X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজ ও একজন শাওন

বিথী হক
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:১৪আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:১৬

বিথী হক ‘শাওন নামটাতেই বড্ড সমস্যা বোধ হয়! বাবার সমান লোককে ছলেবলে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলেছেন। তাও সাধারণ কেউ নন, দেশের এক নম্বর লেখক! যার লেখায় ফুল ফোটে, বৃষ্টি নামে, ফিনকি দিয়ে জ্যোৎস্না ঝরে সেই লেখক হুমায়ূন আহমেদকে বিয়ে করে ফেলল?’ হুমায়ূন আহমেদকে বিয়ে করে মেহের আফরোজ শাওনকে কী পরিমাণ কথা যে শুনতে হয়েছে, তা কোনও মেয়ে সারাজীবনেও শোনে কিনা সন্দেহ আছে।
এই অটল দাঁড়িয়ে থাকা নারীটির প্রতি তাই আমার বরাবরই এক প্রকার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল, বস্তুত সেটি এখনও তেমনি আছে। দিনে দিনে বাড়তেও পারে, কমেনি কখনও। তো এই শাওনের নাম শুনলেই মানুষ কান খাড়া করে শোনে কী কী বলা হচ্ছে তার নামে! ভালো কিছু বলার তো প্রশ্নই আসে না, যে মেয়ে পুরুষলোকদের পটায় তাকে নিয়ে ভালো কথা বলবে কে?
শাওনের সঙ্গে বিয়ের পর থেকে অনেকেই হুমায়ূন আহমেদকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলেন। অনেকেই আবার বলে থাকেন যে বিয়ের পর থেকেই হুমায়ূন আহমেদের লেখার হাত নষ্ট হওয়া শুরু করেছিল। এই মেয়েটা ‘ডাইনি’। তা  না হলে বিয়ের পরপরই সব লেখা অমন খারাপ হয় কী করে!
অবশ্য প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের ঘর ভেঙে, সন্তানদের বানের জলে ভাসিয়ে এই শাওনের প্রেমে পড়া অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রের স্খলন তেমন একটা ঘটেনি। কিন্তু শাওনের চরিত্র নিয়ে এখনও মিডিয়া পাড়ায় বড় বড় গল্প বলা হয়। বিষয়টা এমন যে লেখকরা এমন হয়ই, প্রেমে না পড়লে তাদের লেখা বের হয় না। কিন্তু তাই বলে শাওনের প্রেমে কেন পড়তে হবে? শাওন কি জানত না তার পরিবারে স্ত্রী-সন্তান আছে? শাওনের কি একবারও মনে হয়নি বাবার বয়সী কারও সঙ্গে কিভাবে মানুষ প্রেম করে? ব্যাপারখানা এমন যেন সব দায় শাওনের। প্রেমও করেছিল শাওন একা, বিয়েও করেছিল শাওন একা। এখানে আমাদের প্রিয় লেখকের কোনও অংশগ্রহণই নেই। শাওনই বা লেখককে কোন তন্ত্র/মন্ত্রের বলে বশ করেছিলেন যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই লেখকের মোহভঙ্গ হলো না? লেখার হাতও আগের মতো অত সমৃদ্ধ হলো না?

আমি একজন ভক্ত, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর শুনে টানা দু’দিন কেঁদেছিলাম। এখনও বইমেলা গেলে অন্যপ্রকাশ স্টলের সামনে ভীড় দেখলে ভেবে বসি, নিশ্চয়ই প্রিয় লেখক এসেছেন। কথাগুলো এজন্যই বললাম কেউ যেন মনে না করেন আমি হুমায়ূন আহমেদকে অপছন্দ করি বলেই এত কথা বলছি। আবার যা বললাম এতক্ষণ তাও কিন্তু অপছন্দ করে বলিনি। বলতে চাইছি প্রেম বা বিয়ে বা সংসার কিছুই একজনের ইচ্ছেতে হয় না, শাওনের একার ইচ্ছায় তাই কিছু হয়নি। সেখানে অবশ্যই প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের অংশগ্রহণ ছিল।  

লেখকের ‘নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ’ যেটা ক্যানসারের চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে লেখা, সে বইতে শাওনের বিষয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে। বইটাই শাওনের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। এখানে এসে একটি কথা না বলেই পারছি না। লেখকের সৃষ্টি এক বাকের ভাইয়ের জন্য জনতা রাস্তায় নামতে পারে কিন্তু লেখকের জীবনের চরম সত্য একটি চরিত্রকে মানুষ কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি। বাকের ভাইকে যেমন লেখকের দেওয়া প্রাণেই মানুষ চিনেছিল, শাওনকে বাস্তবতার বাইরেও লেখকের কলমে অনেকে জেনেছিল কিন্তু কোনদিন চিনতে চায়নি। শাওনকে নিয়ে লেখকের এত আবেগঘন লেখা, মুহূর্তবন্দীর সাদাকালো সমুদ্র কিছুই পাঠকের বিশ্বাস হয়নি। লেখক যতই শাওনকে প্রাধান্য দিয়ে লিখেছেন, সমাজ এবং ছি ছি করা মানুষগুলো ততই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

শাওনের অপরাধ কী? লেখকের সঙ্গে প্রেম করা? লেখককে বিয়ে করা? লেখকের আগের সংসার ভাঙা? বিয়ের সময় শাওনের বয়স ১৮ এর নিচে থাকা? নাকি কিচ্ছু না?

অনেকেই বলেন জনপ্রিয়তার জন্য, ক্যারিয়ারের জন্য! তারা কি জানতেন না শাওন জাতীয় পুরস্কার পাওয়া শিশুশিল্পী?

এক ‘অপরাধে’র জন্য মানুষ তাকে ভয়ঙ্কর সব শাস্তি দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে। কিন্তু আদৌ শাওন কি কোনও অপরাধ করেছেন? এ প্রশ্ন কি সমালোচকরা নিজেকে কখনও করেছেন? শাওন জানেন এবং মানেন তার এ শাস্তি থেকে কোনোদিন তার মুক্তি নেই। মুক্তি মেলেনি লেখকের মৃত্যুতেও। চেয়ার থেকে ধাক্কা মেরে লেখককে খুন করার মতো জঘন্য কুৎসাও রটিয়েছে মানুষ। রটানোর আগে একবারও ভাবেনি সঙ্গির মৃত্যুতে একজন মানুষ মানসিকভাবে কতখানি ভাঙাচোরা অবস্থার ভেতর দিয়ে যায়!

এখানে শেষ হলেও কথা ছিল, শেষ হয়নি। লেখককে কবর দেওয়া নিয়েও নাটকের ঘটনায় একমাত্র শাওনই ভুল, তার সিদ্ধান্তের ‘খ্যাতা পুরি’। লেখককে সমাহিত করা হবে পাবলিক প্লেসে, যেন জনসাধারণের যার যখন খুশি কবর জিয়ারত করতে পারে। শাওন সে সিদ্ধান্ত মেনে নেননি, একদম ঠিক কাজ করেছিলেন তিনি।  কিন্তু এও শেষ নয়। ক’দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম, লেখককে নিয়ে নাকি ব্যবসা করা হচ্ছে! শাওন নাকি নুহাশ পল্লীতে এন্ট্রি ফি নিয়ে লেখককে নিয়ে ব্যবসা করছেন, কোন খাতে সে এন্ট্রি ফি যায় সে অবশ্য জানার প্রয়োজন মনে করেননি কেউই। আসলেই কি ব্যবসা নাকি লেখকের স্বপ্নের ক্যানসার হাসপাতালের খাতে টাকা যায়; সেসব বলে কী লাভ!

তো এখানে শেষ হলেও শেষ হতে পারত, তাও হয়নি। এই নারীকে কিভাবে ইতিহাসের কাছে, পৃথিবীতে টিকে থাকা পর্যন্ত নষ্ট-ভ্রষ্ট করে রাখা যায় তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে এবার লেগেছেন জ্ঞানী-গুণী পছন্দের প্রিয় মানুষগুলো। যাদের মেধাকে সম্মান করে এসেছি, যাদের নিয়ে দেশের গর্ব হয় বলে ভেবেছি তারা এবার লেখকের সঙ্গে শাওনকে এবং শাওনের সঙ্গে লেখককে জড়িয়ে সিনেমা বানিয়ে ফেলেছেন।

কথা কতখানি সত্য সেটা বলার আগে স্বীকার করে নিচ্ছি, সিনেমাটি এখনও আম জনতার কাছে পৌঁছেনি, পৌঁছেনি আমার কাছেও। কিন্তু শাওন যদি সত্য হয় তবে সিনেমার এ বিষয়বস্তু ও নির্মাণের ঘটনায় আমি কিছুমাত্র বিস্মিত হবো না। এ সমাজের কাছে শাওন কতখানি কী চান তা জানি না কিন্তু এ সমাজ শাওনের মতো নারীদেরকেই চায় না এ আমি অনেক আগে থেকেই জানি। লেখকের মৃত্যুর পরেও শাওন এখনও বিয়ে করেননি, সংসার-সিনেমা এক হাতে সামলাচ্ছেন; এমন ধৃষ্টতা যে দেখায় সমাজ তাকে ঘেন্না করবে, এ অমোঘ। সমাজ তো চেয়েছিল শাওনের মতো নারীরা ঘরের ভেতর থাকবে, সঙ্গিহারা হলে জীবন শেষ বলে সবকিছু ছেড়ে ঘরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে। তারপর ক’দিন গেলে বিয়ে করে আরেকজনের সঙ্গে থিতু হবে। কেন কোমর বেঁধে নিজেরটা নিজে বুঝে নেবে? কেন এত অপমান, অসম্মান মুখ বুজে সহ্য করে বারবার উঠে দাঁড়াবে! এত কথা শোনার পর শাওনের মতো নারীরা মানুষের সামনে চোখ মুখ খুলে, শিনা টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পায় কোত্থেকে?

শাওনকে আমি শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। কারণ তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন মানুষের কথায় কান না দিয়ে, মানুষের নোংরামি দেখেও না দেখার ভান করে বটবৃক্ষের মতো সটান দাঁড়িয়ে থাকা যায়। লড়াই চলুক মেহের আফরোজ শাওনের, অন্যের জীবন নিয়ে নোংরামি করার অধিকার কারোরই নেই। তিনি পাবলিক ইন্টারেস্ট হতে পারেন, পাবলিক প্রোপার্টি নন এ কথা বুঝিয়ে দেওয়ার সময় বহু আগেই পেরিয়েছে।

শুধু শাওন কেন, কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু করার আগে অনুমতি নেওয়ার মতো সৌজন্যবোধ আমজনতা থেকে শিল্পী সবারই থাকা উচিত। হোক তা ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও বা সিনেমার চিত্রনাট্য, অপরাধ তো অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হওয়ার কথা। আশা করি হবে।

লেখক: সাংবাদিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, হিট অ্যালার্ট জারি
চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, হিট অ্যালার্ট জারি
জিমি নেই, তারপরও খেলতে নামছে মোহামেডান
জিমি নেই, তারপরও খেলতে নামছে মোহামেডান
বায়ার্নের কোচ হওয়া থেকে এক ধাপ দূরে জিদান
বায়ার্নের কোচ হওয়া থেকে এক ধাপ দূরে জিদান
সিরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ইসরায়েলের হামলা
সিরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ইসরায়েলের হামলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ