X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বর্ষণ মন্দ্রিত দিনে নায়করাজের প্রস্থান

বিধান রিবেরু
২২ আগস্ট ২০১৭, ১৩:০৭আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০১৭, ১৭:৩৪

বিধান রিবেরু ‘আমার শেষ ইচ্ছা আছে অভিনয় করতে করতেই যেন আমার মৃত্যু হয়। এমনকি মৃত্যুর পরও কিছুটা বাস্তব দৃশ্য ধারণ করা হবে অভিনয়ের জন্য। এছাড়া ‘দাফন-কাফন’ নামে আমার জীবনের উপর একটি ডকুমেন্টারি তৈরি হচ্ছে। যার শেষ দৃশ্য চিত্রায়ন হবে আমার মৃত্যুর পর’। কথাগুলো মৃত্যুর বছর তেরো আগে, ২০০৪ সালে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন সদ্য প্রয়াত নায়ক রাজ রাজ্জাক।
একজন জাত অভিনেতার চাওয়া তো এমনটাই হবে। মরণোত্তরও তিনি অভিনয় করতে চান, সত্যি সত্যি লাশের অভিনয়। এমন অভিলাশ অন্য কোনও অভিনেতার ছিল কিনা জানা নেই। তবে এটা বিস্ময়ের সঙ্গে বলতেই হয় রাজ্জাক যেন মৃত্যুর পরও অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। নব্বই দশকের পর থেকেই চলচ্চিত্রে অনিয়মিত হয়ে পড়েন তিনি। শারীরিক অসুস্থতার কারণ আছে, তাছাড়া চলচ্চিত্র শিল্পও ততদিনে বাঁক নিতে শুরু করেছে। উঁকিঝুকি মারতে শুরু করেছে অশ্লীলতা। চলচ্চিত্রকে মুনাফা সর্বস্ব করে দেখার লোকের আনাগোনা ততদিনে বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। নায়ক হিসেবে নয়, চরিত্রাভিনেতা হিসেবে রাজ্জাকের উপস্থিতি দেখা যায় নব্বইয়ের দ্বিতীয় ভাগে। তবে সেই ধরনের চিত্রনাট্যের সংখ্যা বেশি বাড়তে পারেনি, আধুনিক কালের নকল সর্বস্ব চিত্রনাট্যকারদের দৌরাত্মে। অথচ বলিউডে অমিতাভ বচ্চনকে কেন্দ্র করে এখনও চিত্রনাট্য লেখা হয়, সেটিকে নিয়ে ছবি করার সাহস করেন প্রযোজকরা।
এসব বলে এখন আর লাভ নেই, কারণ গতকাল ২১ আগস্ট না ফেরার দেশে চলে যান ষাটের দশকের সাদাকালো পর্দার রোমান্টিক নায়কটি। অনেকেই তাকে ওপার বাংলার উত্তম কুমারের সঙ্গে তুলনা করতেন। করাটা অসঙ্গত ছিল না। উত্তমের মতো পোশাক, চুলের ছাট, এমনকি অভিনয়ের ধরন। এসব ছাপিয়ে তৎকালের রাজ্জাক অভিনীত ছবির যে মূল সুর মেলোড্রামা সেটির উপস্থিতি উত্তমের ছবিতেও কম ছিল না। উত্তমভক্ত রাজ্জাক অবশ্য বলেন, সচেতনভাবে তিনি কখনও মহানায়ককে অনুকরণ করতে যাননি। রাজ্জাক যখন নায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন পূর্ব পাকিস্তানের ছবিতে, তখন উত্তম চলচ্চিত্র জগতে এক যুগের বেশি সময় কাটিয়ে ফেলেছেন।
নায়ক হিসেবে রাজ্জাকের হাতেখড়ি বাংলাদেশের, আমি বলি একমাত্র গেরিলা চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের হাতে। ছবির নাম ‘বেহুলা’ (১৯৬৪)। রায়হানের সঙ্গে রাজ্জাকের উল্লেখযোগ্য কাজ ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। এই ছবির শুটিং চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজ্জাক ও জহির রায়হানকে ঢাকার সেনানিবাসে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে ছবি প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু বেশ সাহসিকতার সঙ্গেই জহির রায়হান তখন জবাব দেন, বলেন, ছবিতে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা দেখবে সেন্সর বোর্ড! এই ছবি নিয়ে অবশ্য পরেও জল কম ঘোলা হয়নি। ছাড়পত্রই দেওয়া হচ্ছিল না বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন নিয়ে রূপকধর্মী এই ছবিকে। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের মুখে এই ছবি ছাড়পত্র পায়।

‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির মতো আরো বহু ছবিতেই রোমান্টিক নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, ঠোঁট মিলিয়েছেন বহু রোমান্টিক গানে, যা জনপ্রিয়তা পেয়ে অতিক্রম করে গেছে কালকে। শুধু রোমান্টিকতা নয়, অ্যাকশন ধাঁচের নায়ক চরিত্রও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রথম ফুটিয়ে তুলেছিলেন রাজ্জাক। যেমন: ‘রংবাজ’ (১৯৭৩); এই ছবিতে তিনি পর্দায় হাজির হন রাগি যুবকের চেহারায়। যদিও গ্রামের বিদ্রোহী যুবকের চরিত্রে রাজ্জাককে সবসময়ই হারিয়ে দিয়েছেন মিয়াভাই খ্যাত ফারুক। অবশ্য ‘ক,খ,গ,ঘ,ঙ’ ছবিতে রাজ্জাককে অসফল বলা যাবে না। ছবিটিতে রাজ্জাকের নায়িকা ছিলেন কবরী।

কবরী আরো বহু ছবিতে রাজ্জাকের নায়িকা হয়েছেন। তারা দু’জন যেন এই বাংলার উত্তম-সুচিত্রা। রাজ্জাক-কবরী শুরু থেকেই জুটি হিসেবে খ্যাতি পান। সুভাষ দত্তের ‘আবির্ভাব’ ছবি দিয়ে তাঁদের জুটি গড়ে ওঠে। তখন দুজনের মধ্যে বন্ধুসুলভ খুনসুটি চলতো। বন্ধুত্ব ছিল, আবার পেশাদারী জায়গা থেকে প্রতিযোগিতাও ছিল। কিন্তু পরে এসে সম্পর্কটি আর শুদ্ধ মধুর থাকেনি, অম্লও যোগ হয়েছে। কবরীর লেখা ‘স্মৃতিটুকু থাক’ জীবনীতে রাজ্জাকের জন্য বরাদ্দ একটি অধ্যায়ে এই অম্ল-মধুর সম্পর্কের কথা জানা যায়। তবে কবরী যে একসময় রাজ্জাকের প্রেমে পড়েছিলেন সেটাও স্বীকার করেছেন অকপটভাবে। কবরী রাজ্জাকের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় প্রসঙ্গে বলছেন, “এখন মনে হয়—আসলে কি ওই ভালোলাগার মধ্যে ভালোবাসা ছিল না? শুধুই কি অভিনয়? ভালো লাগতে লাগতেই তো ভালোবাসা হয়, অভিনয় করতে করতে যদি ভালোবাসা না-ই হয় তাহলে মানুষের মনে ভালোবাসা তৈরি হবে কী করে? সিনেমামোদী যারা এসব সিনেমা দেখেছেন তারাও হয়ে যেতেন রাজ্জাক আর অপরপক্ষ নিজেকে ভাবত কবরী, তাই না?” 

বড়পর্দার শক্তি আসলে এমনই। দর্শক নিজেদেরকে বসিয়ে দিতে চান চরিত্রের জায়গায়, সেখানে বসে সে বাসনা করে অপর পক্ষকে। নায়ক রাজ্জাকের হয়ে কত পুরুষই না সেসময় স্বপ্ন দেখেছেন সুচন্দা, কবরী, শাবানা, ববিতা কিম্বা নূতনকে নিয়ে। যে কথা বলছিলাম, শহুরে রোমান্টিক নায়ক হিসেবে রাজ্জাক যেমন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে উত্তম কুমারের বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন এ অংশের দর্শকের মানসপটে, তেমনি গ্রামের যুবকের চরিত্রেও তিনি ব্যর্থ হননি। ‘অশিক্ষিত’ (১৯৭৮) আর ‘ছুটির ঘণ্টা’ (১৯৮০)এই দুই ছবিই সেটার বড় প্রমাণ। নিজেকে অনবরত রাজ্জাক ভেঙেছেন। নব্বইয়ের দশকে এসে পাঁচ বছরের বিরতি দিয়ে ফিরেছেন চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। ‘বাবা কেন চাকর’ (১৯৯৭) ছবিটি দিয়ে রাজ্জাক বড় পর্দায় ফিরে আসেন রাজসিক ভাবেই।

১৯৪২ সালে কলকাতায় জন্মেছিলেন রাজ্জাক। ৬২ সালের দাঙ্গার আগে প্রখ্যাত অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়েছিলেন শুদ্ধ উচ্চারণের তালিম। টুকটাক অভিনয়ের শুরু তখন থেকেই। পরে ঢাকায় এসে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হয়েছে। তবে জহির রায়হান ছিলেন পাকা জহুরি, রাজ্জাককে নায়ক হিসেবে চিনে নিতে ভুল করেননি তিনি। জহির রায়হানের আবিষ্কার থেকেই রাজ্জাকের উত্থানের শুরু। এরপর অভিনয় করেছেন চার শতাধিক ছবিতে।

রঙিন যুগের রাজ্জাকের চেয়ে সাদাকালো যুগের রাজ্জাকই বেশি জনপ্রিয় এই বাংলায়। আর চরিত্রাভিনেতার চেয়ে রোমান্টিক রাজ্জাকই মানুষের মানসগোচরে বেশি অনুরণিত। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে অন্তত আশির দশক পর্যন্ত সামাজিক কাহিনী নির্ভর ছবির মাধ্যমে দুর্বার গতিতে ছুটেছে রাজ্জাকের জয়রথ। পরবর্তী সময়ে বড় পর্দায় সোহেল রানা, জসিম, বুলবুল আহমেদ, ফারুক, জাফর ইকবাল প্রমুখের আগমনে রাজ্জাকের একক সাম্রাজ্যে কিছুটা ভাটা পড়ে। তাতে অবশ্য জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকু। মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত দর্শকদের মাঝে রাজ্জাক প্রিয় তারকা হিসেবে স্থায়ী আসনটাই পেয়েছিলেন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কারখানায় রাজ্জাক এক এমন অধ্যায়ের নাম, যে অধ্যায়ে চলচ্চিত্রকে শুধু মুনাফাভিত্তিক শিল্প হিসেবে গোনা হতো না, শিল্পভিত্তিক শিল্প হিসেবেও দেখা হতো। ইংরেজি আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি দুই অর্থেই চলচ্চিত্র শিল্প সেসময় স্বর্ণালী যুগ পার করেছে বলে দারি করা হয়। বলিউড বা তেলেগু ছবির অন্ধ নকলের যুগ সেসময়ে ছিল না। ছিল না একারণে যে সেসময়ে ছবি বানাতেন সুভাষ দত্ত, নারায়ণ ঘোষ মিতা, খান আতাউর রহমান, আলমগীর কবির প্রমুখ। পরিতাপের বিষয় এখন প্রায় সকলেই ভারতমুখী হয়েছেন। রাজ্জাক অধ্যায়েও টালিগঞ্জকে অনুসরণ করা হতো, তবে নগ্নভাবে নয়। কিন্তু পরবর্তীকালে নগ্নভাবেই নকলের বেসাতি বেড়েছে। একারণে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে হতাশাই প্রকাশ করেছেন রাজ্জাক। বলেছেন, এদেশের চলচ্চিত্র যে ঘুরে দাঁড়াবে সেই অবস্থা নেই। এর কারণ অধিকাংশ চলচ্চিত্র পরিচালকই এখন মূর্খ। তবে পুরোপুরি নৈরাশ্যের হাতে সপে দেননি নিজেকে, আশা রাখা যেতে পারে বলেও রাজ্জাক মত দিয়েছিলেন মৃত্যুর দেড় বছর আগে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে। আমরাও আশা রাখতে চাই, রাজ্জাক অধ্যায়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যেন আরো দূর পর্যন্ত যেতে পারে।

রাজ্জাকের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পরই আকাশ কালো করে অশ্রু বর্ষণ শুরু হয়। শেষ শুটিংয়ের জন্য সেট প্রস্তুত। ক্যামেরাও তৈরি। প্রস্তুত নায়করাজও। পার্থক্য এই তিনি আর এই চরিত্র থেকে বেরুতে পারবেন না, আর কেউ বলবেন না ‘কাট, শট ওকে’।

সহায়:

১. রাজ্জাক, যেভাবে আমি নায়করাজ, চিত্র পরিচালক ও তারকাদের আত্মকথা, অনুপম হায়াৎ সম্পাদিত, তৃণলতা প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৬।
২. কবরী, স্মৃতিটুকু থাক, বিপিএল, ঢাকা ২০১৭।
৩. জাহীদ রেজা নূর, রাজ্জাক জীবন থেকে নেয়া, ছুটির দিনে, প্রথম আলো, ২৬ এপ্রিল ২০১৪, লিংক:  http://bit.ly/2xn5Ro5৪. সাক্ষাৎকার, এখনকার নির্মাতারা বেশির ভাগই মূর্খ : রাজ্জাক, এনটিভি অনলাইন, লিংক: http://bit.ly/2wyMviJ 

লেখক: চলচ্চিত্র গবেষক, সমালোচক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ