রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেনে আক্রমণ করেন তখন রুশ ভূখণ্ড থেকে যুদ্ধ অনেক দূরে বলে মনে হচ্ছিল। এরপরও কয়েকদিনের মাথায় সংঘাত রুশদের বাসা-বাড়িতে পৌঁছে যায় – অবশ্য তা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও কামানের গোলা নয়, কিন্তু পশ্চিমা সরকারের পক্ষ থেকে নজিরবিহীন ও অপ্রত্যাশিত ব্যাপক মাত্রায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।
২৪ ফেব্রুয়ারির আক্রমণের তিন মাস পর অনেক সাধারণ রুশ নাগরিক এই নিষেধাজ্ঞার খড়্গ নিজেদের জীবন-জীবিকা ও আবেগের ক্ষেত্রে অনুভব করছেন। একসময় মস্কোর বিশালাকার যেসব বিপনী বিতান পশ্চিমা বিক্রেতাদের দখলে ছিল এখন সেগুলো বন্ধ দোকানের বিস্তৃত ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
১৯৯০ দশকে রাশিয়ায় ম্যাকডোনাল্ড’স চালু হওয়া ছিল একটি সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ, সীমিত পছন্দের নাগরিকদের সামনে আধুনিক ও চাকচিক্যময় সুবিধা হাজির করে। সম্প্রতি রাশিয়া থেকে পশ্চিমা ব্র্যান্ডটির চলে যাওয়ার একমাত্র কারণ মস্কোর ইউক্রেনে আক্রমণ। আধুনিক ফার্নিচারের প্রতীকৃতি ইকিয়া তাদের পুরো কার্যক্রম বাতিল করেছে। চাকরি নিয়ে নিরাপত্তাবোধে থাকা লাখো মানুষ মাত্র কয়েকদিনে প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে গেছেন।
তেল জায়ান্ট বিপি ও শেল এবং গাড়ি নির্মাতা রেনল্টসহ বড় শিল্পগোষ্ঠী রাশিয়ায় ব্যাপক বিনিয়োগের পরও ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। রাশিয়ায় ব্যবসা বাতিলে শেলের লোকসানের পরিমাণ ৫০০ কোটি ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যখন দেশ ছাড়ছে, তখন অর্থনৈতিক সক্ষমতা থাকা হাজারো নাগরিকও রাশিয়া ছাড়ছেন। যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারের কঠোর কয়েকটি পদক্ষেপে ভীত হয়ে পড়েছেন তারা। অনেকে সরকারের এসব কর্মকাণ্ডকে পূর্ণাঙ্গ স্বৈরাচারিতা হিসেবে বিবেচনা করছেন। অনেক তরুণও ভয়ে দেশ ছেড়েছে। তাদের আতঙ্ক, ক্রেমলিন হয়ত যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে পারে।
কিন্তু একসময় রাশিয়া থেকে পালানো সহজ হলেও এখন আর তা নেই – রাশিয়ার সঙ্গে ফ্লাইট বাতিল করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশ, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র। এক সময় রুশদের অবকাশ যাপনের শহর হয়ে উঠেছিল এস্তোনিয়ার রাজধানী তালিন, বিমান পথে মস্কো থেকে মাত্র ৯০ মিনিটে যেতে পারতেন তারা। কিন্তু এখন তাদের ইস্তাম্বুল হয়ে সেখানে যেতে লাগে অন্তত ১২ ঘণ্টা।
এমনকি ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে রুশদের কাল্পনিক ভ্রমণও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। মার্চ মাসে ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম নিষিদ্ধ করে রাশিয়া – অবশ্য অনেকে ভিপিএন ব্যবহার করে এখনও তা ব্যবহার করতে পারছেন। বন্ধ করা হয়েছে বিবিসি, ভয়েস আমেরিকা, রেডিও ফ্রি ইউরোপ, ডয়চে ভেলের মতো পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট।
যুদ্ধ নিয়ে ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানোর দায়ে ১৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রেখে রুশ কর্তৃপক্ষ নতুন আইন জারির পর থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বতন্ত্র সংবাদমাধ্যম বন্ধ বা তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে। এগুলোর মধ্যে সম্প্রতি শান্তিতে নোবেল জয়ী দিমিত্রি মুরাতভের দৈনিক পত্রিকাও রয়েছে।
সাধারণ রুশ নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন, বিধিনিষেধ এবং সুযোগ সংকুচিত হওয়ার প্রভাব অনেক বেশি হতে পারে। যদিও তা পরিমাপ করা কঠিন। কয়েকটি জনমত জরিপে অবশ্য ইউক্রেনে যুদ্ধের জনগণের ব্যাপক সমর্থনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, অনেকেই হয়ত তাদের প্রকৃত মত জানাননি কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ার আশঙ্কায়।
কার্নেগি মস্কো সেন্টারের আন্দ্রেই কোলেসনিকভ এক নিবন্ধে জানিয়েছেন, রুশ সমাজ এখন কর্তৃপক্ষের কাছে চরমভাবে নতি স্বীকার করছে এবং সামাজিক বন্ধনের অবক্ষয় ত্বরান্বিত হতে পারে।
সূত্র: এপি