X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাবিরার আত্মহত্যা বনাম সামাজিক দৈন্য

ফারজানা হুসাইন
২৬ মে ২০১৬, ১৪:৩৮আপডেট : ২৬ মে ২০১৬, ১৫:৪৩

ফারজানা হুসাইন সাবিরা হোসেন নামের এক তরুণী মডেলের আত্মহত্যার ঘটনায় গত কয়েকদিন আলোচনায় ভরপুর অনলাইন গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এছাড়া আলোচনা চলছে- বন্ধুদের আড্ডায়, পারিবারের খাবার টেবিলে। আত্মহত্যা করার আগে মেয়েটির ফেসবুকে আপলোড করা একটা ভিডিও থেকে জানা যায়, প্রেমিকের সঙ্গে অভিমান, প্রেমিকের পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া গ্লানি, কটূ কথা আর শেষমেশ শারীরিক সম্পর্কের পর প্রেমিক তাকে বিয়ে করতে না চাওয়ায় এই আত্মহত্যা।
মৃত্যুর পর কেউ কেউ মেয়েটাকে দোষারোপ করছে তার বেপরোয়া জীবনযাপনের জন্য, বিয়ের আগে প্রেমিকের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের জন্য। কেউ আবার আঙুল তুলেছে মেয়েটার ব্রোকেন ফ্যামিলির প্রতি, মিডিয়াতে তার কাজের প্রতি। আত্মহত্যা কতখানি ভীতু কাপুরুষের কাজ, জীবন আর বাস্তবতা থেকে পালানোর চেষ্টা, এ নিয়ে চায়ের কাপে আর সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় চলছেই।
একুশ-বাইশ বছরের লিকলিকে গড়নের মেয়েটা কতখানি অভিমান আর হতাশা নিয়ে নিজের শরীরে ছুরি বসিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় আর সেই ভিডিও নিজে ফেসবুকে আপলোড করে- একবার কি ভেবে দেখেছি আমরা? না, শরীরে ছুরি বসাতে সক্ষম হয়নি, ভীতু মেয়েটা। কিন্তু ভিডিওতে দেওয়া কথা সে রেখেছে। পরের প্রচেষ্টায় ঝুলে পড়েছে নিজের ওড়না গলায় পেঁচিয়ে।

আরও পড়তে পারেন: জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ড: উন্নত প্রযুক্তিতে যোগাযোগ রাখতো খুনিরা
পৃথিবীতে এত মানুষ, অথচ মেয়েটা চলে গেল একটা মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা না পেয়ে, এক বুক কষ্ট নিয়ে। ও জেনে গেল, এই পৃথিবী নিষ্ঠুর, তার চেয়েও নিষ্ঠুর মানুষগুলো। বাচ্চা একটা মেয়ে- যার সামনের দিনগুলোতে হয়তো ছিল অফুরান সম্ভাবনা, কোনও প্রেমিক পুরুষের নিখাদ ভালোবাসা, ঘর-সংসার-সন্তান; অথচ জীবনের কিছু না দেখে, কিছুই না পেয়ে ভয়ঙ্কর হতাশ হয়ে এত তাড়াতাড়ি জীবনকে বিদায় বলে দিলো বোকা মেয়েটা। আর আমরা সামান্য মমতাবোধটুকু দেখাতে পারছি না তার জন্য।
আত্মহত্যা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় দিক থেকে আত্মহননকে কখনও রাষ্ট্র বা রাজার প্রতি করা অপরাধ বিবেচনা করা হতো, কখনও মহাপাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীন গ্রিসে, রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া কোনও ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে তাকে স্বাভাবিক নিয়মে শেষকৃত্যের অধিকার দেওয়া হতো না, শহরের বাইরে কোনও এক নিভৃত জায়গায় সবার অগোচরে মৃত ব্যক্তিকে মাটিচাপা দেওয়া হতো। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই ছিলেন আরও কঠোর। ১৬৭০ সালে তিনি ফ্রান্সে যে ক্রিমিনাল অর্ডিন্যান্স পাস করেন, সেখানে আত্মহননকারী ব্যক্তির মৃতদেহ রাস্তায় জনসমক্ষে টেনে হিঁচড়ে নেওয়া হতো, তারপর ছুড়ে ফেলা হতো জঞ্জালের স্তুপে। আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির সমস্ত সম্পত্তিও রাষ্ট্র কব্জা করে নিত। এতটা নিষ্ঠুর না হলেও, এখনও পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রীয় আইন আত্মহত্যাকে অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে।

ব্যক্তিগত বিষাদ আর মানসিক কষ্ট সহ্য করতে না পেরে করা আত্মহত্যাকে কখনওই হয়তো সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত নই আমরা। বিষন্নতা, অবসাদের মতো মানসিক ব্যাধিকে ভ্রুকুটি করি আমরা। কোথাও কেউ নেই এই অসহায় মানুষগুলোর কথা শোনার জন্য। প্রেমিকের প্রতারণায় যে মেয়েকে আত্মহত্যা করতে হয়, সমাজ তাকে অসতীর কলঙ্ক চাপাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত নয়। অথচ আমরা তো সেই সমাজ, যেখানে স্বামীর সঙ্গে একই চিতায় সহমরণে সতীত্বের বাহবা পায় স্ত্রী। প্রায় ৭০০ বছর আগে ‘সতী’ নামক আত্মহননের এই প্রথার জন্ম আর কোথাও নয়, মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের রাজস্থানে। রাজপূত পুরুষেরা যুদ্ধে পরাজিত হলে বিজিত বাহিনীর হাতে নারীদের বন্দী হওয়াকে মনে করা হতো অসম্মানের। আর তাই সতীত্ব রক্ষার নামে শত্রুবাহিনীর হাতে বন্দীত্ব থেকে রেহাই পেতেই রাজপূত রমণীরা তখন আত্মহত্যা করতো। তখনকার সমাজ স্বামীর প্রতি অনুগত নারীর এ আত্মহননকে মর্যাদার চোখে দেখতো। ধীরে ধীরে এই আত্মহননের প্রথা স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যুতেও পালন করা হতে থাকে। রাজপ্রথা থেকে একসময় এই রীতি সমাজের সর্বস্তরের নারীর জন্যই প্রযোজ্য হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে স্বামীর বিরহে স্ত্রীর স্বেচ্ছামৃত্যু হয়ে যায় সামাজিক প্রথা। জোর করে সব বিধবাকেই মৃত স্বামীর সঙ্গে চিতায় জ্বালানো শুরু হয়।

জীবন্ত জ্বালানোর এই প্রথাকে সতী নামে মহিমান্বিত করার ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় খনার বচনেও-

পুড়লো কন্যা, উড়লো ছাই

তবেই কন্যার গুণ গাই।

ইংরেজ শাসনামলে শেষে আইন করে এই সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে হয়।

আরও পড়তে পারেন: বিতর্কিত ব্রিটিশ এমপির বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা

পুরুষের প্রয়াণে নারীর আত্মহনন যে সমাজে নারীকে সতীর মর্যাদা দেয়, বিয়ের আগের শারীরিক সম্পর্ক সমাজের চোখে সতীত্ব খুইয়ে প্রেমিক পুরুষের প্রতারণায় আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া সে নারী সমাজের চোখে অসতী আর কলঙ্কিনী চিহ্নিত হবে- সে আর নতুন কী? পুরুষের প্রয়োজনে, পতিপরায়ণা নারীর আত্মহনন গৌরবমণ্ডিত হয়, পুরুষের প্রতি ঘৃণা আর অভিমান নিয়ে যে নারী আত্মহত্যা করে তার প্রতি আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজ কৃপাটুকুও দেখায় না। সাবিরার মতো ‘অসতী’ নারীরা এক বুক হতাশা নিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে পা বাড়ায়, আর সাবিরাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের পর বিয়েতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বীরদর্পে আমাদের সমাজে ঘুরে বেড়ায় ‘সৎ’ প্রেমিকেরা।

লেখক: আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ