X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুদের বিকাশে অন্তরায়: লকডাউন নাকি পারিবারিক উদাসীনতা?

মাসুমা সিদ্দিকা
১৪ আগস্ট ২০২১, ১৬:০৯আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২১, ১৬:০৯

মাসুমা সিদ্দিকা মা-বাবার মুখে হাসি ফুটিয়ে আনন্দের বন্যা নিয়ে সন্তানেরা আসে পৃথিবীতে। ছোট্ট নিষ্পাপ শিশু তখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, মা-বাবাও তখন তাদের সর্ব জ্ঞান, সামর্থ্য দিয়ে তাদের সন্তানকে বড় করতে থাকেন। সন্তানের বেড়ে ওঠা, তাদের পড়াশোনা, পারিপার্শ্বিক আচরণ সবকিছুতেই মুখ্য ভূমিকা রাখেন তাদের মা-বাবারা। মা-বাবার এত বিশাল দায়িত্ব আর কেউ কখনই পালন করতে পারে না। হোক না সেটা স্কুল, কলেজ বা অন্য কোনও সংগঠন। বর্তমান করোনাকালে অনেক অভিভাবকই স্কুল খুলে দেওয়ার স্বপক্ষে তীব্র মতামত প্রকাশ করে আসছেন। তারা সব সময় বলে আসছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাচ্চাদের মানসিক বিকাশ, পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর এই জন্য তারা দায়ী করে যাচ্ছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাকে। সন্তানের আচরণ, শারীরিক-মানসিক বিকাশে মুখ্য এবং প্রাথমিক দায়িত্ব যেহেতু পিতা-মাতার; তাই তাদের অবহেলা-অযত্নকে আমলে না এনে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাকেই কেন দায়ী করছেন তা আমার বোধগম্য নয়। অনেক পিতা-মাতাই বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন। বলছেন তাদের বাচ্চারা ডিভাইস আসক্ত হয়ে পড়ছে আর সেজন্য তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে যাচ্ছেন। এই কথাটা আংশিকভাবে সত্য হলেও পুরোপুরি মেনে নিতে পারা যায় না।

বর্তমানে বাচ্চাদের লেখাপড়া করানোর বিকল্প কোনও পথ খোলা না থাকায় অনলাইনে ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষকরা। আর সন্তানেরা ডিজিটাল ডিভাইস হাতে পেয়ে পড়াশোনা করবে নাকি তার অপব্যবহার করবে এটি দেখার দায়িত্ব পুরোপুরিই তাদের অভিভাবকদের ওপরেই বর্তায়।

শিক্ষকরা তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়েই ছেলেমেয়েদের শিক্ষা প্রদান করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর আমরা অভিভাবকরা যদি বাসায় থেকে বাচ্চাদের এতটুকু গাইড করতে না পারি,তাদের দায়িত্ব নিতে না পারি যে বাচ্চারা পড়াশোনা করছে নাকি অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত আছে তবে তো আমরা অভিভাবক হিসেবেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমাদের নিজেদের যোগ্যতা নেই বাচ্চাদের ঠিকমতো লালন-পালন করা, তাদের ঠিকমত সময় দেওয়া আর তাদের প্রতি নজর রাখা। আর তাই নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতেই বুঝি আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করে নিজেরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি। 

করোনা মহামারি শুরু হয়েছে পৃথিবীতে দুই বছর হলো। তার আগে তো পৃথিবী স্বাভাবিক অবস্থাতেই ছিল। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, চলাফেরা করা, সকাল অবধি সন্ধ্যা পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের ছুটে চলা, প্রাইভেট কোচিং সবকিছুই তো ঠিকঠাক মতো চলেছে। কিন্তু তখন কি ছেলেমেয়েরা বিপথে যায়নি, তারা কি মোবাইল আসক্ত হয়নি? তাদের প্রচুর অপরাধের কথা আমাদের অজানা নয়। তবে আজ এই অবস্থায় এসে সব দায়িত্ব শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপরেই কেন বর্তাচ্ছি? আমার এই লেখায় আমি স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের কথাই বলছি যারা নিজেদের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা এখনও সঠিকভাবে রপ্ত করতে পারেনি। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ শিক্ষার্থীরা আমার এই লেখার বিষয়বস্তু নয়।

অভিভাবকদের  উদাসীনতা, অযত্ন করোনাকালে বাচ্চাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ এবং বাচ্চাদের বিভিন্ন ডিভাইসের প্রতি আসক্ত করে ফেলেছে। পিতা-মাতারা যদি বাচ্চাদের সঠিক যত্ন নেন, বাচ্চাদের বিভিন্ন বিকাশের সহায়ক কর্মকাণ্ড করেন তবে তো এই করোনাকালেও বাচ্চাদের সুষ্ঠু বিকাশ তেমনভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কথা নয়।

অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদেরকে যদি নিয়মিত সময় দেন, তাদের গল্পের বই পড়ে শোনান, তাদের সাথে খেলাধুলা করেন, তাদের নিয়ে বিনোদনমূলক কাজ করেন, তবে তো এই করোনাকাল বাচ্চাদের জন্য অনেক আনন্দময় হয়ে উঠবে বিরক্তের বদলে। আমরা অভিভাবকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দেব, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে চ্যাট করবো এবং প্রত্যাশা করবো বাচ্চারা বসে বসে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে– তা অযৌক্তিক। পরিবারের সবাই মিলে সৃজনশীল আলোচনা করা যেতে পারে, তাদেরকে নিয়ে ছবি আঁকা, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে তাদের অবসর সময়কে রাঙিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পরিবারই হতে পারে বাচ্চাদের জন্য আনন্দের আশ্রয় যা কিনা সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় একজন বাচ্চার জন্য।

অভিভাবকরা যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, বাচ্চাদের সময় দিতে পারেন না তখনই বোধকরি এই সব অভিযোগ আসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। অভিভাবক হিসেবে ছেলেমেয়েদের যদি সময় দিতে না পারেন তবে তো বাচ্চারা অন্যদিকে ঝুঁকবেই; সে হোক না করোনাকাল কিংবা স্বাভাবিক কাল। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে আমরা অন্যদের দোষারোপ করে ছেলেমেয়েদের আরো বড় বিপদের পথে ঠেলে দিতে পারি না। কেননা বর্তমানে আমরা এক ভয়ঙ্কর ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে চলেছি। এই সময় নিজেদের জীবন রক্ষা করাটাই সৃষ্টিকর্তার এক বিশাল উপহার। এই চরম সময়ে আমার বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর কথা মা হিসেবে কল্পনাতেও আনতে পারি না। ছেলেমেয়েরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ এই ভবিষ্যতকে যদি আমরা সুন্দরভাবে, উজ্জ্বলভাবে দেখতে চাই তবে তো ছেলেমেয়েদের জীবন রক্ষা করাই প্রধান এবং প্রথম দায়িত্ব আমাদের। 

বিগত কয়েক দশক ধরে আমরা আমাদের বাচ্চাদের প্রাইভেট কোচিং নির্ভর করে গড়ে তুলেছি। ছোট্ট একটা বাচ্চাকে যে কিনা নার্সারি কিংবা কেজিতে পড়ে তাকেও আমরা প্রাইভেট কোচিংয়ে পাঠাই। আর প্রাইভেট কোচিং বাচ্চাদের ওপর যে কী ভয়ংকর চাপের সৃষ্টি করে সেটা বোধ করি কারোরই অজানা নয়। আরেকটু ওপরের ক্লাসে উঠলে তো টিউশন দেওয়া যেন বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমানে করোনাকাল হওয়ায় বাচ্চারা এই ভয়ঙ্কর রীতি থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পেয়েছে। তাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি প্রাইভেট- কোচিং- স্কুল করে কাটাতে হয় না। তারা নিজেদের মতো করে নিজেদের চেনার সময় পেয়েছে, নিজেদের পছন্দমতো কাজ করতে পারছে যা তারা আগে প্রাইভেট কোচিংয়ের চাপে করে উঠতে পারত না। এছাড়া অনেক ছেলেমেয়েরাই বাইরে গিয়ে কোচিং প্রাইভেট পড়তে না পারায় তারা টিউশন নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদেরকে নিজেরাই স্বাবলম্বী করে তুলছে, নিজেরা নিজেদের পড়াশোনা প্রস্তুত করছে। ইঁদুর দৌড়ে জড়িত অভিভাবকরা আমাদের শিশুদেরকে যতটা কোচিং নির্ভর প্রতিবন্ধীর মতো বড় করছি তার থেকে আমাদের শিশুরা অনেক বেশি মেধাবী ও সৃজনশীল বলেই আমি মনে করি।

সেই সাথে প্রতিটি বাচ্চার জন্য তাদের বাড়ি হোক গঠনমূলক আলোচনার কেন্দ্র। যেখানে তারা একইসাথে বিনোদন-আনন্দ, খেলাধুলা আর শিক্ষা সবকিছুই করতে পারবে। আর সেজন্য আমরা অভিভাবকরাই পারি বাচ্চাদের এই সময়টাকে আনন্দময়ী শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে। আসুন না একটু চেষ্টা করেই দেখি কীভাবে বাচ্চাদের এই সময়টাকে আমরা আনন্দময় করে এই বর্তমান ক্রান্তিকাল কাটিয়ে উঠতে পারি। তাহলে আমরাও নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে নিজেদেরকে একজন আদর্শ অভিভাবক হিসেবে দাবি করতে পারব।

লেখক: রন্ধন শিল্পী

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ