X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পারমাণবিক বিদ্যুতেই ভবিষ্যৎ

কাজী জাহিন হাসান
১৯ জুলাই ২০২১, ১১:৩৯আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২১, ১১:৩৯

কাজী জাহিন হাসান নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টকে নিরাপদ বলায় বিস্মিত হতে পারেন অনেকে। তথাপি এখনকার পাওয়ার প্লান্টগুলোতে কিন্তু অতীতের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বছরে বায়ুদূষণের কারণে মারা যাচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। এ বিপুল পরিমাণ মৃত্যুর নেপথ্যে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানিই দায়ী। তথাপি, আমরা মনে করি জীবাশ্ম জ্বালানি মাত্রই নিরাপদ।

অন্যদিকে, ৭০ বছরের ইতিহাসে খুব কম মানুষই নিউক্লিয়ার প্লান্টের কারণে মারা গেছে। তারপরও, চেরনোবিল ও ফুকুশিমার ঘটনায় অনেকেই ধরে নিয়েছে পারমাণবিক জ্বালানি নিরাপদ নয়।

বিভিন্ন ধরনের জ্বালানির উৎসের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা একটা তুলনামূলক বিচার করতে পারি। এক্ষেত্রে প্রতি হাজার টেরাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুতের বিপরীতে মৃত্যুর একটা হিসাব আছে। যেমন কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি হাজার টেরাওয়াট-ঘণ্টার বিপরীতে মারা যায় প্রায় এক লাখ মানুষ। প্রাকৃতিক গ্যাসের বেলায় মুত্যুর সংখ্যার চার হাজার। অন্যদিকে সোলার প্যানেলে ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ তৈরিতে পরোক্ষভাবে মারা যাচ্ছে ৪৪০ জন। পাঠক জেনে অবাক হবেন যে, এ পরিসংখ্যানের সাপেক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ হলো নিউক্লিয়ার জ্বালানি। এ উৎস থেকে প্রতি হাজার টেরাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুতের বিপরীতে মারা যায় মাত্র ৯০ জন (তথ্যসূত্র: স্ট্যাটিস্টা ডট কম ও ফোর্বস)।

চেরনোবিল দুর্ঘটনা

চেরনোবিল দুর্ঘটনাই হলো একমাত্র নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা যেখানে তেজষ্ক্রিয়াজনিত কারণে অনেকের মৃত্যু হয়েছিল। ওই ঘটনায় ঠিক কতজন মারা গিয়েছিল সেটা নিয়ে সঠিক কোনও হিসাব পাওয়া যায় না।

২০০৫ সালে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা একবার জানিয়েছিলেন, চেরনোবিলের সরাসরি তেজষ্ক্রিয়ায় মারা গিয়েছিলেন ৫০ জন। এর বাইরে তেজষ্ক্রিয়ার ফলে ক্যান্সার হয়ে আরও চার হাজার মারা গিয়ে থাকতে পারে বলে তখন ধারণা করা হয় (যারা হয়তো ইতোমধ্যেই মারা গেছেন)।

রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর অনুমান বলছে ওই ঘটনার পর ‘লিকুইডেটর’ (যারা ঘটনাস্থল পরিষ্কার করার কাজ করেছিলেন)-এর মধ্যে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মারা যান লক্ষাধিক। যাদের সংখ্যা এক লাখ ১২ হাজার থেকে এক লাখ ২৫ হাজারের মধ্যে ছিল।

ধরে নিলাম সংখ্যাটা এক লাখ ২৫ হাজার। তথাপি, এ সংখ্যাটা জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে বছরে মারা যাওয়া চল্লিশ লাখের চেয়ে অনেক কম। আর ওই দুর্ঘটনার কারণ ছিল নকশায় ত্রুটি ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি।

প্রতিটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কন্ট্রোল রড থাকে। ফিশন প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম পরমাণুর ভাঙনের ফলে সৃষ্ট নিউট্রনের কারণেই মূলত নিউক্লিয়ার চেইন রিয়েকশনটা চলতে থাকে। কন্ট্রোল রডগুলো তৈরি করা হয় সেই নিউট্রনগুলো শোষণ করার মতো উপদান দিয়ে।  

রিয়েকটরের কেন্দ্রে (কোর) যখন কন্ট্রোল রড নামানো হয়, তখনই চেইন রিয়েকশন বন্ধ হয়ে যায়। চেরনোবিলের ওই কন্ট্রোল রডগুলোর মাথায় ছিল গ্রাফাইট। গ্রাফাইট এমন এক প্রভাবক যা কিনা নিউক্লিয়ার চেইন রিয়েকশনকে আরও ত্বরান্বিত করে ও রিয়েকটরের তাপ বাড়ায়। এ জন্য কন্ট্রোল রড বানানোর ক্ষেত্রে গ্রাফাইট কখনই ব্যবহার করা হয় না।

চেরনোবিলের রিয়েকটরটা এমনভাবে নকশা করা হয়েছিল যাতে কিনা গ্রাফাইট যুক্ত কন্ট্রোল রডটা কখনই তুলে নেওয়ার কথা ছিল না। আর তুলে নিলেও পুনরায় ওটা স্থাপন করলে তাতে তাপ বেড়ে যাবে অস্বাভাবিক গতিতে।

ওই সময় অপারেটরকে সম্ভবত এ বিষয়ে ভালোভাবে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি। আর সম্ভাব্য কী ঘটতে পারে সেটাও হয়তো জানতেন না তিনি। সেফটি সিস্টেমের একটি পরীক্ষা করতে গিয়ে কন্ট্রোল রডগুলো পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়। আর ওই মারাত্মক ভুলের কারণেই ঘটে এতবড় বিপর্যয়।

নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরীক্ষা করতে গিয়ে শীতলীকরণ সার্কুলেশন পাম্পগুলোও বন্ধ রাখা হয়েছিল। আর এতেই রিয়েকটরের তাপ বেড়ে যায় হু হু করে। অবশ্য ওটা ছিল জানা কথা। পরীক্ষার অংশই ছিল তাপ বাড়ানো। কিন্তু পরে ওই তাপমাত্রা কমাতে ও চেইন রিয়েকশন বন্ধ করতে আবার ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কন্ট্রোল রডগুলো।

রিয়েকটরের ভেতর গ্রাফাইট-যুক্ত কন্ট্রোল রডের প্রান্তটি ঢুকতেই তাপ আরও বেড়ে যেতে থাকে। মানে, যখন তাপ কমে আসার কথা, সেখানে উল্টো বেড়ে যেতে থাকে। এতে করে রিয়েকটর কোরের তাপ চলে যায় সীমারেখার বাইরে। বাষ্পীভূত হয়ে যায় শীতলীকরণ যন্ত্রের পানি। ওই বাষ্প আবার প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে রিয়েকটরের ভেতর। ফলশ্রুতিতে বিস্ফোরিত হয় রিয়েকটর।

এ ছাড়া চেরনোবিল রিয়েকটরের জন্য কোনও কনটেইনমেন্ট ভবন তথা বিস্ফোরণ ঢেকে রাখার ব্যবস্থা ছিল না। উচ্চচাপযুক্ত তেজষ্ক্রিয় বাষ্প যেন ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্যই এমন কাঠামো তৈরি করা হয়। এটা না থাকাও ছিল চেরনোবিলের নকশাজনিত ত্রুটি। পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ওয়াটার-কুলড রিয়েকটরগুলোতে সবসময়ই এমন একটি নিরাপত্তা ভবন দেখা যাবে।

ফুকুশিমা দুর্ঘটনা

ফুকুশিমা দুর্ঘটনায় তেজষ্ক্রিয়ার কারণে মারা গিয়েছিল একজন। তবে ওই এলাকা থেকে জনগণকে তড়িঘড়ি সরাতে যাওয়ার কারণে মারা গিয়েছিল ২২০২ জন। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও অসুস্থরাই ছিল মৃত্যুর এ তালিকায়।

তোহকু ভূমিকম্প ও সুনামিতে (যার কারণে রিয়েকটর সাইট প্লাবিত হয়ে নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটে) মোট ১৫ হাজার জন মারা গিয়েছিলেন। তবে ওই মৃত্যু কিন্তু নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনার কারণে হয়নি।

ফুকুশিমার দুর্ঘটনার পেছনেও ছিল নকশায় মারাত্মক কিছু ত্রুটি।

ভূমিকম্প যখন হয়, তখন রিয়েকটরটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। একটি রিয়েকটর বন্ধ হলেও কিন্তু একে শীতল করতে হয়। তা না হলে ইউরেনিয়াম ফিশনের ফলের সৃষ্ট কিছু আইসোটোপ ফিশন চালিয়েই যায় ও তাপ তৈরি করতে থাকে।  

ভূমিকম্পের কারণে বাইরে থেকে প্লান্টে এসি বিদ্যুৎ দেওয়াটা সম্ভব হচ্ছিল না। তারপরও, সুনামির পানিতে নষ্ট হওয়ার আগপর্যন্ত রিয়েকটর ঠান্ডা করার কাজ করছিল জেনারেটরগুলো।

সাইটে থাকা ব্যাটারির সাহায্যে ওই প্লান্টে মোট আট ঘণ্টার ব্যাকআপ বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল। ব্যাকআপ জেনারেটরও ছিল। কিন্তু বেজমেন্টে গিয়ে সেগুলোর সুইচ অন করা যাচ্ছিল না। কারণ বেজমেন্ট ততক্ষণে তলিয়ে গেছে।  

ব্যাকআপ ব্যাটারির পাওয়ার যখন ফুরিয়ে গেলো, কুল্যান্ট সার্কুলেশন পাম্পগুলোও গেলো বন্ধ হয়ে। এতেই বেড়ে যায় কোর-এর তাপ। এরপর কুল্যান্ট-এর ভেতরে থাকা পানি জিরকোনিয়ামের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ইউরেনিয়ামের জ্বালানি রডের চারপাশে তৈরি করতে থাকে বিস্ফোরক হাইড্রোজেন গ্যাস।

হাইড্রোজেন গ্যাসের বিস্ফোরণেই রিয়েকটরের কনটেইনমেন্ট ভবনে তৈরি হয় গর্ত। বেরিয়ে পড়ে তেজষ্ক্রিয় বাষ্প (বাষ্পীভূত কুল্যান্ট)।

জেনারেটরসহ যাবতীয় সুইচ থাকার কথা উঁচু জায়গায়। এতে সাইট প্লাবিত হলেও ব্যাকআপ পাওয়ার দেওয়া যেত। আবার সমুদ্রঘেঁষা দেয়ালটাও যথেষ্ট উঁচু করে তৈরি করা দরকার যাতে সাইটে পানি ঢুকতে না পারে।

চেরনোবিল ও ফুকুশিমার নকশার ত্রুটি নিয়ে বিশদ গবেষণা হয়েছে। একই ধরনের ত্রুটি আর কোনও নিউক্লিয়ার প্লান্টে আছে কিনা সেটাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ঠিক করা হয়েছে, কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতের কোনও প্লান্টে কিন্তু এ ত্রুটিগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।

এখনকার নিউক্লিয়ার প্লান্টগুলো যথেষ্ট নিরাপদ। ‘রিডানডেন্ট কুলিং সিস্টেম’-এর মাধ্যমে এগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মানে হলো, কুলিং সিস্টেম কাজ না করলেও রিয়েকটর মাত্রাতিরিক্ত উত্তপ্ত হবে না। এ ছাড়া থাকবে বিশালাকৃতির কনটেইনমেন্ট ভবন, ছড়ানোর আগেই যা তেজষ্ক্রিয় বাষ্প ধরে ফেলবে।

সম্ভবত পরবর্তী প্রজন্মের নিউক্লিয়ার রিয়েকটরগুলো হবে সোডিয়াম-কুলড ফাস্ট রিয়েকটর (যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইয়োমিংয়ে তৈরি হতে যাচ্ছে এমন এক ন্যাট্রিয়াম রিয়েকটর) বা মলটেন সল্ট রিয়েকটর (চীনের উওয়েই শহরে পরীক্ষামূলকভাবে এমন একটি প্লান্ট তৈরি হচ্ছে)।

নতুন এই রিয়েকটরগুলোর নকশা এমন যে, এগুলো ওভারহিটেড হবেই না। সামান্য তাপ বাড়লেই বন্ধ হয়ে যাবে চেইন বিক্রিয়া। অপারেটরদের কোনও ভুলে বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটা সম্ভব নয়। আর একটা বড় বিষয় হলো, আগেরগুলোর তুলনায় নতুন নকশার রিয়েকটরগুলো নির্মাণে খরচও হবে কম।  

চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতো দুর্ঘটনা আবার ঘটনার আশঙ্কা একেবারে নেই বললেই চলে। অন্যদিকে, জলবায়ু বিপর্যয় ঠেকাতে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর পাওয়ার প্লান্ট থেকে সরে আসতেই হবে। এটাও সবাই জানে যে, সমুদ্রের পানির স্তর খানিকটা বাড়লেই বাংলাদেশের বহু অঞ্চল স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাবে।

এদিকে আবার, তাপ যত বাড়তে থাকবে, তত আমাদের জমিগুলো কৃষিকাজের অনুপযুক্ত হতে থাকবে। আর তাই জীবাশ্ম জ্বালানিকে ধীরে ধীরে বিদায় দেওয়ার উপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ। আর তা করার একমাত্র বাস্তবসম্মত উপায়টা হলো আরও বেশি নিউক্লিয়ার শক্তি উৎপাদন। সুতরাং, সময় হয়েছে নিউক্লিয়ার ভীতি দূর করার।

লেখক: চেয়ারম্যান, টু-এ মিডিয়া লিমিটেড

 

/এফএ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ