X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যভিচার প্রতিরোধে ফৌজদারি আইন বিতর্ক

মো. জাকির হোসেন
১৭ আগস্ট ২০২০, ১৩:৫০আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২০, ১৬:১১

মো. জাকির হোসেন মহামারির মতো ভয়াবহ আকারে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে ব্যভিচার। ফ্রান্সের ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ওপিনিয়নের জনমত জরিপ বলছে, অর্ধেকের বেশি (৫৫%) ফরাসি এবং ইতালিয়ান পুরুষ স্বীকার করেছেন যে জীবনের কোনও এক সময় তারা জীবনসঙ্গীকে ঠকিয়ে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক করেছেন। ওই একই জরিপে ৩৪% ইতালিয়ান নারী এবং ৩২% ফরাসি নারী ব্যভিচারের কথা স্বীকার করেছেন। ব্রিটেনে একইসঙ্গে একাধিক সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছেন ১৫% পুরুষ। অন্যদিকে, নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৯%। Alfred Kinsey পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ শতাংশ পুরুষ ও ২৬ শতাংশ নারী তাদের জীবনসঙ্গীকে ঠকিয়ে অন্যের সাথে শারিরীক সম্পর্কে করেছেনে।
ডেটিং অ্যাপ গ্লিডেনের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ভারতে প্রতি দশ জনের মধ্যে সাতজন নারী অন্য পুরুষের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তার মানে ভারতে শতকরা ৭০ জন নারী অবৈধ সম্পর্কে জড়িত। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, ভারতের প্রায় ৪৮ শতাংশ নারী মনে করেন, তাদের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থাকা উচিত। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে প্রকাশ, ভারতের কলকাতা শহরে এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ১৪ জন পুরুষের শারীরিক সম্পর্কের বিষয় জানার পর ওই ১৪ জন পুরুষকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন। ওই স্বামী আইনি নোটিশে সবার কাছে ১০০ কোটি রুপি ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। চিঠি পাওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে এই অর্থ না দিতে পারলে আইনি পদক্ষেপেরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ওই ব্যক্তি। ১৪ ব্যক্তির উদ্দেশ্যে প্রেরিত নোটিশে ওই স্বামী লিখেছেন, ‘সম্প্রতি আমি জানতে পেরেছি, আপনারা প্রত্যেকে আমার স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ ও শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন এবং গোপনে আমার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আপনারা সকলেই অবগত যে আমার স্ত্রী বিবাহিত। আপনাদের মধ্যে অনেকেই ওর স্বামী হিসেবে আমাকে চেনেন। আপনাদের এই অবৈধ কার্যকলাপে আমাদের দাম্পত্য জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই যন্ত্রণা আমায় অনেক কষ্ট দিচ্ছে।’ 

বাংলাদেশে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে তোলার হার অস্বাভাবিক সংখ্যায় বাড়ছে। আর পরকীয়ায় আসক্ত নর-নারীর সংখ্যা দ্রুত লয়ে বাড়ছে। ‘বেজলাইন এইচআইভি/এইডস সার্ভে এমোং ইয়ুথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা থেকে এমনটি জানা যায়। এ গবেষণা বলছে, শহরাঞ্চলে ৮ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৭ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িত। আর নারীদের মধ্যে গড়ে ০.৩ শতাংশ এ ধরনের সম্পর্কে জড়িত। এদের মধ্যে পুরুষরা তাদের মেয়ে বান্ধবী (৩২ শতাংশ) এবং আত্মীয়দের (১৫%) সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়াচ্ছে। জরিপে আরও উঠে এসেছে যেসব পুরুষ বিয়ের আগেই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন তাদের বিয়ের পর পরকীয়ায় জড়ানোর প্রবণতা বেশি থাকে।

দু’জন নারী ও পুরুষ যারা বৈধ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ নন তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক সাধারণভাবে সমাজে ব্যভিচার হিসেবে বিবেচিত। ব্যভিচারের ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে ‘Adultery’, ‘Extramarital affair, ‘Extramarital sex’ ‘Illicit love’, ’Extramarital love’ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলা ভাষায় অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক বুঝাতে ‘ব্যভিচার’ ও ‘পরকীয়া’ এ দুটি শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কারও কারও মতে দুজন বিবাহিত নারী-পুরুষ যারা আইনত স্বামী-স্ত্রী নন তাদের পারস্পরিক সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক পরকীয়া, আর দু’জন অবিবাহিতের পারস্পরিক সম্মতিতে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক ব্যভিচার। 

আমার লেখা দু’জন বিবাহিত নারী-পুরষের ব্যভিচারের বিষয় নিয়ে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর ব্যভিচারের ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় সকল ধর্ম ব্যভিচারকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যভিচারিণী নারী-পুরুষের শাস্তির বিধান করেছে। ইসলামে বৈধ বিবাহবহির্ভূত সকল প্রকার শারীরিক সম্পর্ককে জিনা বা ব্যভিচার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পারস্পরিক সম্মতিতে দুজন বিবাহিত নারী-পুরুষের অবৈবাহিক শারীরিক সম্পর্ক ও দুজন অবিবাহিতের পারস্পরিক সম্মতিতে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক উভয়ই ইসলামে ব্যভিচার হিসেবে পরিগণিত। ইসলামে ব্যভিচার একটি হুদুদ আইনের শাস্তিযোগ্য পাপ অথবা আল্লাহর বিরুদ্ধাচারকারী একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। 

ব্যভিচারের ভয়ংকর পাপের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনও মানুষ যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন তার ভেতর থেকে ঈমান বেরিয়ে যায় এবং এটি তার মাথার ওপর মেঘখণ্ডের মতো ভাসতে থাকে। অতঃপর সে যখন তওবা করে,তখন ঈমান আবার তার কাছে ফিরে আসে।’ (আবু দাউদ: ৪৬৯০) 

অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ব্যভিচার করে বা শরাব পান করে, আল্লাহ তার ওপর থেকে ঈমান ছিনিয়ে নিয়ে যান, যেভাবে মানুষ মাথার দিক দিয়ে জামা খুলে নেয়।’(মুস্তাদরাকে হাকিম, ১/২২) 

ইসলামে বিবাহিত নারী ও পুরুষের ব্যভিচারের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ব্যভিচারের অপরাধ পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য সমানভাবে শাস্তিযোগ্য। কোরআন কেবল ব্যভিচারকেই নিষিদ্ধ করেনি, বরং ব্যভিচারের কাজে প্ররোচনাকারী কাজকেও নিষদ্ধ করেছে, ‘তোমরা ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেয়ো না: কারণ এটি একটি লজ্জাজনক ও নিকৃষ্ট কর্ম, যা অন্যান্য নিকৃষ্ট কর্মের পথ খুলে দেয়।’ (সুরা বনি ইসরাইল, ৩২) 

ইসলাম কেন ব্যভিচারের ধারে কাছে যেতেও বারণ করেছে সে বিষয়ে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন: ‘…দু’চোখের জিনা হলো কুদৃষ্টি দেওয়া, দু’কানের জিনা হলো অশ্লীল কথা শ্রবণ করা, জিহ্বার জিনা হলো-অশ্লীল বাক্যালাপ করা, দু’হাতের জিনা হলো কাউকে স্পর্শ করা, পায়ের জিনা হলো হেঁটে যাওয়া, অন্তরের জিনা হচ্ছে আকাঙ্ক্ষা ও কামনা করা। আর যৌনাঙ্গ অবশেষে তা বাস্তবায়িত করে অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।’ (সহিহ বুখারি, ৬০৯ ও সহিহ মুসলিম,৬৪২১)

হিন্দুধর্মেও ব্যভিচারকে অপরাধ হিসিবে গণ্য করে এর শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ এবং গরুড় পুরাণে যে ২৮ ধরনের ভয়ংকর নরকের কথা বলা হয়েছে এর মধ্যে অন্তত তিনটি নরকে ব্যভিচারী পুরুষ ও নারীকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। যে ব্যক্তি অগম্যা স্ত্রীতে এবং যে স্ত্রী অগম্য পুরুষে অভিগমন করে, পরলোকে যমদূতেরা তাদের তপ্তসূর্মি/তপ্তমূর্তি নামক নরকে নিয়ে গিয়ে বিপরীত লিঙ্গের উত্তপ্ত লৌহমূর্তিতে পিছমোড়া করে বেঁধে বেত্রাঘাত করে ব্যভিচারীদের। পরের দ্রব্য অপহরণ,পর স্ত্রী অথবা অন্যের সন্তান হরণের মতো পাপের শাস্তি তমিস্রা নরকে গমন। এই নরক নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। এখানে যমদূতরা পাপীদের আত্মাকে নিরন্তর প্রহার করে। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ ঘটিয়ে স্ত্রীলোকটিকে ভোগ করলে সে অন্ধতামিস্র নরকে পতিত হয়। বৃক্ষকে ভূপাতিত করার পূর্বে যেমন তার মূল ছেদন করা হয়,তেমনই সেই পাপীকে ওই নরকে নিক্ষেপ করার পূর্বে যমদূতেরা নানা প্রকার যন্ত্রণা প্রদান করে। এই যন্ত্রণা এতই প্রচণ্ড যে, তার ফলে তার বুদ্ধি এবং দৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্যই সেই নরককে পণ্ডিতেরা অন্ধতামিস্র বলেন।

ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত ও ইনজিলে ব্যভিচার সম্পর্কে যে আলোচনা রয়েছে তার সারমর্ম হলো– স্রষ্টা তাঁর নবীকে নির্দেশ দিচ্ছেন: (ক) ব্যভিচার একটি দুষ্টাচার; (খ) যে নারী-পুরুষ ব্যভিচার লিপ্ত হবে তাদের উভয়কে কঠোর শাস্তি দিতে হবে; (গ) শাস্তির ধরন ও তা কার্যকর করার পদ্ধতি হলো—উভয়ের মৃত্যুদণ্ড হবে এবং তা প্রকাশ্য দিবালোকে। তাওরাতের (বাইবেলের পুরাতন নিয়ম) বিধানে আল্লাহ হজরত (মুসা আ.)-কে যে দশটি আজ্ঞা দান করেন তার একটি হলো, ‘ব্যভিচার করিও না’ (যাত্রাপুস্তক,২০: ১৪) তাওরাতে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি অপরের স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করে, যে ব্যক্তি প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করে, সেই ব্যভিচারী ও সেই ব্যভিচারিণী, উভয়ের প্রাণদণ্ড অবশ্যই হবে।’ (লেভিক্টাস, ২০: ১০)। 

ধর্মের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় আইনেও ব্যভিচার শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি আপরাধ। পাকিস্তান ১৯৭৯ সালের হুদুদ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ব্যভিচারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। তবে এক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারী ব্যভিচারিণীর শাস্তির পরিমাণ বেশি রাখা হয়েছে। 

ফিলিপিনেও ব্যভিচারের ক্ষেত্রে ব্যভিচারী নারী ও পুরুষের শাস্তির তারতম্য রয়েছে। ফিলিপিনের আইনে ব্যভিচারের কারণে ব্যভিচারিণী নারী আর তার সঙ্গীর ছয় বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে যদি ওই নারীর স্বামী প্রমাণ করতে পারেন যে, ওই সঙ্গীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে তার স্ত্রীর। 

অন্যদিকে কোনও স্ত্রী তার স্বামীর সঙ্গে অন্য কোনও নারীর শারীরিক সম্পর্ক যদি স্ত্রী প্রমাণ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে স্বামীর ১ দিন থেকে সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে ৪ বছর।
যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্যভেদে ব্যভিচারের শাস্তির মাত্রায় পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ২১টি অঙ্গরাজ্যে পরকীয়াকে কোনও ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। তবে ম্যাসাচুসেটস, ওকলাহামা, উইসকন্সিন, মিশিগানের মতো অঙ্গরাজ্যগুলোতে ব্যভিচারকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে দেখা হয় এবং সেখানে এর শাস্তি অর্থদণ্ডসহ যাবজীবন কারাদণ্ড।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যভিচারকে গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। স্বামী বা স্ত্রী যে কারও অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানা, নির্বিচার আটক, জেল, মারধর এমনকি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। তাইওয়ানের ব্যভিচার আইনে একজন বিবাহিত ব্যক্তির সঙ্গে বিয়েবহির্ভূত যৌনমিলনের জন্য সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ডের বিধান ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি সে দেশের সাংবিধানিক আদালত এক রায়ে বলেছেন, এখন থেকে তাইওয়ানে ব্যভিচার অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না। ব্যভিচার অপরাধ বলে বিবেচিত না হওয়ার পক্ষে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ব্যভিচার আইন বিয়ে টিকিয়ে রাখতে খুব অল্পই সহায়ক ছিল। তাছাড়া বিয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নাক গলানো আসলে বিয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যভিচার আইন একজন মানুষের যৌন স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ এবং ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর মারাত্মক হামলা’। 

২০১৮ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাদের রায়ে বলেছেন ব্যভিচার ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে না। দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ এবং সকল ইউরোপীয় দেশে ব্যভিচার ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে আর গণ্য হয় না।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির স্ত্রী অথবা যাকে সে অপর কোনও লোকের স্ত্রী বলে জানে বা তার অনুরূপ বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে এমন কোনও নারীর সঙ্গে উক্ত নারীর স্বামীর সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে এরূপ যৌন সম্পর্ক করে যা নারী ধর্ষণের শামিল নহে, সে ব্যক্তি ব্যভিচারের অপরাধে দোষী এবং যেকোনও বিবরণে কারাদণ্ডে যার মেয়াদ পাঁচ বছর পর্যন্ত হতে পারে অথবা অর্থ দণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। তবে ব্যভিচারে অংশগ্রহণকারী নারী দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী হিসেবে দণ্ডিত হবে না। 

বাংলাদেশের ব্যভিচারবিরোধী এ আইনটি নানা কারণে কৌতূহলোদ্দীপক ও বিতর্কিত – 

এক. শুধুমাত্র ব্যভিচারী পুরুষকে সাজা দেওয়ার বিধান রয়েছে।
দুই. আইনের মাধ্যমে ব্যভিচারিণী নারীকে অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এমনকি পুরুষটি যদি নারী দ্বারা প্ররোচিতও হয়ে থাকে তবুও দায় কেবল পুরুষের।
তিন. ব্যভিচারিণী নারীর স্বামী সম্মতি দিলে দুজন বিবাহিত নারী-পুরুষের অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক ব্যভিচারের অপরাধ হবে না। আর স্বামীর সম্মতি না থাকলে ব্যভিচারের অপরাধ হবে।
চার. অপরের দেহের বিষয়ে একজন ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর একটি কাজ অপরাধ হওয়া বা অপরাধ বিবেচিত না হওয়া সেই ব্যক্তিকে আইন প্রণেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছে। তদুপরি সকল ধর্ম যেখানে ব্যভিচারকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে শস্তিযোগ্য ঘোষণা করেছে সেখানে একজন স্বামী তার সম্মতির মাধ্যমে ইচ্ছামাফিক ধর্মের বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ব্যভিচারকে অপরাধ নয় বলে ঘোষণা করতে পারে।

ব্যভিচারবিরোধী বাংলাদেশের আইনে স্ত্রী ব্যভিচারী স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন না, তেমনি স্বামীও স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন না। কেননা আইন কেবল নারীর স্বামীকে ব্যভিচারের পুরুষ সঙ্গীর বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার দিয়েছে।
পাঁচ. এ আইনের বিধান পর্যালোচনায় স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, অবিবাহিত নারীর সঙ্গে, বিধবার সঙ্গে, অথবা স্বামীর সম্মতিপ্রাপ্ত স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ব্যভিচারের আওতায় পড়বে না। 

এটি ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মূল্যবোধ, ধর্ম ও প্রচলিত প্রথার পরিপন্থী। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে যে আইন কমিশন এ আইনটি তৈরি করেছে তাদের প্রতি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট প্রণীত চার্টার অ্যাক্টে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মূল্যবোধ, ধর্ম ও প্রচলিত প্রথার পরিপন্থী কোনও আইন বিধিবদ্ধ না করা।

ছয়. স্বামীর সম্মতিতে তার স্ত্রীর সঙ্গে পর পুরুষের শারীরিক সম্পর্ক ব্যভিচার হবে না বলে এ আইনের যে বিধান রয়েছে তাতে স্বামীর সম্মতির মাধ্যমে স্ত্রীকে দিয়ে পতিতাবৃত্তি করানোর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

এটি সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’।

সাত. ব্যভিচারবিরোধী ফৌজদারি আইনে শুধুমাত্র স্বামীকে ব্যভিচারের মামলা করার সুযোগ দিয়ে ও ব্যভিচারের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র পুরুষ সঙ্গীর বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ থাকায় এটি সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের সমতার বিধান লংঘন করেছে। ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ আর ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’

আট. সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনও আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে। 

অন্যদিকে  সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘(১) সংবিধানের তৃতীয় ভাগের (মৌলিক অধিকার) বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। (২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’ 

ব্যভিচারবিরোধী দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা সংবিধানের একাধিক বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এটি সাংবিধানিকভাবেই বাতিলযোগ্য। 

নয়. অনেকেই একটা বিতর্ক উত্থাপন করেন যে, স্বামীর সম্মতির বিধান রেখে নারীর মর্যাদা ও স্বাধীন সত্তার প্রতি অবমাননা করা হয়েছে। ভারতের সুপ্রিমকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রও ব্যভিচারবিরোধী আইন নিয়ে Joseph Shine v Union of India মামলায় অনুরূপ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন, বিবাহিতা নারীর স্বামীর মতো থাকা মানে কী? স্ত্রী কি স্বামীর সম্পত্তি না পণ্য? নাকি তাঁর অধীনস্থ আত্মপরিচয়হীন পুতুলমাত্র? 

আমার মতে এক্ষেত্রে ধারণাটি ভুল। কেননা ব্যভিচার অপরাধ হবে না তখন, যখন স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের সম্মতি থাকবে। স্বামীর সম্মতি আছে, স্ত্রীর নেই এরূপ ক্ষেত্রে অন্য পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্পষ্টতই ধর্ষণ। এমনকি স্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত কোনও কোনও ক্ষেত্রে বৈধ স্বামীর শারীরিক সম্পর্কও বৈবাহিক ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত। তবে স্বামীর সম্মতিতে কোনও একটি অপরাধমূলক কাজ অপরাধ না হওয়া গুরুতর আইনের প্রশ্ন। 

কোন কাজ অপরাধ কিংবা অপরাধ নয় তা নির্ণয়ের অধিকার কেবল সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের। স্বামী সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ নয়। তদুপরি একজনের দেহের ব্যাপারে আরেকজনের সম্মতি যদি একটি অপরাধমূলক কাজকে অপরাধ নয় সাব্যস্ত করতে পারে, তাহলে দুজন অবিবাহিত ছেলেমেয়ে নিজেদের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক করলে নারী সঙ্গীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুরুষ সঙ্গীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা কেন হবে?

দশ. ব্যভিচার আইন নিয়ে আরেকটি বিতর্ক হলো,একজন ব্যক্তির স্ত্রীর সঙ্গে অন্য কোনও পুরুষ ব্যভিচার করলে তাতে রাষ্ট্র সংক্ষুব্ধ হতে পারে কিনা? নাকি তা স্রেফ দুটি মানুষের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক বিষয়? এ মতপন্থীদের যুক্তি হলো, পাপ এবং অপরাধের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পাপ নিছক নৈতিক এবং ধর্মীয় অনুশাসন না মানা, আর অপরাধ একটি আইনগত বিষয় যা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়। এরা মনে করেন ব্যভিচার পাপ,অপরাধ নয়।

এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত কোনও বিষয় নয় বিধায় ব্যভিচার অপরাধ নয়। Joseph Shine v Union of India মামলায় ভারতের ব্যভিচারবিরোধী আইন বাতিল ঘোষণার রায়ে বলা হয়েছে, ‘ব্যভিচার কোনও ফৌজদারি অপরাধ হতে পারে না–বড়জোর এটা বিবাহবিচ্ছেদের মতো একটি পারিবারিক বিষয় হিসেবে গণ্য হতে পারে।’ এ সমাধানটি ভয়ংকর। বিবাহবিচ্ছেদ সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের জন্য অসম্মানজনক ও গ্লানিকর যে ভয়ানক পরিণতি সৃষ্টি করে তা শুধু ব্যক্তি ও পরিবারের মধ্যে সীমিত থাকে না, অনেক ক্ষেত্রেই তা সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তদুপরি মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে যদি মোহরানার পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে তাহলে স্বামীর পক্ষে ব্যভিচারিণী স্ত্রীকে তালাক দেওয়া সম্ভব হয় না।

বিবাহবিচ্ছেদ একটি ভয়ংকর বিষয় বলেই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বৈধ বিষয়সমূহের মধ্যে আল্লাহ’র নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত বিষয় হচ্ছে তালাক।’ (আবু দাউদ) 

এগারো. কারো কারো মতে ব্যভিচার ফৌজদারি অপরাধ না হলেও এটি দেওয়ানি অন্যায়। তাদের যুক্তি বিয়ের মাধ্যমে অপরাপর অধিকারের পাশাপাশি দু’জন নারী-পুরুষের এমন একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় যে, কেবলমাত্র তারা দু’জন এক অপরের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করার একমাত্র অধিকারী, অন্য কারও সেখানে বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপের অধিকার নেই। তৃতীয় পক্ষ এই দু’জনের কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করলে তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বা অধিকার ভঙ্গকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। ফলে অধিকার ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করা যাবে।

ব্যভিচারবিরোধী আমাদের দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক বিধায় এর সাংবিধানিক অসামঞ্জস্যতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিট মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ভারতে বাতিল হয়ে যাওয়া ব্যভিচারবিরোধী আইন ও আমাদের দণ্ডবিধির আইন হুবহু এক। সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য বিবেচনায় ভারতের সুপ্রিমকোর্ট এটি বাতিল করেছে। আইনটি আমাদের সংবিধানেরও একাধিক অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সাংবিধানিক বিবেচনায় এটি বাতিল হলে আমাদের দেশে ব্যভিচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের কী হবে? বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যভিচারের কারণে হত্যাসহ নানা নিষ্ঠুরতার বলি হচ্ছে সন্তান, স্ত্রী, স্বামীসহ আপনজন। এ ঘৃণ্য ঘটনা বিভিন্নমুখী বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, কলহ-বিবাদের সূত্রপাত করে, এমনকি দাম্পত্য সম্পর্কের তিক্ততাপূর্ণ অবসান ঘটায়।

পরিসংখ্যান বলছে বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। ব্যভিচার পরিবারের ভিত দুর্বল করছে এবং সন্তানদের জন্য বয়ে আনছে ভয়ংকর অনিশ্চয়তাপূর্ণ জীবন। ব্যভিচারের ফলস্বরূপ যে মানব সন্তানটি পৃথিবীতে আসে, ‘জন্মই তার আজন্ম পাপ’। তাকে কেউই সম্মানের দৃষ্টিতে, সুনজরে দেখে না। ব্যভিচার প্রতিরোধের আইন সংশোধন করা তাই সকল শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের একান্ত দাবি।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ