X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিজ মেট্রোতে পরবাসী

গর্গ চট্টোপাধ্যায়
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১২:৩৯আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১২:৪৬

গর্গ চট্টোপাধ্যায় আমি থাকি কলকাতার দক্ষিণে, সুবিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরের কাছে, আদি গঙ্গার পাশে, পুরানো পাড়া চেতলায়। আমার কর্মস্থল কলকাতা শহর পেরিয়ে, আরও উত্তরে বরানগরে। তাই যেতে হয় প্রথমে পায়ে হেঁটে চেতলা ব্রিজ অবধি, সেখান থেকে অটো করে রাসবিহারী মোড়, তারপর মেট্রো করে শ্যামবাজার এবং সবশেষে বাস বা কদাচিৎ ট্যাক্সি করে বরানগর। এর মধ্যে একমাত্র মেট্রোরেলের অংশটি বাংলার মানুষের বা সরকারের হাতে নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। সেটা ঢুকলেই বোঝা যায়। হঠাৎ করে দেখতে পাওয়া যায় হিন্দি হরফের প্রাচুর্য, সবকিছুতেই। বাংলা সেখানে ম্রিয়মান। মেট্রোতে উঠতে আমাকে আমার ব্যাগ জমা দিতে হয় একটি স্ক্যানিং মেশিনে। সেখানে বসে থাকেন খাকি পোশাকের রেল পুলিশ। তারা আমার এই বাংলার দেশে আমাকে হিন্দিতে নানারকম নির্দেশ দেয়।
একইভাবে এই মেট্রোরেলের টিকিট কাউন্টারে প্রায়শই থাকে এমন মানুষ যারা বহিরাগত। তারা এই বাংলার মাটিতে আমার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলেন। বাইরে থেকে কোথাও চাকরি করতে আসলে এলাকার ভাষা শিখে নেওয়াই দস্তুর। আমি যখন বিদেশে ছিলাম, সেখানকার লোকেদের সঙ্গে বাংলাতে কথা বলতাম না। বলতাম ইংরেজিতে। কারণ সেটা ইংরেজিভাষীদের দেশ। ভারত সংঘের মতো বহুজাতিক বহুভাষিক রাষ্ট্রে যখন একটি ভাষার মানুষে সকল জায়গায় আশা করে যে বাকি মানুষদের তাদের ভাষা বুঝতে হবে, আমার মনে পড়ে যায় ১৯৭১-এর আগের পূর্ব বাংলার কথা। সেখানেও কেন্দ্র থেকে পাঠানো মানুষের এই আত্মম্ভরিতা ছিল। সেখানেও রাষ্ট্র মনে করতে যে পরিষেবার দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র মানুষের ভাষায় কথা বলবে না, মানুষকে বদলে গিয়ে কথা বলতে হবে রাষ্ট্রের ভাষায়। অথচ এই ভারত সংঘরাষ্ট্রে তো কোন রাষ্ট্রভাষা নেই। তবে কোনও অধিকারে পশ্চিম বাংলার মাটিতে এই ক্ষমতা পায় হিন্দি? একি আমাদেরই শিরদাঁড়া বেঁকে যাওয়ার ফল। নাকি ক্ষমতার কেন্দ্রীয়ভূত করে বিশ্বাসী ভারতীয় সংঘরাষ্ট্রের এটা ষড়যন্ত্র - তথাকথিত সংহতি ও ঐক্যের ধুয়ো তুলে হিন্দি ছাড়া বাকি সকল ভাষাভাষীর আত্মপরিচয়কে গৌণ হিসেবে দেখা এবং ক্রমে গণপরিসর থেকে বিলীন করে দেওয়া?

এই সামান্য মেট্রোরেল। অথচ তা কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পত্তি হওয়াতে তার ছত্রে ছত্রে হিন্দি, ছত্রে ছত্রে বাঙালিকে বাংলার মাটিতেই গৌণ করার একটা ছাপ। এই যে টিকিট কাউন্টার- স্টেশন প্ল্যাটফর্মে রেল পুলিশ হিসেবে দিল্লির সদর দফতর থেকে নিয়োগ পাওয়া একজন যিনি বাংলা জানেন না, তাই আমাকে হিন্দিতেই যা বলার বলছেন, আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো বহিরাগতের ভাষা শুনছি এবং আমাদের বাংলার মানুষেরা হিন্দি না জানলে নিজের ভাষার এলাকায় শুধু নিজের ভাষা জানার ‘অপরাধে’ ঠিকঠাক পরিষেবা না পেয়ে হয়রান হচ্ছেন, এটি কোনও হিন্দিভাষীর দেশ বা এলাকায় ভাবা যায়? এর উল্টোটা কল্পনা করা যায়? ভাবা যায় যে দিল্লি বা লখনৌ শহরের কোনও ব্যাংকে বা রেল স্টেশনে এক বহিরাগত বাঙালি কর্মচারী এক স্থানীয় হিন্দিভাষীকে বাংলায় যা বলার বলছেন, হিন্দিভাষীর কথা বুঝছেন না, বোঝার বা শেখার চেষ্টাও করছেন না, অথচ চাকরিতে দিনের পর দিন বহাল থাকছেন? এটা সম্ভব না। কোন হিন্দিভাষী এলাকায় গিয়ে সেখানকার ভাষা না শিখে বাইরের ভাষা দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা এক চরম বেয়াদপি। এবং এমন বেয়াদপি করলে স্থানীয় মানুষ উচিত শিক্ষা দেবে। তাই সে বাপ বাপ বলে স্থানীয় ভাষা শিখবে। এমনটাই দস্তুর হওয়ার কথা যে কোনও জায়গায় যদি সকল এলাকায় সেখানকার ভাষার গুরুত্বকে স্বাভাবিক মনে করা হয় এবং রাষ্ট্রের কোন এক বিশেষ ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার এজেন্ডা না থাকে। কিন্তু বাস্তবে ভারতীয় সংঘরাষ্ট্রে হিন্দিভাষী ছাড়া বাকি সকলেই এক অর্থে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
রোজ মেট্রোতে যাই। রোজ স্টেশন আসে, স্টেশন যায়। বিলেতের লন্ডনের মেট্রোতে যা ইংরেজিতে পিকাডিলি স্কয়ার, তা বাংলাতেও পিকাডিলি স্কয়ার। আমার মেট্রোরেল কালিঘাট ছাড়ে। এর পরেই আসে যতীন দাস পার্ক।  সেই ওমর শহীদ যতীন দাস যিনি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ৬৩ দিনের অনশনের পর মৃত্যর কোলে ঢোলে পড়েছিলেন। হাজরার মোড়ে, আশুতোষ কলেজের পাশে তার নামেই যতীন দাস পার্ক।  নিজের ভূগর্ভস্থ মেট্রো স্টেশন যতীন দাস পার্ক সেই পার্কের নাম।

অশরীরী কণ্ঠস্বর মেট্রোরেলের স্পিকারের মাধ্যমে আমাকে জানান দেয় ৩টি ভাষায়। বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি। ‘পরের স্টেশন যতীন দাস পার্ক’। কিন্তু হায়, যখন ইংরেজি বা হিন্দিতে বলা হয়, বিকৃত করে দেওয়া হয় এই মহামানবের নাম। যতীন হয়ে যায় ‘জাতিন’ - হিন্দিতে, ইংরেজিতে।

একজন বাঙালির নামের ইংরেজি বা হিন্দিতে অন্য উচ্চারণ কিভাবে হয়? হয়। যখন সম্পর্ক হয় শাসক ও শাসিতের। ইংরেজরা আমাদের নাম এমন ভাবেই বিকৃত করে উচ্চারণ করতো। এখন হিন্দিরা করে। আমরা মেনে নেই অবলীলায়। ভাঙা মেরুদণ্ডের দেশে অপমানকেও, বিকৃতিকেও মনে হয় স্বাভাবিক। এটাই দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার চিহ্ন। ট্রেন এগিয়ে যায়। আসে নেতাজী ভবন। ভবন হয়ে যায় ‘ভাভান’। তারপর আসে রবীন্দ্র সদন, যা হয়ে যায় ‘রাবীন্দ্রা সাদান’। ময়দান হয় ‘মায়দান’। অথচ ইংরেজের পার্ক স্ট্রিট কিন্তু ৩ ভাষায় অক্ষুণ্ন থাকে একই উচ্চারণে - এককালের শাসকের ভাষা বলে কথা। তাই অ্যাসপ্ল্যানেডও থাকে তিন ভাষাতেই অবিকৃত। তারপর আসে হিন্দি/উর্দু শব্দের নাম স্টেশন চাঁদনী চৌক - সেও ৩ ভাষায় থাকে অভিন্ন। এখনকার দিল্লিশ্বর শাসকদের ভাষা বলে কথা। অবিকৃত থাকে সেন্ট্রাল। তারপর মহাত্মা গান্ধী রোড হয়ে যায় ‘মাহাতমা’ গান্ধী রোড।  গিরীশ পার্ক অবিকৃত থাকে কারণ গিরীশ বাংলা ও হিন্দি দুইতেই চালু আছে আর পার্ক তো সাহেবের পার্ক। তারপর আসে শোভাবাজার, যা হয়ে যায় ‘শোভাবাজআর’। তারপর আসে শ্যামবাজার, হিন্দিতে আর ইংরেজিতে যন্ত্র কণ্ঠ বলে দেয় ‘শেয়ামবাজআর’। লক্ষণীয়, সর্বক্ষেত্রেই ‘ইংরেজি’ উচ্চারণ করা হয় ‘হিন্দি’র অনুরূপ। বাংলা তো বনের জলে ভেসে আসা মাল। যদিও হিন্দিভাষীদের ইংরেজি শিখিয়েছিল এই বাংলার মাস্টাররাই। সে অন্য সময়ের কথা। আমাকে শ্যামবাজারে নেমে যেতে হয়। বিকৃতির প্রকোপ হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। ট্রেন এগিয়ে চলে দমদমের পথে। যন্ত্রকণ্ঠ জানায় "দামদাম"।                                   

সেদিনও মেট্রো করে কর্মস্থলে যাচ্ছি। মেট্রোতে সারাক্ষণ বাজিয়ে গেলো হিন্দি সিনেমার গানের মিউজিক। পশ্চিম বাংলার ৮৫% এর বেশি মানুষ বাংলা-ভাষী। তথ্যপ বলে, দিল্লিতেও প্রায় ১০% মতো মানুষ অহিন্দিভাষী। ওদের মেট্রোতে কখনও হিন্দি বা ইংরেজি ছাড়া কোনও গান বা কোনও বিজ্ঞাপন দেখেছেন? নেই। ইংরেজি-হিন্দি যে শ্রেণির কায়েমি স্বার্থের সোপান, তাদের থেকে এই নিয়ে কোনও হেলদোল আশা করি না। কিন্তু আমরা বাকিরা? বাংলার বুকে মেট্রোতে এইটা চলা নিয়ে আমার আপত্তি ভ্যানিশ হবে যখন দিল্লি মেট্রোতে বাংলা শুনবো-দেখবো। কিন্তু তার আগে, বাংলার দেশে আমরা কি দেওয়ালে পিঠ ঠেকতে ঠেকতে একদম দেওয়ালে মিশে যাবো? দিল্লি তাই চায়। কারণ বাংলার কোমর ভাঙা আর ২০১৯-এ দিল্লিতে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার গড়ার মধ্যে সম্পর্ক পারস্পরিক সহযোগিতা মূলক। মীরজাফররা বাইরের ক্লাইভের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে। আমরা কি করছি পলাশীর পুনরাবৃত্তির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া? রেডিক্যাল ও তাত্ত্বিকদের কথা বাদ দিলাম, তাদের কাছে মোদির বিরোধিতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ আনন্দবাজারের কাছে সাচ্চা রেডিক্যাল হিসেবে গৃহীত হওয়া। কিন্তু মোদি আর আনন্দের বাজারে আমোদিত বাঙালির বাইরে রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বঙ্গবাসী। ওরা আমাদের পৃথিবী বদলে দিতে চায়, কারণ রেডিক্যাল তাত্ত্বিকদের থেকে তারা ফেউয়েরবাকের থিসিসে মার্কসের উক্তিটি আরও সম্যকভাবে বুঝেছে - যে উক্তি বলে, দার্শনিকেরা আজ অবধিজগৎকে বুঝতেই শুধু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আসল কাজটা হলো জগৎকে বদলানো । ওরা যেমন রাজনীতির হিন্দুত্বআয়ন-হিন্দীআয়ন ঘটাচ্ছে, তার প্রতিরোধ হিসেবে বাংলার খুঁজতে হবে নিজস্ব পথ। এটা সময়ের দাবি। দেশের দাবি।

লেখক: স্থিত মস্তিষ্ক-বিজ্ঞানী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিজেএমসির চেয়ারম্যানসহ তিনজনের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করবে দুদক
বিজেএমসির চেয়ারম্যানসহ তিনজনের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করবে দুদক
একনেকে ১১পি প্রকল্প অনুমোদন
একনেকে ১১পি প্রকল্প অনুমোদন
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ