X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ছবিটা পরিষ্কার হলো কি?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
৩১ মার্চ ২০২১, ১৭:০১আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২১, ১৭:০১

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
এবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হেফাজত যে দাঙ্গা করলো, বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, তা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ধারণায় একটা বাঁক আনলো বলেই মনে করা হচ্ছে। ঘোড়াসওয়ার, হাতে ঢাল-তলোয়ার, আরও সব অস্ত্রসহ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া যত বালক, নাবালক সৈনিক দেখা গেলো, যত সম্পত্তি ধ্বংস হলো, অতীতে তার নজির মেলে না। দেশজুড়ে দাঙ্গার রাজধানী হয়ে গেলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
 
এই নিরিখে এবারের সহিংসতার রাজনৈতিক যুক্তি যারা খুঁজছেন গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে কী নেই তার ভেতর, তারা ভুলে যাচ্ছেন যে এই হেফাজতে ইসলাম সংগঠনটি যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনকে নাস্তিকদের আন্দোলন বলে ঘোষণা দিয়ে সারাদেশে ভয়ংকর সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়েছিল। তখন সংসদ ছিল, বিরোধী দল ছিল, মত প্রকাশ নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। এবং ২০১৩ সালের ৫ মে কোনও প্রকার উসকানি ছাড়াই দেশের সম্পদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নারীদের ওপর হামলে পড়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করেছিল।  
হেফাজতের এবারকার সহিংস রূপের ইতিবাচক দিক আছে অনেক। প্রথমত, হেফাজত নিজেকে যতই শান্তিপূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন বলে দাবি করুক, এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো এটি উগ্রবাদে বিশ্বাসী একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে এটি পরিষ্কার নিশ্চয়ই হয়েছে যে যতই তাদের কওমি ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, তাদের কথায় পাঠ্যবই বদলে ফেলা হোক, তারা বদলাবে না। তারা বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে দেখে, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তাদের অবস্থান কী, এ দেশের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও কৃষ্টির জায়গায় তারা কোন নীতি অনুসরণ করে সবই পরিষ্কার হয়েছে।  

যারা সরকারের বিরুদ্ধে তারাও বুঝলো, তাদের মতো করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের বিরোধিতা করলেও হেফাজত আসলে তাদের রাজনীতির ধারে-কাছেও নেই। যেসব আন্তর্জাতিক সংগঠন বাংলাদেশের বিরাজমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা বলেন, তারাও দেখলেন বাংলাদেশের রাজনীতিটা এখন কোথায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বাইরের রাজনীতির শক্তি কোনটি সেটাও দেখতে পেলো দুনিয়া। বাংলাদেশের সরকারবিরোধী রাজনীতি আসলে কোনটি সেটিও পরিষ্কার হলো এবার।

২০১০ সালে সরকার ঘোষিত নারী নীতির বিরুদ্ধে কিছু ইসলামি দল একত্রিত হয়ে হেফাজতে ইসলাম গঠন করে। এরা যে ১৩ দফা তখন দিয়েছিল, তা পুরোপুরি মধ্যযুগীয়, যদিও হঠকারী দু’একজন বাম বুদ্ধিজীবী সেই দফাগুলোর প্রতি সমর্থনও জানিয়েছিল।

এরপর ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে এই সংগঠনটিকে মাঠে নামায় যুদ্ধাপরাধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক শক্তি। সে বছরের ৫ মে শাপলা চত্বরে তাদের ডাকা সমাবেশের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। সরকারের কড়া অবস্থানের কারণে তাদের ছত্রভঙ্গ করা গিয়েছিল।
 
সেদিন যারা মতিঝিলে ছিলেন কিংবা টেলিভিশনে হেফাজতের তাণ্ডব দেখেছেন তাদের মানুষের সামগ্রিক স্মৃতিতে গভীর ভাবে গেঁথে গিয়েছে সেদিনের সহিংসতা। সেদিনের স্মৃতি, অনুভব, মনে ছাপ-পড়া ছবি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে বেড়াবেন তারা, যেমন করে বয়ে বেড়াবেন এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী কিংবা আরও বেশ কিছু জায়গার মানুষ। কিন্তু দুটি ঘটনাতেই প্রমাণ হয় যে বাংলাদেশের শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে তাদের প্রতি একটি সহানুভূতি আছে। যাকে তাকে যখন তখন নাস্তিক বলা, সমাজবিরোধী ফতোয়া দেওয়ার প্রতিও এদের সমর্থন শুধু সরকার বিরোধিতার জায়গা থেকে। আবার ২০১৩ সালের পর হেফাজতের প্রতি ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের যে নমনীয় মনোভাব তার ভিত্তিও কিন্তু অন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। উভয়েই যে ভুল পথে হাঁটছে সেটা নিশ্চয়ই এবার বুঝতে পারার কথা।
 
২০১৩ সালের ৫ মে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যে দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন সেটা ছিল আওয়ামী লীগের আসল রাজনীতি। তার বিদায়ের মধ্য দিয়ে সেই রাজনীতিটাই যেন বিদায় নিয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে হেফাজতের আবদার রক্ষা বা তাদের আসকারা দেওয়ার পরিণতি হলো আজ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ওপর হামলা, স্বাধীনতা, সংস্কৃতির ওপর হামলা। বিএনপি ও জামাতের কাছে হেফাজতে ইসলামর গ্রহণযোগ্যতা আগে থেকেই ছিল। এবার দুঃখজনকভাবে তারা বাম শক্তিরও সমর্থন পেলো পরোক্ষভাবে।

হেফাজতের এই আন্দোলনে সবার অবস্থানই পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শরিফুজ্জামান শরীফ তার ফেসবুক পেইজে লিখেছেন ‘গত কয়দিনের সামগ্রিক পরিস্থিতির পর বাম দলগুলোর সাথে হেফাজতে ইসলামের ভেতরের সম্পর্ক পরিষ্কার হওয়া উচিত। সাইফুল হক ও জুনায়েদ সাকী বাম জোট করবেন আবার হেফাজতের হরতাল সমর্থন করে ভাসানী অনুসারী পরিষদের সভায়ও যাবেন, এটা হয় না’। তিনি বলেন, আর কারও কথা না বললেও সিপিবি নেতৃত্ব বলুক পার্টি কোন লাইন বলে সমর্থন করছে সেই কৈফিয়ত চাওয়া উচিত। শরীফের পরিষ্কার কথা, ‘আমরা গণতন্ত্রের জন্য, ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়বো, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধেও লড়বো’।
 
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে ছবি আমরা দেখলাম তা সুপরিকল্পিত হিংসার ছবি। সম্পূর্ণ অরাজক, বিস্ফোরক এক পরিস্থিতির ছবি, যার গতি-প্রকৃতি আগাগোড়াই ছিল হেফাজত নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। উল্টোদিকে সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কল্পনার বাইরে এবং যথারীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অবাধে সন্ত্রাস হয়েছে, লুটতরাজ চলেছে। আর ছিল অনবরত ঘুরপাক-খাওয়া গুজব, যা ভয় ছড়ালো, সহিংসতা আরও উসকে দিলো।
যখন থানায় আক্রমণ হয়, সরকারি স্থাপনা ধ্বংস করা হয়, রেলস্টেশন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, যখন জেলা আওয়ামী লীগের নেতার বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তখন মানুষের ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। ঘোরার পিঠে চড়ে, তলোয়ার হাতে এ যুগের বখতিয়ার খিলজিদের যারা লালন করেছে, শিক্ষা তাদের যদি হয়, তবে সেটাই প্রাপ্তি।

সহিংসতার যে উন্মত্ততা দেখা গেলো, তাকে আমরা কী করে ব্যাখ্যা করবো? আমার মনে হয়, তা বুঝতে হলে আমাদের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে আর একটু বড় পরিসরে দেখতে হবে। কারা কীভাবে সহিংসতার প্রতি রাজনৈতিক প্রণোদনা দেয়, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের জোয়ার আনতে চায়, তাদের বুঝতে হবে। মাদ্রাসার ছাত্ররা কেন উসকানিদাতা নেতাদের হাতের পুতুল হলো সেটা ভেবে দেখা দরকার। উসকানিতে উত্তেজিত হওয়ার জন্য তাদের কতটা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, কীভাবে তাদের প্রস্তুত করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তা এক বহুমাত্রিক প্রশ্ন, যা বহুমাত্রিক উত্তর দাবি করে ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের কাছ থেকেই।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রখর রোদে নষ্ট হচ্ছে মাঠের ফসল, বৃষ্টি পেতে নামাজে মুসল্লিরা
প্রখর রোদে নষ্ট হচ্ছে মাঠের ফসল, বৃষ্টি পেতে নামাজে মুসল্লিরা
সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিতে চাকরি, ৫ ক্যাটাগরির পদে নিয়োগ
সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিতে চাকরি, ৫ ক্যাটাগরির পদে নিয়োগ
অলিম্পিকের আগে জার্মানিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শায়েরা-রবিউলদের
অলিম্পিকের আগে জার্মানিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শায়েরা-রবিউলদের
জিম্বাবুয়ে সিরিজের প্রস্তুতি ক্যাম্পে ডাক পেলেন সাইফউদ্দিন
জিম্বাবুয়ে সিরিজের প্রস্তুতি ক্যাম্পে ডাক পেলেন সাইফউদ্দিন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ