসলাম চৌধুরীর ভারত সফর তার ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক; এর সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই, তাও মানুষ বিশ্বাস করবে না। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব যত বড় ব্যবসায়ীই হোন না কেন, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হতো সাবধানে। ব্যক্তির দায় দলকে নিতেই হবে। দেশটা যেহেতু ইসরায়েল, তাই সহজে তা ঝেড়ে ফেলাও সম্ভব নয়। বিএনপি যতবার বলবে, ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই, মানুষ ততই সন্দেহ করবে। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। দুই গ্রামের মানুষের মধ্যে সবকিছু নিয়ে প্রতিযোগিতা। দুই গ্রামে দুটি স্কুল। ঠিক হলো,  দুই শিক্ষকের মধ্যে জ্ঞানের লড়াই হবে। যিনি জিতবেন, জিতবে তার গ্রাম। দুই গ্রামের সব মানুষ জড়ো হলো মাঠে। লড়াইয়ের শুরুতেই এক শিক্ষক প্রতিপক্ষকে বললেন, আমি একটা ইংরেজি বাক্য বলবো। আপনি সবাইকে শুনিয়ে তার উত্তর বলবেন। প্রথম শিক্ষক দ্বিতীয় শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন তো- ‘I don’t know’ অর্থ কী? দ্বিতীয় শিক্ষক জোরে বললেন, আমি জানি না। ব্যস প্রথম শিক্ষকের গ্রামের লোকজন হই হই করে উঠলো, জানে না, জানে না। দ্বিতীয় শিক্ষক কিছু বলারই সুযোগ পেলেন না। বিএনপির দশা হয়েছে এখন তাই। এই চালটাতেও বিএনপি হেরেই গেছে।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ