X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘রেস্তোরাঁ পাড়া’র ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা কেমন

আতিক হাসান শুভ
০৪ মার্চ ২০২৪, ১০:০০আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৪, ১০:০০

রাজধানীর যে কয়েকটি এলাকায় মানুষ খাওয়ার জন্য ভিড় করে তার মধ্যে বেইলি রোড অন্যতম। ‘রেস্তোরাঁ পাড়া’ হিসেবে পরিচিত এই সড়কের পাশ ঘেঁষে যতদূর চোখ যায় বহুতল ভবন জুড়ে অসংখ্য রেস্টুরেন্টের সমাহার চোখে পড়বে। তবে রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই ভবনগুলো তৈরি হয়নি। রেস্টুরেন্ট করার ক্ষেত্রে ভবনগুলোতে যতোটুকু সেফটি-সিকিউরিটি থাকা প্রয়োজন, কোনোটিতেই তা নেই। এভাবে বহুতল ভবনে রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তা বুঝিয়ে দিলো বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু।

বেইলি রোডের দুর্ঘটনায় কবলিত যে ভবন ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ তার অদূরেই ‘বাইতুল আবেদীন শপিং সেন্টার’ নামে একটি সাত তলা ভবন। নামে শপিং সেন্টার হলেও আদতে এই ভবনের পুরোটা জুড়েই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের দোকান। ‘বার্গার এক্সপ্রেস’, ‘ক্যাফে জেলাটেরিয়া’, ‘সেশিয়েট’, ‘ওয়াসিস ক্যাফে এন্ড রেস্টুরেন্ট’সহ আরও বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান আছে এই ভবনে। প্রতিটি রেস্টুরেন্টেই ব্যবহার হচ্ছে গ্যাসের বড় বড় সিলিন্ডার। এই ভবনটিতেও রেস্টুরেন্ট করার মতো নিরাপত্তা ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। সাত তলা ভবনটিতে ওঠা-নামার জন্য কেবল একটি সিঁড়ি ব্যবহার হয়, সেটাও বেশ সরু।

ভবনটিতে ‘ওয়াসিস ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের’ ম্যানেজার মো. রাসেল বলেন, ‘এই ভবনে সেফটি-সিকিউরিটি ঘাটতি আছে, এটা সত্য। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। ভবনের ম্যানেজারকে বারবার বলার পরও তারা এটা গুরুত্ব দেয় না। আর ভবনের মালিক তো আমার আওতার বাইরে। কারণ সবকিছুই ম্যানেজারই দেখেন।’ 

সেফটি-সিকিউরিটি না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে রেস্টুরেন্ট চালানোর বিষয়ে এই হোটেলকর্মী বলেন, ‘আমি তো পেটের দায়ে ঢাকায় জব করি। মালিকপক্ষ যদি ভবনে সিকিউরিটি না দেয়, তাহলে তো আমাদের কিছু করার থাকে না।’

এখানে কীভাবে রান্না হয়, লাইনের গ্যাস নাকি সিলিন্ডারে এমন প্রশ্নের জবাবে রাসেল বলেন, ‘এই ভবনটির একপাশে লাইনের গ্যাস আছে, অন্য পাশে নেই। অন্য পাশে অবস্থিত বার্গার এক্সপ্রেস, ক্যাফে জেলাটেরিয়া, সেশিয়েট রেস্টুরেন্টগুলো সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করে।’

‘বার্গার এক্সপ্রেস’ রেস্টুরেন্টের রান্না ঘরে উঁকি দিতেই দেখা গেলো গ্যাসের বড় বড় সিলিন্ডার। গণমাধ্যমকর্মী পরিচয়ে এই রেস্টুরেন্টের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে রেস্টুরেন্টটির ম্যানেজার দ্রুত বেরিয়ে যান। আর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেস্টুরেন্টটির ক্যাশ কাউন্টারের বসা এক কর্মী বলেন, ‘এখানে লাইনের গ্যাস না থাকায় আমরা সিলিন্ডার ব্যবহার করি। পাশের রেস্টুরেন্টে দুর্ঘটনা ঘটায় কিছুটা ভয় কাজ করছে। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই, চাকরি করি। তাই ঝুঁকির মধ্যেও কাজ করতে হচ্ছে।’

খোঁজ নিয়ে ভবনটির ম্যানেজার দাদনকে পাওয়া গেলো। নিরাপত্তা না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে কমবেশি সব ভবনে একইরকম। তাছাড়া আমরা রাজউকের সংশ্লিষ্ট সব নিয়ম মেনেই ভবন করেছি। রাজউকের নিয়ম মানা হলে সেফটি-সিকিউরিটি থাকবে না কেন?’ 

ভবনে শুধু একটি সরু সিঁড়ি কেন এমন প্রশ্ন শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে এই ম্যানেজার বলেন, ‘কোথাও কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে সবাই ওটা নিয়ে কয়দিন লাফালাফি করে। তারপর সব আবার ঠিক হয়ে যায়। এটাও বেশি সময় থাকবে না।’

এই ভবন মালিকের নাম কি, শপিং সেন্টারের ভবনে রেস্টুরেন্ট কেন— এমন প্রশ্ন করতেই ‘পরে কথা বলবো’ বলে দ্রুত পাশের বিল্ডিং ‘ওরিয়েন্টাল ওরচিড’ এ উঠে যান এই ম্যানেজার।

শপিং সেন্টারটির বিপরীতে (সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের বিপরীতে) আছে আরেকটি চারতলা ভবন। ভবনটির চিকন একটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দোতলা এবং তিন তলাজুড়ে ‘সুলতান'স ডাইন’ রেস্টুরেন্ট। এছাড়াও ‘প্যারাডাইস ফ্রুটস জুস বার’ নামে ছোট একটি খাবারের দোকানও আছে। ভবনটিতেও তেমন সেফটি-সিকিউরিটি চোখে পড়েনি। এই ভবনেও রেস্টুরেন্টগুলো পুরোপুরি সিলিন্ডার নির্ভর। ভবনটিতে বেশ কয়েকটি বড় বড় সিলিন্ডারও দেখা যায়। নিচে প্যারাডাইস ফ্রুটস জুস বারে বড় একটা সিলিন্ডার ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন মুখরোচক খাবার।

বেইলি রোডের দুর্ঘটনা কবলিত গ্রিন কোজি কটেজের একেবারে পাশেই অবস্থিত ১৩ তলা বিশিষ্ট গোল্ড প্যালেস। এটি ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড নামেও খ্যাত। এই ভবনে তিনটি রেস্টুরেন্ট আছে। ‘কেএফসি’, ‘পিৎজা হাট’ ও ‘থার্টি থ্রি’ রেস্টুরেন্ট। এই ভবনটিতে তুলনামূলক সেফটি-সিকিউরিটি ব্যবস্থা ঠিক দেখা গেছে। তবে পাশের ভবনে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে রেস্টুরেন্টগুলো। ভবনটিতে ওঠানামা নামার জন্য লিফট ছাড়াও তিনটি সিঁড়ি দেখা গেছে। এ ছাড়া অগ্নি-নির্বাপন ব্যবস্থাও দেখা গেছে।

বেইলি রোডে ‘নবাবি ভোজ ১’, ‘নবাবি ভোজ ২’, ‘ক্যাপিটাল’, ‘পিঠাঘর অ্যান্ড জ্যাগেরী রেস্টুরেন্ট’, ‘চিন চিন চাইনিজ’, ‘তাওয়া রেস্টুরেন্ট’, ‘ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড কাবাব’, ‘ঢাকাইয়া কাবাব অ্যান্ড স্যুপ’ যেই ভবনগুলোতে, সেগুলোতেও তেমন কোনও অগ্নিনিরাপত্তা চোখে পড়েনি। তবে কয়েকটি রেস্টুরেন্টে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা লক্ষ্য করা গেছে।

কথা হয় এসব বেইলি রোডে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে আসা অতিথির সঙ্গে। আবাসিক ভবন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা এবং সেখানে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই সিলিন্ডারের ব্যবহার নিয়ে ক্ষোভ জানালেন তারাও। মুবিন নামে এক অতিথি খেতে এসেছিলেন ক্যাফে জেলাটেরিয়ায়। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের তো সবসময় রেস্টুরেন্টে আসা হয় না। যখন ছুটি পাই তখন পরিবার নিয়ে ভালো রেস্টুরেন্টে সপ্তাহে হয়তো একবার আসা হয়। এখন সেখানেও যদি এমন জীবনের শঙ্কা থাকে তাহলে তো না আসাই ভালো। যেকোনও ভবনে রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সঠিকভাবে তদারকি করা দরকার। নয়তো বেইলি রোডের এই দুর্ঘটনার মতো আরও দুর্ঘটনার সাক্ষী হতে হবে আমাদের।’

বাণিজ্যিকভবনে রেস্টুরেন্ট করলেন কী ক্ষতি- জানতে চাইলে স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ বলেন, ‘রেস্টুরেন্ট আর অফিস ভবনের নকশা এক হতে পারে না। একটি ভবনের নকশা করা হয় তার ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে। কোনও ভবন অফিসের জন্য তৈরি করে রেস্টুরেন্টের জন্য ভাড়া দেওয়া হলে সাধারণ মানুষ তো এতকিছু বোঝে না যে বিপদ হলে কী হতে পারে। তারা নামি-দামি রেস্টুরেন্ট দেখে সেখানে যায়।’

রেস্টুরেন্টে চুলা ও সিলিন্ডারের ব্যবহার থাকায় বহুতল ভবনে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার জন্য স্পেস বা জায়গা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্নিনিরাপত্তা যথাযথভাবে নিশ্চিত করার উপর জোর দেন এই স্থপতি।

যেখানে সেখানে রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠার বিষয়ে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, ‘সমিতির পক্ষ থেকে আমরা সব সময় সব ধরনের নিরাপত্তা মেনে ব্যবসা করা কথা বলে আসছি। কিন্তু অনেক রেস্টুরেন্ট মালিক এসব নিয়ম-কানুনের কোনও তোয়াক্কা করে না। কোজি কটেজের রেস্টুরেন্টগুলোও তাই করেছে। তারা কিন্তু আমাদের সমিতির সদস‍্য নয়।’ রেস্টুরেন্টগুলোতে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার কমিয়ে সরকারি সহযোগিতায় পাইপলাইনের গ্যাসের বিষয়ে জোর দেন ইমরান।

বাণিজ্যিক ভবনে রেস্টুরেন্টের বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বেইলি রোডে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, এরকম ঘটনা আবার না ঘটুক; এটাই আমরা সবাই চাই। কোথাও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে শুধু নোটিশ না দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। যার ত্রুটি থাকবে তার বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে। সেটা যদি কোনও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে হয় তবে ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে, আর যদি কোনও সংস্থা বা ভবন মালিকের বিরুদ্ধে হয় তবে সেটা তার বিরুদ্ধে। সবকিছু বাণিজ্যিকীকরণ করা হবে আর সেটার মাধ্যমে মানুষের জীবন চলে যাবে, এটা হতে পারে না।’

/ইউএস/
টাইমলাইন: বেইলি রোডে আগুন
০৪ মার্চ ২০২৪, ১০:০০
‘রেস্তোরাঁ পাড়া’র ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা কেমন
০২ মার্চ ২০২৪, ২১:৫১
সম্পর্কিত
শেখ হাসিনার বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার পেছনে ড. ওয়াজেদ মিয়ার বড় ভূমিকা ছিল: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
চকচকে চাল খাওয়া বন্ধ করলে দাম কমবে: খাদ্যমন্ত্রী
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা‘আলহামদুলিল্লাহ, বিজয় পেয়েছি’, খালাসের পর আসামি ইমন
সর্বশেষ খবর
নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার সাক্ষীরা পক্ষপাতদুষ্ট: আদালত
নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার সাক্ষীরা পক্ষপাতদুষ্ট: আদালত
শেখ হাসিনার বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার পেছনে ড. ওয়াজেদ মিয়ার বড় ভূমিকা ছিল: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শেখ হাসিনার বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার পেছনে ড. ওয়াজেদ মিয়ার বড় ভূমিকা ছিল: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
চার কোটি রুপির স্বর্ণ জব্দ পেট্রাপোলে
চার কোটি রুপির স্বর্ণ জব্দ পেট্রাপোলে
প্রথম ধাপে কত শতাংশ ভোট পড়েছে জানালো ইসি
প্রথম ধাপে কত শতাংশ ভোট পড়েছে জানালো ইসি
সর্বাধিক পঠিত
এবার কি ফুটপাত দখলমুক্ত হবে?
এবার কি ফুটপাত দখলমুক্ত হবে?
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা: আজিজ মোহাম্মদসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা: আজিজ মোহাম্মদসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন
‘প্রেমটা থাকুক, বিয়ে কোনও এক সময় হয়ে যাবে’
‘প্রেমটা থাকুক, বিয়ে কোনও এক সময় হয়ে যাবে’
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন