X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা ও বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বার্তা

মো. জাকির হোসেন
০২ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৫৩আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২১, ১৯:০৭

মো. জাকির হোসেন বাংলাদেশে আশ্রিত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ গত ২৯ সেপ্টেম্বর বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এশার নামাজ শেষ করে মুহিবুল্লাহ তার নিজের প্রতিষ্ঠিত আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর অফিসে অবস্থান করছিলেন। অফিসের ভেতরে ঢুকে বন্দুকধারীরা তাকে ৫ রাউন্ড গুলি করে। তিন রাউন্ড গুলি তার বুকে লাগে। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ১৯৯২ সালে রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।

রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর মুহিবুল্লাহ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আসেন। এরপর থেকেই তিনি কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। তবে মাঝেমধ্যেই তিনি মিয়ানমারে গিয়েও অবস্থান করতেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে মংডু টাউনশিপের সিকদারপাড়া গ্রাম থেকে তিনি দ্বিতীয় বার বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০০ সালের শুরুতে ১৫ জন সদস্য নিয়ে মুহিবুল্লাহ গড়ে তোলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ (এআরএসপিএইচ) নামের সংগঠন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেশ কিছু সংগঠন কাজ করলেও মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে পরিচালিত এআরএসপিএইচ সংগঠনটি বেশ শক্তিশালী। রাখাইন রাজ্যে থাকতে মুহিবুল্লাহ স্কুলে রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। এজন্য তিনি মাস্টার মুহিবুল্লাহ নামেও পরিচিত। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে বেশ সক্রিয় ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। মাস্টার মুহিবুল্লাহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে রোহিঙ্গাদের অধিকার ও স্বার্থ নিয়ে কথা বলতেন। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা হলেও মুহিবুল্লাহ বিচরণ করেছেন অনেক দেশে। সাক্ষাৎ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে। জাতিসংঘ মহাসচিবসহ যত বিদেশি প্রতিনিধি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছেন তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে মুহিবুল্লাহ'র সাক্ষাৎ হয়েছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে একাধিকবার সফর করেছেন।

২০১৯ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ১৭ দেশের যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২৭ প্রতিনিধি সাক্ষাৎ করেন সেখানেও যোগ দেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের এ সফর দেশজুড়ে আলোচনায় আসলে মুহিবুল্লাহ বেশ পরিচিতি লাভ করেন এবং রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত হন। তবে তার মূল উত্থান হয় ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ঢলের ২য় বর্ষপূর্তিতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে সমাবেশের আয়োজনের মাধ্যমে। ওই দিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার প্রস্তুতিতে তিনি কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সমাবেশ ঘটিয়ে আলোচনার তুঙ্গে চলে আসেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ সরকারসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে আসছিলেন মাস্টার মুহিবুল্লাহ।

আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে রোহিঙ্গা গণহত্যার তথ্য সরবরাহে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের তথ্য সংগ্রহ ও অনুসন্ধানে জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী মিশনের তদন্তেও নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। তার প্রচেষ্টায় মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বকে জবাবদিহির আওতায় আনার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সমর্থন মিলেছিল। এইসব কারণেই রোহিঙ্গাদের কাছে তার তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল। সম্প্রতি মুহিবুল্লাহ প্রচার করছিলেন যে, মিয়ানমারে জাতীয় ঐক্যমতের সরকার (ইউএনজি) ক্ষমতাসীন হলে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। কথিত আছে, সে লক্ষ্যে ইউএনজি সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তিও করেন মুহিবুল্লাহ। এ ছাড়াও সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নাগরিকত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানালে বাংলাদেশের পাশাপাশি এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন এআরএসপিএইচ। রোহিঙ্গারা নিজ ভূমে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছিলো মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন রোহিঙ্গাদের সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’। 

রোহিঙ্গাদরদী মুহিবুল্লাহর হত্যা বাংলাদেশের জন্য যে কারণে উদ্বেগের, তা হলো–

এক. হত্যাকাণ্ডের সময় মুহিবুল্লাহর সঙ্গে এআরএসপিএইচ এর অফিসে অবস্থানকারী প্রত্যক্ষদর্শী মুহিবুল্লাহর ভাই হাবিবুল্লাহর দাবি, ‘তার ভাই মুহিবুল্লাহকে হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নেতা নামে পরিচিত মাস্টার আব্দুর রহিম, মুর্শিদ, লালুসহ ২০ থেকে ২৫ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ।’

তিনি আরও দাবি করেন, ‘তাদের (ঘাতকদের) কয়েকজন আরসার ‘ছায়া সংগঠন’ ‘আল-ইয়াকিন’ এর সদস্য’। তবে উখিয়া থানায় মুহিবুল্লাহর ভাই হাবিব উল্লাহর দায়ের করা মামলায় কোনও আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। রোহিঙ্গা শিবিরে ‘আরসার’ উপস্থিতি দাবি করা হলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলো তা বরাবরই নাকচ করে আসছে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি আগে ইংরেজিতে ‘ফেইথ মুভমেন্ট’ নামে তাদের তৎপরতা চালাতো। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিল ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ নামে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ তাদের এক রিপোর্টে বলছে, সংগঠনটি মূলত গড়ে উঠেছে সৌদি আরবে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের দ্বারা। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করেছে। মিয়ানমার বলছে, এই গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছে রোহিঙ্গা জিহাদীরা, যারা বিদেশে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের ধারণা, এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছে ‘আতাউল্লাহ’ নামে একজন রোহিঙ্গা। তার জন্ম করাচিতে, বেড়ে উঠেছে সৌদি আরবে। অন্যদিকে আরসা একেবারে খোলাখুলিই জানিয়েছে তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে এবং তাদের ‘আত্মরক্ষামূলক’ হামলার মূল টার্গেট হচ্ছে মিয়ানমারের ‘নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠী’। আরসার প্রধান দাবি হচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব এবং সমান মর্যাদা দিতে হবে। ‘আরসা’ আরও বলেছে, তারা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত নয়। তাদের অধিকার আদায়ের জন্যও তারা সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসীও নয়। বিশ্বের কোনও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। এমনকি তারা রাখাইনের বিভিন্ন ধর্মের ও জাতির মানুষকে এবং তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দিচ্ছে।

এদিকে কক্সবাজারের মূর্তিমান আতঙ্ক ‘আল-ইয়াকিন’। রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় বাংলাদেশিদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেছে এ বাহিনীর সদস্যরা। কক্সবাজার ও টেকনাফের প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন আল-ইয়াকিনের সদস্যরা। মিয়ানমারের পাশাপশি বাংলাদেশেও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে ‘আল-ইয়াকিন’। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক বিক্রি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহসহ নানা অপরাধে জড়িত এই বাহিনী। টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মোহাম্মদ ওমর ফারুককে হত্যা করেছে ‘আল-ইয়াকিন’। ইউটিউবে তাদের বেশ কয়েকজন নেতা নিয়মিত ভিডিও প্রচার করেন। ইউটিউবে প্রকাশিত এক ভিডিওতে আল-ইয়াকিনের নেতারা দাবি করেন, ‘চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার আরাকানের অংশ। তারা এতদিন মিয়ানমারের রাখাইনে ছিলেন। এখন তাদের আরেক রাজ্য কক্সবাজারে এসেছেন। তারা এখানেই থাকবেন।’ রোহিঙ্গাদের দাবি আদায়ের কথা বললেও ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত আল-ইয়াকিনের সন্ত্রাসীরা। চলতি বছরের মার্চে উখিয়ার বালুখালি ক্যাম্পে ভয়াবহ যে আগুনের ঘটনা ঘটে তা ছিল আল-ইয়াকিনের কাজ। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তারা আগুন দিয়ে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। প্রতিনিয়ত তাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী। আল-ইয়াকিন সদস্যদের ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়া বেশ কয়েকজন নারী গর্ভপাত করাতে ক্যাম্পের আশপাশের পল্লি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন। স্থানীয় অধিবাসীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মুক্তিপণ দিতে না পারলে নির্জন পাহাড়ে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

২০২০ সালের এপ্রিলে টেকনাফের জীমংখালি থেকে এক দিনমজুর ও দুই কৃষককে তুলে নিয়ে যায় আল-ইয়াকিনের সশস্ত্র সদস্যরা। তারা তাদের পরিবারের কাছে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। জনপ্রতি তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে দু’জন কৃষক ফিরে আসেন। তবে দিনমজুরের পরিবার টাকা দিতে না পারায় তাকে হত্যা করা হয়। পরে তার মাটিচাপা মরদেহ মেলে জীমংখালির পাহাড়ে। কেউ এই বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস দেখায় না। প্রতিবাদ করলে নিশ্চিত মৃত্যু। একবার একজনের শরীর ও মাথা পাহাড়ের দুই স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়। আল-ইয়াকিনের অস্ত্র ভাণ্ডারে রয়েছে, এসবিবিএল (একনলা বন্দুক), নাইন এমএম পিস্তল, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ওয়ান শুটারগান, এমনকি একে-৪৭ এর মতো আগ্নেয়াস্ত্র। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবাধ যাতায়াত ও সেখানে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তোলা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বড়ই উদ্বেগের।

দুই. অনেক বিশ্লেষক বলছেন, দেশি-বিদেশি যারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন থামিয়ে দিতে চায় মুহিবুল্লাহ হত্যায় তাদের ইন্ধন থাকতে পারে। বিশেষ করে যেসব দেশ ভূ-রাজনীতি বা ভূ-কৌশলের কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে রয়েছে সেসব দেশও মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কলকাঠি নাড়তে পারে। তবে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের জড়িত থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে খুবই সোচ্চার ছিলেন মুহিবুল্লাহ। নানামুখী প্রচেষ্টাও চালাচ্ছিলেন প্রত্যাবাসনের লক্ষে। মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ঐক্য মতের সরকার (ইউএনজি) এর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সচেষ্ট ছিলেন মুহিবুল্লাহ। লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার মধ্যে মুহিবুল্লাহর মতো এমন বিচক্ষণ নেতা আর দ্বিতীয়টি নেই। এজন্য তিনি মিয়ানমারের সামরিকজান্তা সরকারের টার্গেট ছিলেন।  

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেওয়ার কারণে মিয়ানমার সরকারের পূর্ব পরিকল্পনায় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। আল-ইয়াকিন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ঘোর বিরোধী। তাদের নেতারা কখনও মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না। কারণ মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর হামলার কারণে সেনাবাহিনী তাদের খুঁজছে। এজন্য তারা চায় না যে, রোহিঙ্গারা কখনও তাদের দেশে ফিরে যাক। তাদের কথা হলো: তাদেরকেও যেতে দেব না, আমরাও যাবো না। সেকারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে যেসব সংগঠন কাজ করছে সেগুলোর সঙ্গে তাদের বিরোধ রয়েছে এবং এজন্য তাদের নেতাদেরও টার্গেট করা হয়। বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের ও বিদেশি সশস্ত্র সংগঠনের এমন অপতৎপরতা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের।

তিন. মুহিবুল্লাহ ক্রমাগতভাবে রোহিঙ্গাদের একক নেতৃত্ব হয়ে ওঠেছিলেন। তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বৈঠক করেছেন। বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। জাতিসংঘ মহাসচিবসহ যত বিদেশি প্রতিনিধি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছেন তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে মুহিবুল্লাহ ও তার সঙ্গীরা সাক্ষাৎ করেছেন। তার জনপ্রিয়তার কারণে অন্যান্য যেসব রোহিঙ্গারা নেতৃত্ব দিয়ে সামনে আসতে পারছে না তাদের একটি গ্রুপ এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটাতে পারে।

চার. রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মোট ২০টি সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তাদের মধ্যে আছে মুন্না গ্রুপ, আনাস গ্রুপ, মাহাদ গ্রুপ, সালমান শাহ গ্রুপ, হাফেজ আহমদ গ্রুপ, সাদ্দাম গ্রুপ, হাকিম ডাকাত গ্রুপ, সেলিম গ্রুপ, রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, জাকির বাহিনী, নুরে আলম বাহিনী, নবী হোসেন বাহিনী ইত্যাদি।

এসব বাহিনীর কয়েকশ করে সদস্য, স্থানীয় লোকজনের কাছে যারা ডাকাত হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার সরকার। এজন্য তারা বিপথগামী রোহিঙ্গাদের দিয়ে ক্যাম্পে দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশ্ব দরবারে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসাবে তুলে ধরে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলাটি প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের লক্ষ্য।

রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসাবে তুলে ধরতে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের নীল নকশা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। মুহিবুল্লার সঙ্গে ২০ থেকে ২৫ জন নিরাপত্তাকর্মী (বডিগার্ড) থাকত। কিন্তু সেদিন মুহিবুল্লাহকে হত্যার সময় নিরাপত্তাকর্মীদের তেমন কেউ ছিলেন না। দু’য়েকজন থাকলেও তাঁরা পালিয়ে গেছেন, অস্ত্রধারীদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেননি। এ কারণে অনেকে মনে করেন এটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমার সরকারের পুতুল সন্ত্রাসী গ্রুপের পদচারণা আরও ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো স্থানীয় অধিবাসীদের বিরুদ্ধে হত্যা-অপহরণসহ যে অপরাধমূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে তাতে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে যে কোনও সময় স্থানীয় অধিবাসীদের পূঞ্জীভূত ক্ষোভের ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণও ঘটতে পারে।

পাঁচ. রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড হলে একটি কমন বক্তব্য দেওয়া হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কেউ যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাস্তবতা হলো, উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকেই মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা।

তার মানে, আমাদের জোরদার করা নিরাপত্তার চেয়েও সন্ত্রাসীরা শক্তিশালী কিংবা আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার কৌশল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা পুরোদমে রপ্ত করে ফেলেছে। আগে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় বাংলাদেশের চারটি বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়া যেত। এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ইয়াবা ও অস্ত্র চোরাচালান এবং মানব পাচারকারীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতো। এমনকি মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরাও বাংলাদেশি মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করতো। ফলে বিজিবি চোরাচালান বা পাচার বিরোধী কোনও অভিযান চালাতে গেলে তা বাংলাদেশ থেকেই ফাঁস হয়ে যেতো। ২০১৯ সালের আগস্টের পর মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিকম প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস (এমপিটি) সীমান্তে অন্তত ১২টি টাওয়ার বসিয়েছে।

সীমান্তের এত কাছে এমপিটির টাওয়ারগুলো আগে ছিল না। ফলে মংডু সীমান্তসহ আশপাশের প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় এমপিটির সিম ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থান করা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাজার ধরতে এমপিটি কম দামে সিম কার্ড এবং আকর্ষণীয় মিনিট ও ইন্টারনেটের অফার দিচ্ছে। ক্যাম্পের অনেক রোহিঙ্গাই এই সিম ও ডাটা ব্যবহার করছে। এমপিটির রিচার্জ কার্ড, মিনিট কার্ড সবই পাওয়া যায় ক্যাম্পে। ফলে ক্যাম্পের যেকোনও ঘটনা সাথে সাথে জেনে যায় মিয়ানমার। রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার জন্য এটি বড়ই উদ্বেগের।

রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন মুহিবুল্লাহ। রোহিঙ্গাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে রোহিঙ্গা দরদী মুহিবুল্লাহ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। রোহিঙ্গাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করা ও তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি ছিলেন সাহসী, দরদী, বিচক্ষণ ও দৃঢ়চেতা এক নেতা।

রোহিঙ্গারা মুহিবুল্লাহর মতো নেতা আর হয়তো পাবে না। মুহিবুল্লাহ হত্যা রোহিঙ্গাদের জন্য যেমন হতাশার, তেমনি বাংলাদেশের জন্যও বেশ উদ্বেগজনক বার্তা। হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করা জরুরি। হত্যার প্রকৃত কারণ ও নেপথ্যে কারা তা উদঘাটনও অতি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো ও পুনর্বিন্যাস অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সেই সাথে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তথ্যপাচার রোধেও ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ