X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: গানের শিল্পীরা কেমন আছেন?

মাকসুদুল হক
০৯ মে ২০২১, ১১:৪৩আপডেট : ০৯ মে ২০২১, ১১:৫১

মাকসুদুল হক ভবের গান গাইতে পারি না আমার অভাবে ভাব জাগে না, আমি গান গাইতে পারি না - শাহ আব্দুল করিম

হ্যালো... কেমন আছেন গানের শিল্পীরা এই ভয়াবহ মহামারির মাঝে? সব ভালো তো? কেউ কি আপনাদের খোঁজখবর নিয়েছেন বা খবর রাখছেন? কেউ কি জানতে চেয়েছেন আপনারা কোনও ধরনের কষ্টে আছেন কিনা?

অনেক লোকেরই বদ্ধমূল ধারণা গানের শিল্পীরা বিরাট ধন সম্পদ থাকা ‘মালদার পার্টি’– এবং এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে অনেকে এও মনে করেন যে শিল্পীরা গায়ে বাতাস খেয়ে দিন যাপন করে। তাই কি?

না কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। আর ১০ জনের মতো আমরাও মানুষ। মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার আমাদেরও আছে এবং গলা বিক্রি করলেও, আমাদের আত্মা ও শিল্পী-সত্তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি না। পাশাপাশি কোনও মূল্যে বিক্রি করি না আমাদের সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত আত্মবিশ্বাস।

আমাদের অতি কষ্টে সৃষ্ট অপার্থিব সম্পদ ‘গান’ বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে যে সমৃদ্ধ করেছে তা অনস্বীকার্য। তবে এ কারণে গানের শিল্পীদের ভাগ্যের ব্যাপক কোনও পরিবর্তন এসেছে এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। অন্তত গত এক বছরেরো বেশি সময়ে আমাদের বেঁচে থাকার উৎস– টিভি অনুষ্ঠান, কনসার্ট, অডিও ভিডিও রেকর্ডিং, সংগীতের শিক্ষকতা বা গানের শিল্পীদের তালিম ইত্যাদি সব বন্ধ থাকা ও অনিশ্চয়তার কারণে কী মানবেতর জীবনযাপন গানের শিল্পীরা করছে, তা কেবল আমরাই জানি।

আমরা যারা গান ছাড়া উপার্জনের অন্য কোনও পথ জানি না, চোখ-লজ্জায় আমাদের দুরবস্থার কথা কারো সাথে শেয়ার পর্যন্ত করি না। যদি বিন্দুমাত্র ‘অহংকার’ করার মতো কিছু থেকে থাকে, তা আমাদের এই অতি তীব্র আত্মসম্মান বোধ। তবে গত দুর্বিষহ বছরে গানের শিল্পীরা যে রূঢ় অবস্থাতে বেঁচে আছে তা চোখ, হাত, পা বেঁধে নদীতে ফেলে সাঁতার কেটে প্রাণ বাঁচানো চেষ্টার সাথে তুলনা করা যায়। ‘নাও এবার একটু হাসো, নাচো, একটু গান গাও প্লিজ’ - বিষয়টা কত ‘মজার’ তাই না?

লকডাউন বলবৎ থাক বা শিথিল হোক সব কিছুই প্রকাশ্যে ও আক্ষরিক অর্থে ‘উন্মুক্ত’। সব জায়গায় মানুষের ভিড় - হোক সে শপিংমল, রাজনৈতিক মিটিং, ক্রিকেট ফুটবল খেলা, প্রচার প্রোপাগান্ডা, এমনকি ওয়াজ মাহফিলগুলোতেও শুনেছি তিল দাঁড়ানোর ঠাঁইটুকু থাকে না। অথচ যত ‘সমস্যা’ শিল্পীদের গান করার ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রে।

এ নিয়ে কেউ কথা বলার সাহস করে না কারণ নিরীহ ‘ভদ্র’ শিল্পীদের টুটি-চেপে স্তব্ধ করে দিলে কারো তেমন কিছুই যায় আসে না। এছাড়া মিডিয়া, প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক সৃষ্ট গানের শিল্পীদের অলিখিত ‘কালো তালিকা’ ধারালো তরবারির ন্যায় আমাদের ঘাড়ের উপরে সবসময় দণ্ডায়মান - তা কে না জানে? বিপদ ঘটলে বড়জোর ‘ছুক ছুক ছুক কি দুঃখজনক’ মার্কা ফেসবুক স্ট্যাটাস কপালে জুটলেও জুটতে পারে। থাক সেসব কথা...

গানের শিল্পীরা মরার সময় অসুস্থ হয়ে অনাহারে ‘দুস্থ শিল্পীর’ তকমা গায়ে লাগিয়ে মরবে, এ-তো এখন সাধারণের ‘স্বাভাবিক ধারণা’ কেবল নয়, রাষ্ট্রও তাই বিশ্বাস করে ও তার জন্য রয়েছে ‘দুস্থ শিল্পীদের তহবিল’। এই তহবিলের অস্তিত্বই আপাম গানের শিল্পীদের শিল্পী সত্তাকে চরম অপমান করে ধূলিসাৎ করার জন্য যথেষ্ট - এই কথাতে কি কোনও গলদ আছে? তবে যাই বলেন, বিষয়টা কিন্তু খুবই ‘কিউট’ তাই না?

কী কারণে গানের শিল্পীরা উপেক্ষিত, কেন তাদের আজ অব্দি বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ লড়াই করতে হচ্ছে? এ ব্যাপারটি বুঝতে হলে পেছনের কিছু অপ্রিয় সত্য কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। তবে তার আগে গান বলতে আমরা কি বুঝি তা স্পষ্ট করাটা জরুরি মনে করছি-

গানের অন্তর্নিহিত শক্তি তার গতিশীলতা। ২ থেকে ৫ মিনিটের ভেতরে যে কোনও মেসেজ, যে কোনও বাণী - গান যে দ্রুততম সময়ে মানব মস্তিষ্কে অ-মুছনীয় ছাপ রাখতে পারে, তা সমগ্র শিল্পকলার অন্য কোনও মাধ্যম দ্বারা সম্ভব না। বুদ্ধিজীবীদের দিস্তা কে দিস্তা প্রবন্ধ, সাহিত্যিক কবিদের মোটামোটা বই যা করতে অক্ষম তা গানের শিল্পীদের জন্য ‘ওয়ান-টুর’ ব্যাপার। এর কারণ? গান শ্রবণ করতে, বুঝতে, কোনও কালেও, কারও কোনোরকম ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’ প্রয়োজন পরেনি। দুটো (বা একটি) কান থাকলেই গান বোঝা সম্ভব। গানের শিল্পীরা ২ থেকে ৫ মিনিটে বা তার কম সময় যে অসাধ্যটা সাধন করে, তা একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের চেয়ে কোনও অংশে কম না।

বাংলাদেশের গানের ভুবনে দেখতে দেখতে আমার নিজেরই ৪৫ বছর পার হয়ে গেলো। সময়টা সব সময় যে ‘খুব ভালো’ ছিল তা বলা যাবে না - তবে মন্দ ছিল সেটা বলা চূড়ান্ত অন্যায় হবে। ১৬ কোটি মানুষের তৃতীয় বিশ্বের এই দরিদ্র দেশে আমরা হাতে গোনা ক’জন শিল্পী নিজেদের একটা অবস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছি, পেয়েছি মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা।তথাকথিত ‘জন+অপ্রিয়তা’ ‘জনপ্রিয়তা’র তোয়াক্কা না করে, ‘সম্মানের আসন’ গেঁথেছি ভক্তকূলের অন্তরে এবং অগণিত গুণগ্রাহীর হৃদ-কোমলে। এর চেয়ে বেশি আর কি বা আশা করা যায়? টাকার অংকে কতই বা আমাদের ‘মূল্যে’, তা কি ‘মূল্যায়ন’ করা আদৌ সম্ভব?

আমাদের বিরল সৌভাগ্য এই সম্মান অনেক নেতা, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, বহুজাতিক কোম্পানি, ‘বিশিষ্টজন’, কোটিপতিরা পর্যন্ত প্রচণ্ড ঈর্ষার চোখে দেখে এসেছে। শুধু তাই নয় সময় সুযোগ বুঝে আমাদের পিঠে সওয়ার হয়ে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে, বা পণ্য বিক্রি করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এটাই গানের শিল্পীদের প্রকৃত অর্থে ‘শক্তি’।

তবে গানের শিল্পীদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ‘মহত্বের’ গুণগান ও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে, অহংবোধে ‘পালিশ মালিশ’ করে মসৃণ ও সূক্ষ্ম তৈলমর্দনের পর্ব শেষে এসব স্বার্থান্বেষী মহলের ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্ধার হওয়া মাত্রই যে চোখ পাল্টি দেবে– তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি আমাদের সব সময় থাকে। আমরাও স্বেচ্ছায়, হাসিমুখে ‘বলির পাঁঠার’ মতো সব মেনে নেই– কারণ এটাই স্বাভাবিক, এটাই বাস্তবতা, এটাই আমাদের ভাগ্য...

ব্যতিক্রমও আছে। খুবই মুষ্টিমেয় কিছু গানের শিল্পী এই শক্তিকে ‘ধান্দায়’ পরিণিত করে টেকাটুকা হাতিয়ে, কিছু মাস বা বছর ‘সুপারস্টার’, ‘সেলিব্রিটির’ তকমা এঁটে বাহ্ বাহ্ কামাতে পারে ও কামায়। প্রয়োজন কেবল মিডিয়া সহ অভিজাত মহলের সাথে শক্ত লবিং। আর বহুজাতিক বেনিয়াদের ক্রীতদাস হতে পারলেতো - কেল্লা ফতেহ! তবে শেষ অব্দি ‘জবাই’ যে হবে তা অবধারিত। এ হলো বিরাজমান ‘তারকাতন্ত্রের’ প্রকৃত শানে নুযুল। বিষয়টা বেশ ‘ওয়াও’ তাই না?

সে যাক...

শিল্পীর ভূষণ তার বিনয় - এই বিনয়ী মানুষগুলো তাদের শিল্পীসত্তা ধরে রেখেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সকল দুর্যোগপূর্ণ সময়ে। সব দুঃখকষ্ট উপেক্ষা করে জনগণের মনোবল, আস্থা ও সাহস জোগানোর যত রকম শিল্পকর্মের প্রয়াস ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, তারা গ্রহণ করেছে অকুতোভয়ে। নিঃসঙ্কোচে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে জাতির ক্রান্তিলগ্নে। তা ছাড়া চিত্তবিনোদন তো অবশ্যই গানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মানুষের মনে ক্ষণিকের জন্য হলেও আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়াটা কোনও পাপ নয়।

তথাপি বাংলাদেশের শিল্পীদের গান নিছক ‘গান’ বললে ভুল হবে। এ এক একটা ‘gun’ বা রাইফেলের মতো ‘ডেঞ্জারাস’ অস্ত্র। আমাদের প্রাচীনতম ইতিহাস বলে এ ‘অস্ত্র’ দ্বারা অনেক অসাধ্যই সাধন হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে গান ‘তোপ’ বা কামানের বারুদের মতো দাগ দাগিয়েছে।

উদাহরণ স্বরূপ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের তাক করা কামান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের কাফনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়ে, ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত হওয়াটা অনিবার্য করে তুলেছিল। আমাদের পূর্বপুরুষের ২০০ বছরের গোলামীর অবসান ঘটেছিলো গান ও গানের শিল্পীদের দ্বারা।

আরো পেছনের দিকে তাকালে আমাদের গরিমার মরমী কবি, সাধক, পদকর্তাদের দর্শন ও আধ্যাত্মিক প্রয়াস নির্ভর গান - আপামর জনসাধারণকে দিয়েছে সাম্যের শিক্ষা, শিখিয়েছে ধৈর্য্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শিখিয়েছে সহাবস্থান সহ সম্মান। ফকির লালন শাহ’র শিক্ষা আমাদের প্রকৃত ‘সোনার মানুষ’ হওয়া ছাড়া ‘কুতর্কহীন’ যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন করার চর্চা ও বাঙালি চিত্তে শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে হাজার বছরের লড়াই পুনরায় বলবৎ রাখার শক্ত অঙ্গীকার, সুস্পষ্ট ভাবেই ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন।

বলতে দ্বিধা নেই গানের শিল্পীদের রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান সহ বহুজাতিক বেনিয়া কারবারিরা বরাবরই উপেক্ষা করে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছে ও ‘লিপ সার্ভিস’ বা ‘ঠোঁটের সেবা’ প্রদান ব্যতিত, সব সময় ‘খতরনাক’ মনে করেছে। গানের শিল্পী তার সম্মান ছাড়া অন্য কিছুই মূল্যবান মনে করে না - সে কথা তারা জেনে বুঝেই অসম্মান করে এসেছে যুগযুগ ধরে। শিল্পী তাতে ভরকে যায়নি। তার প্রতিশ্রুতি কেবল জনগণের কাছে ও জনগণের ‘পাল্স’ বা হৃদপিণ্ডের স্পন্দনকে সে কখনই অবজ্ঞা করে না। এটাই ‘শিল্পী সত্তার’ সারাংশ।

যেকোনও সমরাস্ত্র সজ্জিত যুদ্ধের প্রারম্ভে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বা ‘সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’ যুদ্ধের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কৌশল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এর ব্যতিক্রমটি হয়নি - তবে যা অজানা রয়ে গেছে এতোগুলো বছরে–

১. আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূর্য সেনানীদের প্রথম কাতারে ছিলেন গানের শিল্পীরা। তাদের অন্তরাত্মা থেকে ছোড়া গুলি জনগণকে রণাঙ্গনের প্রথম ‘প্রস্তুতি সংকেত’ পৌঁছে দেয় এবং শত্রুর সুরক্ষিত ঘাঁটিতে সৃষ্টি করে তীব্র আতঙ্ক, ও তা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রর স্থাপনের অনেক আগে। এর সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাকের পরবর্তী সময়ে গানের শিল্পীদের ভূমিকা।

২. ৭ মার্চ বিকেল থেকে টানা ২৫ মার্চ ভয়াল কালরাত অব্দি তদানীন্তন পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান স্বাক্ষর রাখে, দেশপ্রেমী, বিদ্রোহী ও বিপ্লবী শিল্পীরা সেই সন্ধিক্ষণে চুপ করে বসে ছিলেন না। হাসিমুখে তারা কেন্দ্রগুলো দখল করে গড়ে তোলেন বিদ্রোহের প্রথম দুর্গ। এই শান্তিপূর্ণ বিদ্রোহ যে ‘দেশদ্রোহী’তার শামিল ও মৃত্যুদণ্ডই তার একমাত্র শাস্তি - তার পরোয়া তারা করেননি। উল্টো, বিজয়ের নিশান উড়িয়ে ছিল গানের শিল্পীরা সবার আগে, তাও জীবন্ত শত্রুর বুকের উপর দাঁড়িয়ে।

৩. তদানীন্তন টেলিভিশন কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার শ্রদ্ধেয় জামিল চৌধুরী ও মোস্তফা মনোয়ার সহ অনেক দেশপ্রেমিক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত নেতৃত্বে কালো সাদা পর্দায় হাজারো গান সমগ্র বাংলাদেশের লক্ষকোটি মানুষকে একত্রিত করে তারা যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে ছিলেন নির্ভয়ে।

৪. অনুরূপ ঘটনা ঘটলো বেতার তরঙ্গেও, তাই ৫০ বছর পর কেউ যদি বলে আমাদের জাতি ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর আগে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কোনোরকম ‘মানসিক প্রস্তুতি’ ছিল না - তা ডাহা মিথ্যা, একথা বলার অধিকার ও ক্ষমতা রাখে কেবল গানের শিল্পীরাই। যতদূর জেনেছি সেই দুর্লভ অনুষ্ঠানগুলো ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়, তাই তার রেফারেন্স বা আর্কাইভ আজ আর কোথাও নেই।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই সময় যেসব শিল্পী এই অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করতেন তারা অনেকে এখনও বেঁচে থাকা সত্ত্বেও তাদের এই বিষয়ে ঝঁঝা নীরবতা আমাদের অবাক করে দেয়। আমরা জানি অনেক ‘প্রকৃত’ মুক্তিযোদ্ধাদের মতো কণ্ঠযোদ্ধাগণ তাদের ‘বীরত্বের’ কথা প্রকাশ্যে বলার অভ্যাস নেই - এটা তাদের বিনয়ী স্বভাবের কারণেও হতে পারে।

তথাপি বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম প্রহরে তাদের নিঃস্বার্থ অবদান আজ অব্দি কোনও যুক্তিতে মূল্যায়ন হয়নি তা আমার বোধগম্য না। ‘আনসাং ওয়ারিয়র’ বা যেসকল যোদ্ধাদের নিয়ে কোনও রকম বীরত্বের গীত রচনা হয় না - সে ভাগ্য কি এই গুণী শিল্পীরা বরণ করেছেন?

প্রয়াত বন্ধু তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ ছবিতে কিছু সময় কাজ করার সুবাদে প্রথম জানতে পারি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানের শিল্পীদের দুঃসাহসিক ভূমিকার কথা। ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার’ কর্মের ওপরে নির্মিত এই সিনেমাটিক দলিল - একাত্তরের রণক্ষেত্রে গানের শিল্পীদের ত্যাগ ও সাধারণ জনগণ, ভারতে আশ্রয়প্রার্থী উদ্বাস্তু সহ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করার প্রচেষ্টা, পৃথিবীর ইতিহাসে খুবই অভূতপূর্ব এক দলিল।

মুক্তাঞ্চলগুলোতে নির্দ্বিধায় স্বশরীরে উপস্থিত থেকে গান গেয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। পাশাপাশি কলকাতা, আগরতলা সহ ভারতের অন্যান্য জায়গায় গোপনে রেডিও স্টেশন স্থাপন করা ছাড়াও, অর্ধাহারে-অনাহারে, অর্থকষ্টের ভেতরে থেকে, রাতদিন অসাধারণ সব অনুষ্ঠান তৈরি করে আমাদের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাসে তারা ঠিকই তাদের যথাযোগ্য স্থান করে নিতে পেরেছে।

এতকিছুর পরেও গানের শিল্পীদের প্রতি রাষ্ট্র বা সমাজের আদৌ কি কোনও দায়বদ্ধতা বর্তায়? যারা আমার এই আবেগপূর্ণ লেখাটা প্রথম থেকে ধর্য্য সহকারে পড়ছেন - তারা নিশ্চয়ই এই প্রশ্নের কিছু উত্তর এতক্ষণে পেয়ে গেছেন।

২০২০-এ মহামারি শুরু হবার ঠিক পরপর কিছু ভাসা ভাসা অস্পষ্ট খবর আসে যাতে বোঝা গেলো সরকার ‘শিল্পীদের’ জন্য সরাসরি নগদ অর্থের অনুদান সহ ভর্তুকি ও প্রণোদনার কথা ভাবছেন।

খুবই ভালো কথা, কিন্তু বাগড়া বেধে গেল ‘শিল্পী’ কে - বা কী, তার সঠিক রাষ্ট্রীয় সংজ্ঞা কী এসব নিয়ে। জানা গেলো যে সরকারি ভাবে ‘তালিকাভুক্ত’ বা এনলিস্টেড আর্টিস্টরাই প্রাথমিক ভাবে এই সুবিধা পাবে এবং তা পেয়েছে। সরকারি বেতনভোগী শিল্পী যেমন টেলিভিশন, রেডিও সহ শিল্পকলা একাডেমি ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ে তালিকাভুক্তরা অগ্রাধিকার পাবে - এটাই স্বাভাবিক।

কত টাকার অংক, লাখ নাকি কোটি নাকি হাজার কোটি এ নিয়ে শিল্পীদের বিশ্রি রকমের বাহাস ও কামড়াকামড়ি দেখে হতবাক হওয়া ছাড়া আমার তেমন কিছুই করার ছিল না। কেটে পড়লাম... কারণ আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ গানের পেশাদার শিল্পীরা কেউ কোনও তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত নন। আমি নিজেও সেই দলের একজন।

শিল্পী-সত্তার মূল বিষয়টা হলো শিল্পী সম্পূর্ণ মুক্ত বিহঙ্গ। তার বিচরণ ব্রহ্মাণ্ড থেকে আকাশ পর্যন্ত। কোনও ভাবেই পায়ের বেড়ি পরিয়ে তার সৃষ্টিশীলতাকে আটকানো যাবে না। বিশ্ব জুড়ে সঙ্গীত শিল্পীরা রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেদের জড়ায় না। সে বেঁচে থাকতে চায় কেবল তার সৎ, স্বাধীনসত্তা নির্ভর কর্ম দিয়ে - কারণ শিল্পীদের কর্মই তাদের ধর্ম।

অপর-দিকে তালিকাভুক্ত শিল্পীদের অনেক সীমাবদ্ধতার ভেতরে থাকলেও বেশ কিছু সুখ-সুবিধা আছে। নিয়মিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান অংশগ্রহণ ও বিদেশে সরকারি প্রতিনিধি দলগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আমাদের গান বহির্বিশ্বে তুলে ধরা তার অন্যতম। এর পাশাপাশি রয়েছে দেশজুড়ে রাষ্ট্র পরিচালিত অগণিত ললিতকলা ইন্সটিটিউট ও একাডেমিতে চাকরি।

রোজগারের ধারাবাহিকতা বজায় যেহেতু থাকে আমাদের মতো শিল্পীদের চেয়ে তাদের মানসিক চাপ কম। অন্তত সম্ভাব্য বেকারত্বের অভিশাপ থেকে তারা অনেকটাই আতঙ্কমুক্ত। তবে প্যানডামিকে যে পরিমাণ অর্থ সাহায্য রাষ্ট্র দিয়েছে (‘দুষ্ট লোকের’ কথা যদি সত্য বলে ধরি, তা ছিল জনপ্রতি ২ থেকে ৫ হাজার টাকা মাত্র) তা কেবল ‘খয়রাতের’ সাথে তুলনা চলে। আরো ভয়াবহ তা ‘এককালীন'।

যেখানে রাষ্ট্র বারবার সতর্ক করছে করোনাকালীন সময় চলবে ‘বহুদিন’, এই ‘এককালীন’ ভাতা কতদিন, কত মাস, কত বছর, কত ‘কাল’ - শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখবে? আরো দুঃখজনক– অনেক তালিকাভুক্ত গানের শিল্পীরা এই অনুদান পায়নি। অপরদিকে অনেক ‘অশিল্পী’ ছাড়াও তালিকার বাহিরের শিল্পীরাও অনুদান পেয়েছে। স্পষ্টত এই ভয়াবহ করোনাকালীন সময়ে ‘শিল্পী বাছাই’ প্রক্রিয়ায় লবিং সহ দুর্নীতির কটু গন্ধ পাওয়া গেলো।

যে কোনও জাতীর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ধস নামলে তার থেকে উত্তরণ খুব বেশি সময় লাগে না - তবে যে জাতীর সাংস্কৃতিক ধস একবার নেমে আসে, তার ঘুরে দাঁড়িয়ে, ফের শক্ত ভিতের উপরে পূণ্যবস্থান চাট্টি খানিক বিষয় নয়। বাঁকা মেরুদণ্ড সোজা করাটাও হয়তোবা সম্ভব- কিন্তু ভাঙা মেরুদণ্ড, ভাঙা বাঁশের মতো - মেরামত করেও জোড়া দেওয়াটা অকল্পনীয়।

এ দেশের প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতির ধস সেদিনই নামবে যেদিন গানের শিল্পীরা ভিক্ষার থালা নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরবে। বাংলাদেশের সূর্য সন্তানদের এ করুন ভাগ্য যেন না ঘটে, তার জন্য অনতিবিলম্বে প্রয়োজন শিল্পকলা একাডেমি সহ সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ে অভ্যন্তরে স্তূপ হয়ে থাকা আবর্জনা পরিষ্কার করে যোগ্যলোক দ্বারা নতুন করে ঢেলে সাজানো। এছাড়া সংস্কৃতি খাতে অনুমোদন দেওয়া জনগণের টাকার পূর্ণাঙ্গ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।

সংস্কৃতিকে ‘প্রায়োরিটি সেক্টর’ ঘোষণা করা হোক। গানের শিল্পীদের রুটি রোজগার ছাড়াও মেধা সত্তা অধিকার, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নির্লজ্জ আস্ফালন সহ বহু গুরুতর বিষয় এখনও অমীমাংসিত। এখনও সময় আছে।

পাশাপাশি প্রয়োজন একটা শক্তসমর্থ ‘ডাটাবেজ’ যেখানে তালিকাভুক্ত কেবল নয়– জন-নন্দিত ও গুণী শিল্পী সবাই তাদের সংস্কৃতি ও দেশের প্রতি অবদানের প্রমাণ স্বরূপ অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। দেশবাসীর হাতের নাগালেও থাকবে এই ডাটাবেজের এক্সেস।

এই ছোট্ট আশাটুকু নিয়ে সবাইকে আসন্ন ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।

লেখক: সংগীতশিল্পী

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ