X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৬ বৈশাখ ১৪৩১

এত অগ্নিকাণ্ডের পরও কেন মানা হচ্ছে না ফায়ার সার্ভিসের নীতিমালা

কবির হোসেন ও আবির হাকিম
০৩ মার্চ ২০২৪, ২৩:০১আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৪, ২৩:০৩

গত বছর রাজধানীসহ সারা দেশে মার্কেট, শপিং মল ও আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। আহত হয়েছেন শত শত মানুষ। এসব ঘটনার ক্ষত কাটতে না কাটতে নতুন আরেকটি ট্র্যাজেডি দেখতে হয়েছে দেশবাসীকে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর দগ্ধ হয়েছেন অন্তত ২২ জন।

এ ঘটনায় প্রাথমিক তদন্ত সূত্র থেকে জানা গেছ, ভবনটিতে যে অগ্নিনিরাপত্তা থাকার কথা, তার ন্যূনতম ব্যবস্থাও ছিল না। শুধু গ্রিন কোজি কটেজ ভবনই নয়, অগ্নিকাণ্ডের পর অধিকাংশ ভবন তদন্ত রিপোর্টেই ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশ না মানা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকার চিত্র উঠে এসেছে। এত বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরও সচেতন হচ্ছে না ভবন মালিক ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না রেখেই দেদার ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

এত ঘটনার পরও কেন ফায়ার সার্ভিসের নীতিমালা মানা হচ্ছে না তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন?

ফায়ার সার্ভিসের একটি সূত্র বলছে, সংস্থাটির কাজ হলো কোনও ভবনে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা না রাখা হলে নীতিমালা অনুযায়ী ওইসব ভবনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নোটিশ দেওয়া। নোটিশ দেওয়ার পর যদি ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে ফের নোটিশ দেয় ফায়ার সার্ভিস। তবে কেউ যদি নীতিমালা অমান্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার ফায়ার সার্ভিসের নেই। তারপরও মাঝে মধ্যে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনুমতিক্রমে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে অভিযান চালানো হয়।

ফায়ার সার্ভিসের অভিযোগ, দুর্ঘটনার আগে আইন প্রয়োগকারী কোনও সংস্থাই তদারকি করে না।

সংস্থাটি বলছে, বিভিন্ন ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ আমলে নেয় না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীতে দুর্ঘটনা ঘটলেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত ভবন-মার্কেটের অনুমোদন না থাকা বা ঝুঁকিপূর্ণ থাকার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা

২০২৩ সালে রাজধানীর ৫৮টি বিপণিবিতান পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। পরিদর্শন শেষে তাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সবক’টিই অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ৯টি বিপণিবিতান অগ্নিকাণ্ডের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে ফায়ার সার্ভিস। বাকি ৪৯টির মধ্যে ৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৪টি মাঝারি মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ।

গত বছরের ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজার মার্কেটে আগুন লেগে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান পুড়ে যায়। ১১ এপ্রিল চকবাজারের বিসমিল্লাহ টাওয়ারের পাশে বহুতল ভবনের চতুর্থ তলায় সিরামিক ওয়্যার হাউজ ভস্মীভূত হয়। ১৩ এপ্রিল নবাবপুরের মোহাম্মাদিয়া মার্কেটে ২০টি দোকান ও ওয়্যার হাউজ পুড়ে যায়। ১৫ এপ্রিল নিউমার্কেট সংলগ্ন নিউ সুপার মার্কেটে প্রায় ৩০০ দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ঈদের আগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় ২২টি স্থানে আগুন লাগে। দেখা গেছে, এসব বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড অবহেলা, উদাসীনতা আর সচেতনতার অভাবে ঘটেছে।

আগুনের সূত্রপাত, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও বেশ কিছু সুপারিশ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু মাস ঘুরে বছর যায়, সেই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয় না। অপরাধীদের কোনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। আর সেসব কারণেই দিন দিন বাড়ছে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা।

এছাড়া আন্তমন্ত্রণালয় মিটিংয়ে ফায়ার সার্ভিস, রাজউক ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন। সেখানে সব দফতরের কাজের হিসাব ও পরিকল্পনা শোনেন আন্তমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে সেসব পরিকল্পনার বেশিরভাগ কাগজেই বন্দি থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।

রাজধানীতে কোনও অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ ঘটলেই রাজউক ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অবৈধ ভবনের তালিকা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন আর চোখে পড়ে না। এতে একই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন (২০০৩)-এর ৭ ধারায় বলা আছে, বহুতল বা বাণিজ্যিক ভবনের নকশা অনুমোদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বলবৎ অন্য কোনও আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, অগ্নি প্রতিরোধ, অগ্নিনির্বাপণ এবং এতদসম্পর্কিত নির্ধারিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে অধিদফতরের মহাপরিচালকের ছাড়পত্র ছাড়া কোনও বহুতল বা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন বা অনুমোদিত নকশা সংশোধন করা যাবে না।

গত বছর নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগার ২৭ ঘণ্টা পর তা পুরোপুরি নেভানোর ঘোষণা আসে (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে বেইলি রোডের আট তলাবিশিষ্ট গ্রিন কোজি কটেজকে আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদনের সময় রাজউকের শর্তে উল্লেখ ছিল সেখানে বাণিজ্যিক কার্যালয় হবে। তবে হোটেল-রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করার কোনও অনুমতি ছিল না।

রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই এখানকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ট্রেড লাইসেন্স বা গ্যাস সংযোগের অনুমতি পেলো তার কোনও ব্যাখ্যা নেই কারও কাছে। তবে রাজউক বলছে, প্রতি পাঁচ বছর পরপর ভবন মালিকদের ভবনের সামগ্রিক অবস্থার বিবরণ দিয়ে অকুপেন্সি সনদ নিতে হয়। কিন্তু বেইলি রোডের এ ভবনটি অনুমোদনের পরপর ২০১১ সালেই সর্বশেষ অকুপেন্সি সনদ নেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১১ সালে অনুমোদনের সময় আমরা শর্ত দিয়েছিলাম, আবাসিক ভবনের পাশাপাশি বাণিজ্যিক কার্যালয় করতে পারলেও সেখানে কোনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করতে পারবে না। তারপরও সেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করার জন্য যারা ট্রেড লাইসেন্স বা গ্যাস সংযোগ দিয়েছে তাদের কাছে আমরা অফিসিয়ালি জবাব চাইবো।’

এদিকে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বলছে, ইস্যু করার ক্ষেত্রে যেসব নথিপত্র প্রয়োজন হয় তার পরিপ্রেক্ষিতেই ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়। পরে ব্যবসায়ীরা নিজেদের সুবিধামতো ব্যবসার শ্রেণি পরিবর্তন করলেও তা আর জানায় না।

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার সময় ব্যবসায়ীরা যে ঠিকানা এবং ব্যবসার শ্রেণি উল্লেখ করে পরবর্তীতে তা পরিবর্তন করে ফেলে। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও সব ক্ষেত্রে তা আমাদের নজরে আসে না।’

ফায়ার এবং দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু ফায়ার সার্ভিস একাই তা পারবে না। ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব কোনও আইন নেই, যারা অনিয়ম করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। সংশ্লিষ্ট যেসব সংস্থা রয়েছে, যেমন সিটি করপোরেশন, রাজউক, এফবিসিসিআই, ব্যাংক সবাই যদি তাদের কাজটি যথাযথভাবে পালন করে, ভবন নির্মাণের ছাড়পত্র, ব্যবসার লাইসেন্স ও ব্যাংক লোন দেওয়ার আগে ভবন বা ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অগ্নি নীতিমালা মানছে কিনা এসব যাচাই-বাছাই করে তারপরই অনুমতি দিতে হবে। এক কথায় ভবন মালিকদের নিয়মের মধ্যে আসতে বাধ্য করতে হবে। তাহলেই অগ্নিকাণ্ড কমিয়ে আনা সম্ভব।’

/আরআইজে/এমওএফ/
টাইমলাইন: বেইলি রোডে আগুন
০৩ মার্চ ২০২৪, ২৩:০১
এত অগ্নিকাণ্ডের পরও কেন মানা হচ্ছে না ফায়ার সার্ভিসের নীতিমালা
০২ মার্চ ২০২৪, ২১:৫১
সম্পর্কিত
সুন্দরবনে আগুন: ১১ নাগরিকের উদ্বেগ
কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের মালিক গ্রেফতার, ২ দিনের রিমান্ডে
বৃষ্টিতে পুরোপুরি নিভেছে সুন্দরবনের আগুন, চলছে ড্রোন মনিটরিং
সর্বশেষ খবর
জামিন পেলেন পি কে হালদারের দুই সহযোগী
জামিন পেলেন পি কে হালদারের দুই সহযোগী
আর্জেন্টাইন ক্লাবকে জামাল ভূঁইয়ার ২ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ ফিফার
আর্জেন্টাইন ক্লাবকে জামাল ভূঁইয়ার ২ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ ফিফার
ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মির্জা ফখরুলের বৈঠক
ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মির্জা ফখরুলের বৈঠক
বিসিবির হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের কোচ হতে আগ্রহী মালান  
বিসিবির হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের কোচ হতে আগ্রহী মালান  
সর্বাধিক পঠিত
এবার কি ফুটপাত দখলমুক্ত হবে?
এবার কি ফুটপাত দখলমুক্ত হবে?
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন
‘প্রেমটা থাকুক, বিয়ে কোনও এক সময় হয়ে যাবে’
‘প্রেমটা থাকুক, বিয়ে কোনও এক সময় হয়ে যাবে’
এক লাফে ডলারের দাম বাড়লো ৭ টাকা
এক লাফে ডলারের দাম বাড়লো ৭ টাকা