X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভালো আর আলো নিয়ে কথা!

রেজানুর রহমান
১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:১২আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:১৪









রেজানুর রহমান একটা গল্প বলি। কেবল মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে একটি ছেলে। গরিব ঘরের সন্তান। এলাকার এক ধনাঢ্য ব্যক্তির ছেলেও ওই স্কুলে পড়ে। কাজেই খবরটা তার কানে গেলো। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার ভঙ্গিতে অবজ্ঞার হাসি দিয়ে তিনি মন্তব্য করলেন, এটাকেই বলে ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’। নৈমুদ্দিনের একটু হাউস হইছে তাই ছেলেকে স্কুলে পাঠাইছে। অচিরেই শখ মিটে যাবে। ছেলেকে পড়াশুনা করানোর সামর্থ্য তার নাই। কাজেই কিছু দিনের মধ্যে নৈমুদ্দিনের ছেলে স্কুল ছেড়ে অন্যের জমিতে কামলাগিরি শুরু করবে। কাগজ কলম আনো আমি লিখি দিতেছি....।

দিন যায়, মাস যায়। নৈমুদ্দিনের ছেলে ঠিকই স্কুলে যাচ্ছে। পড়াশুনায় খুব ভালো। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলো। গ্রামে একটা হৈচৈ পড়ে গেলো। গ্রামেরই ঈর্ষাকাতর কয়েকজন মানুষ ছুটে গেলো ওই ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে। তাদের ভাবটা এমন, নৈমুদ্দিনের ছেলে একটা মারাত্মক ভুল করেছে। বৃত্তি তো পাবার কথা ধনী লোকের ছেলের। সেখানে গরিব লোক ঢুকে গেলো কেন? এখানেই তাদের মহা আপত্তি। অধিক তোষামোদির ভঙ্গিতে তারা মায়াকান্না জুড়ে দিলো, ভাই ব্যাপারটা কোনোভাবেই মানা যায় না। বৃত্তি তো পাওয়ার কথা আপনার ছেলের সেখানে কোথাকার কোন নৈমুদ্দিনের ছেলে পায় কী করে? ভাইয়ের একটা বিহিত করেন। ধনাঢ্য ব্যক্তিটিও কিছুটা চিন্তিত। বিব্রতও বটে। তাই চাটুকারদের সুরে সুর মিলিয়ে বলল, ‘ঝড়ে বক পড়ে’ বলে একটা কথা আছে না? নৈমুদ্দিনের ছেলের বেলায় এই ঘটনাই ঘটেছে। ঝড়ে বক পড়েছে। ওই ছেলে প্রাইমারির পর আর আগাইতে পারবে না। কাগজ কলম আনো আমি লিখি দিতেছি।

কিন্তু নৈমুদ্দিনের ছেলেকে দমিয়ে রাখা গেলো না। ৮ম শ্রেণিতেও বৃত্তি পেলো সে। আবারও গ্রামে হৈচৈ পড়ে গেলো। কিছু চাটুকার মানুষ বাদে সবার মুখে মুখে নৈমুদ্দিনের ছেলের প্রশংসা। চাটুকাররা আবার ধনাঢ্য ব্যক্তির ছেলের জন্য মায়াকান্না শুরু করে দিলো। ‘না না ভাই এই ঘটনা মাইন্যা নেয়া যায় না। বৃত্তি তো পাবার কথা আপনার ছেলের। সেখানে নৈমুদ্দিনের ছেলে পায় কী করে? ভাই এখানে নিশ্চয়ই কোনও ঝামেলা আছে।’

ধনাঢ্য ব্যক্তিটি এবার আরও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সাগরেদদের সুরে সুরে মিলিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, এইট ক্লাস পার করছে... তবে আর আগাইতে পারবে না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগেই ওই ছেলে কাহিল হয়া যাবে। কাগজ কলম আনো আমি লিখি দিতেছি।

কিন্তু কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষায় পাস করল নৈমুদ্দিনের ছেলে। বলা বাহুল্য, ওই ধনাঢ্য ব্যক্তির ছেলে পরীক্ষায় ফেল করেছে। গ্রামে এবার আরও বেশি হইচই পড়ে গেলো! কিন্তু চাটুকাররা পারলে বোর্ডের পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে দেয় এমন অবস্থা। যথারীতি এবারও ধনাঢ্য ব্যক্তিটির কাছে গিয়ে মায়া কান্না শুরু করে দিলো, ভাই এইটা কী হইলো? আপনার ছেলে ফেল করে আর কোথাকার কোন নৈমুদ্দিনের পোলা পাস করে। ভাই আপনি এখনও চুপ করে থাকবেন? মান সম্মান বলে তো কিছু থাকলো না। কিছু একটা করেন?

ধনাঢ্য ব্যক্তিটি এবারও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার ভঙ্গিতে বললেন, কাগজ কলম আনো আমি লিখি দিতেছি নৈমুদ্দিনের ছেলে আর আগাইতে পারবে না। স্কুল পর্যন্ত ঠিক আছে। ছেলেকে কলেজে পড়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। এত টাকা কোথায় পাবে নৈমুদ্দিন?

এবারও ঈর্ষাকাতর ধনাঢ্য ব্যক্তিটির ভবিষ্যৎ বাণীতে কোনও কাজ হলো না। নৈমুদ্দিনের ছেলে ঠিকই দেশের একটি নামকরা কলেজে ভর্তি হলো এবং এক সময় কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করলো। এবার তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পালা।

চাটুকাররা যেন এই ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। তারা আবার ছুটে গেলো ওই ধনাঢ্য ব্যক্তিটির কাছে। ‘ভাই এইটা কী হইল? লজ্জায় তো মুখ দেখাইতে পারতেছি না। নৈমুদ্দিনের ছেলে নাকি ভার্সিটিতে ভর্তি হবে? কিছু একটা করেন ভাই? নৈমুদ্দিনকে আটকান। তাকে কোনও একটা ঝামেলায় ফেলেন। যাতে সে ছেলের জন্য আর আগাইতে না পারে। ঈর্ষাকাতর ওই ধনাঢ্য ব্যক্তিটি এবার আরও বেশি অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বললো, ভার্সিটির লেখাপড়ার খরচ সম্পর্কে তোমাদের কোনও ধারণা আছে? ম্যালা খরচ। নৈমুদ্দিন এই খরচ সামলাইতে পারবে না। কাজেই কাগজ কলম আনো আমি লিখি দিতেছি। নৈমুদ্দিনের ছেলে ভার্সিটিতে ভর্তি হইতে পারবে না।

বলা বাহুল্য, নৈমুদ্দিনের ছেলে ঠিকই দেশের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো এবং কৃতিত্বের সাথে অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায় পাস করলো। সে বিসিএস পরীক্ষা দিলো। এখানেও কৃতিত্ব দেখালো। সরকারি চাকরি পেলো। কয়েক বছর পর নিজের জেলায় সর্বোচ্চ দায়িত্বে অর্থাৎ জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেলো। সারা গ্রামে আনন্দ আর হইচই পড়ে গেলো। এবার ভোল পাল্টালো ওই ধনাঢ্য ব্যক্তি! যার সাথেই দেখা হয়, তাকেই বলে, কী বলেছিলাম না, আমাদের গ্রামে একটা রত্ন পাওয়া গেছে। এই রত্নই একদিন শুধু আমাদের গ্রাম নয়, গোটা দেশকে উজ্জ্বল করবে। কী, আমার কথাই সত্য হলো তো? ঘটনা এখানেই থেমে থাকলো না। নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসককে তার নিজ গ্রামে ব্যাপক সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হলো। এবং সেই সংবর্ধনা কমিটির আহ্বায়ক হয়ে গেলেন ঈর্ষাকাতর সেই ধনাঢ্য ব্যক্তিটিই!

প্রিয় পাঠক, এই গল্পের সাথে সাম্প্রতিক সময়ের কোনও ঘটনার মিল পাচ্ছেন কী? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। আমাদের পদ্মা সেতুর সাথে গল্পটার কোথায় যেন একটা মিল আছে! ঈর্ষাকাতর মানুষেরা এভাবেই পদ্মা সেতুর ব্যাপারে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য শুরু করেছিলেন। পদে পদে কতই না বাঁধা এসেছে। ধন্যবাদ জানাতেই হয় আমদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তাঁর দৃঢ়তা ও সাহসী ভূমিকার কারণেই বাংলাদেশ নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণে সফল হতে চলেছে। তবে উপরের গল্পটির সঙ্গে পদ্মা সেতুর গল্পের একটু যেন অমিল রয়েছে। গল্পে যে অর্জনের কথা বলা হয়েছে এক সময় তার কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে ওঠে বিরোধিতাকারীরাই। পদ্মা সেতুর বেলায় ঈর্ষাকাতর ব্যক্তিরা যেন একটু বিপাকে পড়েছে। তারা ভাবতেই পারেনি বাংলাদেশ নিজের টাকায় পদ্মা সেতুর মতো বিশ্বমানের এত বড় সেতু নির্মাণ করে ফেলবে। আর তাই সেতুর বর্তমান অবকাঠামো গত উন্নয়ন দেখেও প্রশংসা করতে পারছে না। এটা কি এক ধরনের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব?

যাক, রাজনীতির আলোচনায় যাবো না। তবে একথা বোধকরি সকলেই মানবেন যে, পদ্মা সেতুর অবকাঠামো গত উন্নয়ন দেশের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে একটাই সাহস জুগিয়েছে। সাহসটা হলো, হ্যাঁ- আমরাও পারি। একজন রিকশাওয়ালার সাথে কথা হলো- পদ্মা সেতু নিয়ে সে মহাখুশি। রিকশার প্যাডেল চালাতে চালাতে বললো, সেতুটা বানাইতে না পারলে একটা পরাজয় হইতো স্যার। পরাজয়টা মাইন্যা নিতে পারতাম না। একজন  সিএনজি চালক বললো, পদ্মা সেতু আমার মনের মধ্যে একটা বড় সাহস হয়ে উঠেছে। এখন আর ছোটখাটো বিপদকে বিপদই মনে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বললো, মহান স্বাধীনতার পর পদ্মা সেতু আমাদের অনেক বড় অর্জন। নিজের টাকায় স্বপ্নের সেতু। ভাবতেই বুকে বল পাই! একজন চাকরিজীবী বললেন, পদ্মা সেতু প্রমাণ করলো, আগে স্বপ্ন দেখতে শিখতে হয়। তবেই না স্বপ্ন সফল হয়। পদ্মা সেতুর বাস্তবতা আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে। আগে কিছু একটা করতে যাবার আগে কত কিছুই না ভাবতাম। নেতিবাচক মনোভাবটাই বেশি কাজ করতো। এখন সবকিছুই ইতিবাচক হিসেবে দেখার সাহস পাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বললেন, আমার গ্রামের বাড়ি দক্ষিণের একটি জেলায়। পদ্মা সেতু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করবে না। এই সেতুর কল্যাণে অর্থনৈতিকভাবে দেশের ২১টি জেলার মানুষ সুফল পাবে।

সত্যি কথা বলতে কী, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিস্ময়কর এক পরিবর্তনের ঢেউ শুরু হয়েছে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর দিকে যাত্রা করলেই মনে হবে নতুন এক সম্ভাবনার বাংলাদেশে ছুটে চলেছি। ছবির মতো সাজানো গোছানো রাস্তাঘাট। আন্তর্জাতিক মানের রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। দেশের একজন নামকরা ভ্রমণবিদ বললেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের পর্যটন শিল্পেরও ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। দেশের মানুষ নিয়ম মানে না এই বদনাম ঘোচানোও সম্ভব পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে। তবে তার আগে দরকার দেশপ্রেম। ভালো কাজে সমর্থন।

আসুন ভালোর সাথে থাকি। আলোর পথে হাঁটি।

বিজয় মাসে অফুরান শুভেচ্ছা সবার জন্য।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ