X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মেলায় যাচ্ছি, বিয়েতে যাচ্ছি, শুধু যাচ্ছি না স্কুলে...

রেজানুর রহমান
২২ মার্চ ২০২১, ১৪:১৪আপডেট : ২২ মার্চ ২০২১, ১৫:৫৩

রেজানুর রহমান
হাটবাজার ঠিকই চলছে। সেখানে মানুষের কোনও কমতি নেই। গাদাগাদি মানুষ, ঠাসাঠাসি মানুষ। কীসের স্বাস্থ্যবিধি? কীসের মাস্ক পরা? দেশের হাটবাজারের দৃশ্য দেখে মোটেও বোঝার উপায় নেই যে আমরা করোনা মহামারিতে আছি। শুধু হাটবাজারের কথাই বা বলবো কেন? আর সব জায়গাতেই মানুষ চলছে, ফিরছে আগের মতো। সভা-সমাবেশ হচ্ছে। তাতে স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। বিভিন্ন নির্বাচনের জন্য প্রকাশ্যে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি টাইপের মিছিল হচ্ছে। বিজয়ী প্রার্থীকে জড়িয়ে ধরে কে আগে শুভেচ্ছা জানাবে তার প্রতিযোগিতা চলছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে ‘ধুমনাচালে’ জাতের নাচ গান হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধির কোনোই তোয়াক্কা নেই। বলা হচ্ছে জনসমাবেশ ও ভিড় এড়িয়ে চলুন। অথচ মানুষ উপচে পড়া বইমেলাও হচ্ছে। শুধু চলছে না দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এক বছর ধরে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। কেন বন্ধ? বন্ধ করোনার ভয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে আমরা তো শিক্ষার্থীদের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারি না? আহা! কী সুন্দর কথা! শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে না বলে কি একেবারে ঘরে বসে আছে? স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে কি শিক্ষকরা ঘরে বসে আছেন? মানছেন কি স্বাস্থ্যবিধি? স্কুল, কলেজ খোলা থাকলে করোনার সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনা আছে। মূলত এই যুক্তিতে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু আমরা কি এটা নিশ্চিত করতে পেরেছি যে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ঘরের বাইরে যাবে না। ভিড় এড়িয়ে চলবে?

ছাত্রছাত্রীরা তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে দলবেঁধে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে যাচ্ছে। সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটায় যাচ্ছে। একুশে বইমেলার জনসমুদ্রে মিশে যাচ্ছে। সভা-সমাবেশে যোগ দিচ্ছে। পিকনিকে যাচ্ছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে স্বাভাবিক সময়ের মতোই যোগ দিচ্ছে। এসব জায়গায় করোনার ভীতি মোটেই গুরুত্ব পাচ্ছে না। শুধু ভীতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বেলায়।

করোনার এই মহামারিকালে কতবার যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা বলা হলো আবার সিদ্ধান্ত বাতিলও করা হলো ভাবলে অবাক হই। হ্যাঁ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে আমরা শিক্ষার্থীদের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারি না। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কি আদৌ শিক্ষার্থীদের জীবনকে শঙ্কামুক্ত রাখতে পেরেছি? তারা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে না। তার মানে কি তারা ঘরেই বসে আছে? তা তো নয়। বরং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে তারা একটি নিয়মের মধ্যে ঢুকে যেত। এখন যেমন যেখানে খুশি চলে যায়। কখন ঘরে ফিরে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ওরা যখন ঘরের বাইরে যায়, হাজার হাজার মানুষের সাথে মিশে, আড্ডা দেয়, তখন কি করোনা সংক্রমণের ভয় থাকে না? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে বরং এই ভয়টা কেটে যাওয়ার কথা! কারণ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালন করা হবে। তাহলে কোনটা সঠিক সিদ্ধান্ত? স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দেওয়া নাকি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রেখে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা?

টানা এক বছর দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেই। জীবন-জীবিকার কথা বলে দেশের সবকিছুই খোলা রাখা হয়েছে। শুধু আপত্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে। ভাবটা এমন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলেই দেশকে করোনামুক্ত করা সম্ভব!

কী এক স্ববিরোধিতার চর্চা করে চলেছি আমরা। করোনা সংক্রমণের ভয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছি। শিশুদের জন্য আমাদের কতই না ভাবনা! বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলায় শিশুদের না আনার কথা বলা হয়েছে। ‘মেলায় আপাতত শিশুদের আনবেন না’। এমন ঘোষণাই ছিল মেলা কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এই নিয়ম কি অনুসরণ করা হচ্ছে? মোটেই না। আপনি মেলার আয়োজন করবেন অথচ বলবেন শিশুদের সাথে আনবেন না, এটা কি বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত? কোনও বাবা-মা তার শিশু সন্তানকে বাসায় রেখে বইমেলায় আসবেন? বইয়ের মেলায় শিশুদেরকেই তো আরও বেশি করে আনা দরকার। কাজেই এমন ঘোষণা দিতে হবে যা বাস্তবসম্মত!

এবার শীতের বইমেলা শুরু হয়েছে গরমে। কিন্তু একুশে বইমেলা বলে কথা। বছরের যে সময়েই অনুষ্ঠিত হোক না কেন প্রাণের টানে মানুষ আসবেই। তার প্রমাণ মিলেছে এরইমধ্যে। এবার বইমেলা শুরুর সময়েই শুক্র, শনি দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটি পেয়েছিল। হাজার হাজার দর্শনার্থী বইমেলায় ভিড় করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু-কিশোর তাদের বাবা-মা অর্থাৎ অভিভাবকের সঙ্গে ভিড়ের মাঝে বইমেলায় ঘুরে বেড়িয়েছে। এরা কি ঝুঁকিমুক্ত? এদের যদি করোনা হয় তাহলে দায়-দায়িত্ব কে নিবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাবা-মায়ের সাথে দলবেঁধে এই যে শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যাচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, কারও যদি করোনা হয় দায় দায়িত্ব কার? এই যে প্রতিদিন বিয়ের অনুষ্ঠানে ছেলেমেয়েরা তাদের অভিভাবকদের সাথে যাচ্ছে, হাজার হাজার মানুষের সাথে মিশছে, এখানে কি করোনা সংক্রমণের ভয় নাই?

দেশের সবকিছুই তো খোলা! তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকছে কোন যুক্তিতে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি দেখা দিতে পারে এটাই যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলার পক্ষে আসল যুক্তি হয় তাহলে সংশ্লিষ্টদের কাছে বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই– শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন। আপনাদের মূল্যবান দায়িত্ব আপনারা পালন করেছেন। কিন্তু আপনারা কি জানেন, যে ভয়ের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে তার চেয়েও ভয়ংকর পরিস্থিতির মাঝে প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা মিশে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। মেলায় যাচ্ছে। মিছিল মিটিংয়ে অংশ নিচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা মাদকের নেশায়ও জড়িয়ে যাচ্ছে অনেকে। একজন অভিভাবক দুঃখ করে বললেন, দিনের পর দিন স্কুল বন্ধ থাকায় ছেলেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। সে যখন-তখন হুট করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। কারও কথা শোনে না। বাসায় থাকার কথা বললেই ক্ষেপে যায়। বলে দেশে সবকিছুই তো খোলা। শুধু শুধু স্কুল বন্ধ রেখেছো কেন তোমরা? এর কোনও মানে হয় না।

একই সংকটের কথা তুললেন আরেকজন অভিভাবক। ক্লাস ফোরে পড়ে তার মেয়ে। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় সে অস্থির হয়ে পড়েছে। তারও একই অভিযোগ– দেশের সবকিছুই তো খোলা। তোমরা শুধু শুধু স্কুল বন্ধ রেখেছো।

আরেকজন অভিভাবক তার স্কুল পড়ুয়া ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তায় ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছেন। ছেলেকে পড়াশোনার কথা বললেই ক্ষেপে ওঠে। এত ‘পড়াশোনা পড়াশোনা’ বলো কেন? স্কুল তো বন্ধ! পড়াশোনা করে কী করবো? তার মোবাইল ফোন আসক্তি বহুগুণে বেড়েছে। ঘুমের সময়টুকু ছাড়া দিন রাতের সবটুকু সময় মোবাইল ফোন নিয়েই মেতে থাকে। বাধা দিয়েও কাজ হয় না। বাধা দিলে হৈচৈ শুরু করে দেয়। এমন সব প্রশ্ন করে তার উত্তর আমি দিতে পারি না।

অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সন্তানদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারার ব্যর্থতা তুলে ধরেছেন অনেকে। তাদের অভিন্ন বক্তব্য– ছেলেমেয়েরা প্রশ্ন করে দেশের সবকিছুই তো খোলা। আমাদের স্কুল-কলেজ বন্ধ কেন? আর তো ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না। সন্তানদের মোবাইল ফোনের আসক্তির কথাও তুললেন সবাই। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় অখণ্ড অবসর। আর তাই রাত দিন বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই মোবাইল ফোনে মেতে থাকে ছেলেমেয়েরা। বাধা দিলেও শোনে না। হৈ চৈ বাধিয়ে দেয়।

একজন অভিভাবক প্রশ্ন তুললেন এভাবে– ধরা যাক করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলো না। তাহলে কি বছরের পর বছর দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে? পরিস্থিতি যা বলছে তাতে করোনার সাথে লড়াই করেই সামনের পৃথিবীকে এগিয়ে যেতে হবে। তার মানে করোনার সাথেই বসবাস করতে হবে। এজন্য সতর্ক পদক্ষেপ দরকার। কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার উদ্যোগ নিয়ে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া দরকার।

সম্মানিত ওই অভিভাবকের বক্তব্যের সূত্র ধরে বলতে চাই, দেশে করোনা যদি বাড়তেই থাকে তাহলে কি বছরের পর বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে? জীবন-জীবিকার প্রশ্নে দেশের সবকিছুই যখন খোলা তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে দোষ কোথায়? তবে করোনার প্রকোপ যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হয় না সহসাই দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে। কারণ, আর কোথাও না হোক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিই হয়তো বিধিনিষেধ আরোপ হবে বেশি। বিকল্প একটা ভাবনার প্রয়োজন। সবকিছুই যদি খোলা রাখা যায় তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখেও কীভাবে করোনা মোকাবিলা করা যায় সেই পদক্ষেপ নেওয়াই বোধকরি সময়ের দাবি!

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ