X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার উৎসব

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২১ জুলাই ২০২১, ১১:৪৭আপডেট : ২১ জুলাই ২০২১, ১৬:১৬

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা আবার ঈদ। আবার উৎসব। করোনায় উৎসব। আমাদের চাওয়া-পাওয়া, আমাদের আগামী, আমাদের ঘটমান ভবিষ্যৎ উৎসবের আতিশয্যে আজ মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে উদযাপিত হচ্ছে।

ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণে যখন বেশি সতর্ক থাকার দরকার, তখনই সাবধানতা থেকে সরে গেছি আমরা। বারবার বলা হচ্ছিল– সংক্রমণের দিক থেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পর্যায় পার করছি আমরা। যেখানে ঘরে থেকেও মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, দূরত্ববিধি বজায় রাখার মতো নিয়ম আরও সতর্কভাবে পালন করা দরকার, তখন আমরা সব শিথিল করে উদযাপনের উন্মাদনায় নিজেদের করোনার চেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ করার প্রয়াস নিয়েছি। জনগোষ্ঠীর বড় অংশের মধ্যে করোনা সতর্কতা কখনও ছিল না, আর এখন নীতিগতভাবেই তাদের আরও অসতর্ক থাকার পথটা খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে বিপদ আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন গবেষকেরা।

দেড় বছর ধরেই করোনাকে নিয়ে চলছি আমরা। এবং আগামী দিনেও চলতে হবে, জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা। কিন্তু কীভাবে চলা যাবে, তার উপায় কী হবে তার কোনও বার্তাই যেন পরিষ্কার হচ্ছে না মানুষের কাছে। উত্তরোত্তর সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং পাল্লা দিয়ে সব বিধিনিষেধ শিকেয় উঠছে। বলা হচ্ছে, কঠোর বিধিনিষেধ তথা লকডাউন আবার শুরু হবে ২৩ জুলাই থেকে, কিন্তু ১৪ জুলাই পর্যন্ত যে লকডাউন হলো, তার কোনও ইতিবাচক ফল দৃশ্যমান হলো না এখনও।

এমন নয় যে কেউই সংক্রমণ রোখার নিয়মগুলো মানেননি। অনেকেই মেনেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই মানেননি এবং মানানোর কোনও কার্যকর প্রচেষ্টাও ছিল না। এক পহেলা বৈশাখ ছাড়া দেড় বছরের করোনা জীবনে সবগুলো উৎসবই উদযাপিত হয়েছে। কোথায় আমরা আরও সজাগ হবো, তা নয়, বরং এখন নিয়ম পালনের ক্ষেত্রে আমরা কেমন যেন এক প্রকার হাল ছেড়ে দিয়েছি। এই হাল ছেড়ে দেওয়ার মধ্যেই বিপদ লুকিয়ে রয়েছে। কারণ, হাত ধোয়ার অভ্যাস ইতোমধ্যে চলে গেছে। মাস্কও আর কেউ পরতে চাইছেন না। ফলে সংক্রমণ রোখার প্রাথমিক নিয়মগুলোই প্রতিক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হচ্ছে।

সরকার বলেছিল, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোরবানির পশুর হাট বসবে। সেটা হয়নি। যেখানে কাঁচাবাজার কিংবা শপিং মলগুলোতেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যায়নি, সেখানে পশুর হাটে এটা সম্ভব হবে, সরকার তা ভাবলোই বা কী করে?  

মক্কায় মসজিদ বন্ধ থাকে, হজ হয় প্রতীকী। মালয়েশিয়ায় দীর্ঘ সময় করোনার সংক্রমণের ভয়ে মসজিদ বন্ধ ছিল। গতকাল ঈদের কোনও জামাতেই ৫০ জনের বেশি অংশ নিতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশে ঈদ বড় বালাই। না হলে অতিমারিকালে এভাবে পশুর হাট বসে? এত যে স্বাস্থ্যবিধির আহ্বান, কোথায় গেলো সব? উৎসবে কোটি কোটি ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে করোনার কথা যেন ভুলে গেছে সবাই, যদিও টেলিভিশনের পর্দায় নিয়ম করে ২৪ ঘণ্টার মৃত্যু আর সংক্রমণের সংখ্যা প্রচার করা হয়। সবাই মিলে উৎসব করতে করোনাকে চুপ করে দিয়ে গরু খাওয়ার নানা রেসিপি নিয়ে মত্ত আছি। এই উৎসব আসলে করোনারই উৎসব। এই ভাইরাস তার সফল সময় পার করছে আমাদের উন্মাদনায়।

ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা। যেতেই হবে। যেন প্রতিজ্ঞা করেছি আমরা - প্রিয়জনকে করোনা আক্রান্ত করতেই হবে অথবা তাদের কাছ থেকে রোগ নিয়ে এই শহরে আবার ফিরতে হবে। রাস্তাঘাটের যানজটে, সড়কে গাড়ির দীর্ঘ মিছিলে, ফেরিঘাটে জনতার ভিড়ে করোনার কোনও অস্তিত্বই যেন নেই। স্যানিটাইজারের কথা কেউ মনেই রাখেনি। মাস্ক-তো থুতনির ওপর উঠলোই না। অথচ দেড় বছরের বেশি সময় ধরে করোনার জুজু দেখিয়ে বন্ধ রাখলাম সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

স্বাভাবিক মেলামেশাতেও বাধা করোনা। কিন্তু এমন আতঙ্ক গো-হারা হেরে যায় ঈদ উৎসবের কাছে, ‘নাদুস-নুদুস’ গরু ছাগল কেনার আনন্দের কাছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ায় যেভাবে কোরবানির ঈদ হয়, আমরা তা করতে উদ্যোগী হলাম না। একটা অস্বাস্থ্যকর পশুর হাটের ট্র্যাডিশন চলছে সুদীর্ঘকাল ধরে এবং এই করোনাকালেও আমরা সেটা বন্ধ করতে পারলাম না।

বিশ্বায়ন দেখা আমাদের প্রজন্ম দেখছে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও কীভাবে গোড়ামির তাসে ভর করে একটা সমাজ চলতে পারে। ধর্মের অধার্মিক চেহারা অনেক সময়ই দেখি। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বা ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া যে সুশৃঙ্খলভাবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনাকালটা পার করছে, আমরা সেটাও পারলাম না।

পরিস্থিতি ভয়ংকর। দেড় বছরের বেশি সময়েও মানুষকে কেন মাস্ক পরানো গেলো না, সেই আলোচনাটা জরুরি। আমাদের ব্যবস্থাপনায় কোথায় ত্রুটি ছিল সেটা খুঁজে দেখা দরকার। বিজ্ঞান চেতনাকেও ফিকে করার চেষ্টা হয়েছে করোনার মতো ভয়ংকর সংক্রামক রোগ নিয়ে। ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী’- এ বক্তব্য আর ‘মুসলমানের করোনা হয় না’– এমন বক্তব্যের মধ্যে আচরণগত দিক থেকে কোনও প্রভেদ থাকে না।   

ধর্মান্ধতা, দলান্ধতা, ব্যক্তির প্রতি অন্ধ মোহ সিস্টেমকে বিজ্ঞান থেকে দূরে নিয়ে যায়। কখনও অর্ধসত্য, কখনও নির্জলা মিথ্যা – প্রায় এমন এক সিস্টেমে করোনা যুদ্ধে লড়ছি আমরা। ভারতে সম্প্রতি যে ভয়ংকর অবস্থা হয়েছিল তার পেছনে ছিল কুম্ভমেলা এবং নির্বাচনে লাগামছাড়া প্রচার। আমরাও হয়তো সে পথেই হাঁটছি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের পর ভয়ংকর হবে পরিস্থিতি, কারণ সুপারস্প্রেডিং সব ফ্যাক্টরই সক্রিয় রেখেছি সবখানে। ঈদের পর ২৩ তারিখ থেকে ‘কঠোর’ লকডাউন আসছে। কিন্তু এখন যে কোমলতা চলছে, তার পরিণাম কী হবে আমরা জানি না। তবু বলবো, দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, মানুষেরও। সরকার তার কাজ করবে, এবং নাগরিক নিজের, অর্থাৎ করোনার বিরুদ্ধে নিজেকে সজাগ রাখবে। এমন একটা দ্বিমুখী লড়াইয়েই জয় আনতে পারবো। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ওসির বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে কাজের অভিযোগ
ওসির বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে কাজের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ