X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

তদন্ত কমিটির রিপোর্টগুলো কোথায় যায়?

জোবাইদা নাসরীন
২৯ জুন ২০২১, ১৫:৫২আপডেট : ২৯ জুন ২০২১, ১৫:৫২
জোবাইদা নাসরীন একেই বলে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা! একে তো করোনার ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে এই করোনার সঙ্গে যুদ্ধের চলমান অংশ হিসেবে জারি থাকা ঢিলেঢালা লকডাউন এবং সামনের মাসের এক তারিখ থেকে শাটডাউনের ঘোষণা জনজীবনে এক ধরনের ভয়, আশঙ্কা, মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ঘটেছে দু’দিন আগেই। গত রবিবার সন্ধ্যায় ঢাকার মগবাজারের ব্যস্ত ওয়্যারলেস গেট এলাকায় বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেছে। ঘটনাস্থল মগবাজার বলে হয়তো সবার আতঙ্ক আরও বেশি। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এই বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত  মৃত্যু ঘটেছে সাত জনের। হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন আট জন। আহত হয়েছেন শ’দুয়ের ওপর। দেখা গিয়েছে যে বিস্ফোরণের মূল জায়গার পাশাপাশি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে তিনটি ভবন। বিস্ফোরণ এত প্রকট ছিল যে  আশপাশের অনেক ভবন এবং সড়কে থাকা বাসের কাঁচ উড়ে গেছে এবং শিক্ষার্থীরাও আহত হয়েছেন। বিস্ফোরণে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে সময়ে সড়কে থাকা তিনটি বাস। সেগুলোর ছবিও আমরা পত্রিকায় দেখেছি।

এই ঘটনার কারণ এবং এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ করার জন্য ইতোমধ্যে অন্যান্য ঘটনার মতোই অতি দ্রুতই গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। তবে এবারের তদন্ত কমিটি অনেক বেশি। ঘটিত হয়েছে চার-চারটি তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর, বিস্ফোরক পরিদফতর, পুলিশ সদর দফতর এবং তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। সব কমিটির সদস্যরাই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গণমাধ্যমের সঙ্গে তাদের প্রাথমিক ধারণা এবং পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছেন। কমিটিগুলোকে খুব দ্রুততম সময়ে রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আপাত মনে হচ্ছে সরকার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।

তবে এই তথ্যও এখানে জানান দেওয়া দরকার যে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনায় বারবার কমিটি হয়। সেই কমিটিগুলোর রিপোর্ট কোনটি জমা হয়, কোনটি হয় না। কোন কোন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ‘ফর্মালিটি’ শেষের প্রক্রিয়া হিসেবে ফাইলেই পড়ে থাকে। দুই একটি কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ গণমাধ্যমে আলোচনায় এলেও সেই বিষয়গুলো নিয়ে কোনও ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যার কারণে বারবার ঘটছে একই ধরনের দুর্ঘটনা। তাই তদন্ত কমিটি গঠন এখন একটি ‘রুটিন’ কাজ এবং মানুষ এর থেকে খুব বেশি কিছু আশা এখন আর হয়তো করে না। কেন এই আশাহীনতা? এর পেছনেও কারণ আছে।

এ বিষয়ে হয়তো সবাই একমত হবেন যে বাংলাদেশে এই ধরনের বিস্ফোরণ এবং মানুষের মৃত্যু নতুন কোনও ঘটনা নয়। বিশেষ করে ২০১০ সালে ভয়াবহ নিমতলী ট্র্যাজেডির পরেও হয়েছিল তদন্ত কমিটি।  সে সময়  ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৩ জন প্রাণ হারান। তবে সেই কমিটি রিপোর্ট দিয়েছিল এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশও করেছিল। কিন্তু  তাদের সেই সুপারিশ যে বাস্তবায়িত হয়নি কিংবা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘অনিচ্ছা’ ছিল তার  প্রমাণ হিসেবে আমাদের জীবনে নয় বছর পর এসেছিল চকবাজার ট্রাজেডি। নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরপরই আমরা সরকারিভাবে কিছু সিদ্ধান্তের কথা শুনেছিলাম। সেই আলোচনারই অংশ হিসেবে সিদ্ধান্ত আসে যে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে কেমিক্যাল পল্লি কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে সেটি যে শুধু সিদ্ধান্তই ছিল এবং সেটি নিয়ে শুধু আলোচনাই হয়েছিল গণমাধ্যমে। এর বাইরে এই সিদ্ধান্তের কোনও ধরনের কার্যকর প্রয়োগ কিংবা বাস্তবায়ন করার অভিপ্রায় কোনোটিই আসলে দৃশ্যমান হয়নি। যার ফল আমাদের ভোগ করতে হয়েছে। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় পারফিউমের ফ্যাক্টরি ও গোডাউনে অগ্নিদুর্ঘটনায় ৭১ জন প্রাণ হারান। সেই সময় আবারও আলোচনায় আসে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর বিষয়টি। ঘটনা ঘটলে হাহাকার হয়, আহাজারি হয়, মানুষ মারা যায়, জীবন ওলট-পালট হয় কিন্তু আগের মতোই দু’-চারদিন পর সেটি থেমে যায় এবং কার্যত কোনও ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।

গত এপ্রিলেই ঘটেছে এ ধরনের আরেকটি ঘটনা। তবে সেখানে নিহত হয়নি। সে সময় ঘটনাটি হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা জামাই বাজার এলাকায়। সেখানে  একটি তিনতলা ভবনে গ্যাস বিস্ফোরণে শিশুসহ ১১ জন দগ্ধ হয়েছিল। সেই ঘটনার কারণ উদঘাটন করতে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটি  তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। তবে সেই তদন্ত রিপোর্ট জমা হয়েছিল কিনা এবং সেটিতে কী ত্রুটি তারা পেয়েছিলেন সেই বিষয় আর কোনও সংবাদ গণমাধ্যমে পাওয়া যায়নি।

এখন প্রশ্ন হলো কেন তদন্ত কমিটি করা হয়? নিশ্চিতভাবেই সেটি কারণ খতিয়ে দেখার জন্য। এ ধরনের ঘটনা যেন আর কখনও না হয় সেই বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ঠিক উল্টো। আমরা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বেশিরভাগ সময়ই জানতে পারি না। কোথায় থাকে বা যায় সেই রিপোর্টগুলো? খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, আদতে কি তদন্ত কমিটি  রিপোর্ট জমা দেয়? বেশিরভাগ রিপোর্ট কেন প্রকাশ করা হয় না? নিমতলীর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি যে সুপারিশ করেছিল, সেগুলো আমলে নিতে সমস্যা কাদের এবং কেন?
আমরা আরও জেনে গেছি, এই প্রশ্নগুলোরও হয়তো উত্তর মিলবে না। আমরা জানি না এই গঠিত হওয়া চারটি তদন্ত কমিটির আদৌ পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবে কিনা? জমা দিলেও সেই রিপোর্ট আমরা জানতে পারবো কিনা? সেই রিপোর্ট অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগ কোনও ধরনের পদক্ষেপ কি নেবে?

যদি এখনও ‘তদন্ত কমিটি’ করা পর্যন্তই কাজ- এই জায়গায় আমরা স্থায়ীভাবে দাঁড়িয়ে থাকি তাহলে কিছু দিন পর পরই এরকম ভয়াবহ ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে। আসলে আমরা প্রতিনিয়তই হচ্ছি। তাই এবারের ঘটনাও যদি আমাদের কার্যত কিছু করার দিকে নিয়ে যায় সেটি অন্তত হবে আমাদের আস্থার জায়গা। জীবন ফিরে আসবে না, কিন্তু বেঁচে থাকাদের জীবনগুলো যেন গুরুত্ব পায় এই রাষ্ট্রে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]
 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কেনাকাটার একাল-সেকাল
অনলাইন শপিংকেনাকাটার একাল-সেকাল
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ‘ইন্ডিয়া-আউট’ ক্যাম্পেইন: বাস্তবতা ও সম্ভাব্য ফলাফল
বিএনপির ‘ইন্ডিয়া-আউট’ ক্যাম্পেইন: বাস্তবতা ও সম্ভাব্য ফলাফল
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ