X
মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
১০ আষাঢ় ১৪৩২

অনলাইনে ধর্ষকামী পুরুষ: কেউ কি দেখে না?

শারমিন শামস্
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:১৫আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:২৮

শারমিন শামস্ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কিছু অপরিচিত পুরুষের ম্যাসেজ পাই, যারা অসৎ অভিপ্রায়ে অপরিচিত নারীর সঙ্গে কথাবার্তা বলার চেষ্টা চালায়। প্রথমে তাদের বার্তাগুলো ‘হাই’, ‘হ্যালো’ এবং নানারকম প্রশংসাবাণীতে মুখর থাকে। কিন্তু অপর প্রান্তে নারী যখন সাড়া দেন না, তখন বেরিয়ে আসতে থাকে তাদের প্রকৃত রূপ। এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনলাইনে এদেশের লাখ লাখ ধর্ষকামী পুরুষের কুৎসিত রূপ আজকাল যেভাবে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে, তাতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের চেহারাটা আসলে কেমন হবে, ভাবলে আতঙ্কগ্রস্তই হতে হয়।
দেশে ধর্ষণের হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে ধর্ষণ নিয়ে সরকার এবং প্রশাসনের রীতিমত নড়েচড়ে বসে এতদিনে একটা সুরাহার পথ বের করে ফেলার কথা ছিল। অভিযোগ জানানোর একটি পদ্ধতি চালু করেছে বটে কিন্তু খুব আশ্চর্যজনকভাবেই অভিযোগ না জানালে এধরনের কর্মকাণ্ড চোখে পড়লেও তাদের নীরবতা আমাদের হজম করে যেতে হয়। ধর্ষণ থেমে থাকে না। বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের ঘটনা যে হারে বাড়ছে, তাতে আসলে কোন পথে যাচ্ছি আমরা, কোন সে অন্ধকার, আদৌ কখনও আলোর পথ ফিরবে কিনা, নাকি আরও বড় গভীর আঁধারে ঢেকে যাবে চারদিক- জানা নেই। আসলেই জানা নেই। এ এক চরম অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরছে আমাদের। ভয়, আতঙ্ক, সংশয়, সন্দেহ আর নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করছে সমাজের সব স্তরের মানুষকে। অনলাইনে মানুষের বিকৃত চেহারাগুলো দেখে একটি বিষয় খুব সহজে অনুমান করা যায়, এক চরম বিকৃতি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার পেয়েছে। কুশিক্ষা, শিক্ষাহীনতা, যৌন অবদমন, বিকৃত যৌনশিক্ষা, ধর্মান্ধতা, দুর্নীতি আর মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় আমরা দিন দিন এক যৌনবিকারগ্রস্ত অসুস্থ অশ্লীল জাতিতে পরিণত করতে চলেছি। আমি জানি না, সরকারের উচ্চ মহল থেকে অনলাইনে এইসব বিকারগ্রস্ত মানুষের বিকৃত মন্তব্য আর পোস্টগুলো মনিটর করা হয় কিনা।
একজন লেখক, একজন সাংবাদিক, একজন মানুষ, একজন নারী হিসেবে এই সমাজে একটি বিশাল অংশ পুরুষের কাছে আমার কোনও সম্মান নেই। তারা আমার লেখা পুরোটা পড়বার ধৈর্য রাখে না, পড়লেও অনুধাবনের যোগ্যতা রাখে না। তারা আমাকে প্রকাশ্যে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে নির্বিচারে মন্তব্য করে যেতে পারে। একটি বা দুটি নয়, হাজারে হাজারে মন্তব্যে ভরে যায় বড় বড় নিউজ পোর্টালের ফেসবুক পাতা। নারীবাদ বিষয়ক লেখা শুধু নয়, যেকোনও রাজনৈতিক কলামের নিচেও একই ধরনের বক্তব্য আসতে থাকে। কেবলমাত্র নারী লেখক বলেই আমাকে শুনতে হয় শরীর ও চেহারা সংক্রান্ত মন্তব্য, ধর্ষণের হুমকি। বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয় কিভাবে আমাকে ধর্ষণ করা হবে।

দেশে যেহেতু সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যম সংক্রান্ত নীতিমালা একটি ‘হাস্যকর বিষয়ে’ পরিণত হয়েছে, তাই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নিউজ পোর্টালের কর্মীরা বসে থাকে। কোনও একটি সংবাদমাধ্যমে আমার কোনও একটি লেখা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত নীতিমালা ভঙ্গ করে তারা আমার লেখাটি চুরি করে ছাপিয়ে দেয় নিজেদের 'অখ্যাত' পোর্টালে। এখানেই শেষ নয় তাদের নোংরামি। লেখাটির সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ একটি শিরোনাম বেছে নেয় তারা হিট বাড়াবার অসৎ অভিপ্রায়ে। আমার কোনও অনুমতি ছাড়া ছেপে দেয় আমার ছবি। তারপর শুরু হয় তাণ্ডব। কুরুচিপূর্ণ পোর্টালের সকল পাঠক একই বংশজাত। তারা হামলে পড়ে আমার প্রতি। অনলাইনে ধর্ষণের মহোৎসব শুরু হয়ে যায়। আমার মতো আরো অসংখ্য লেখককে নিয়মিত এই দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

এই সব দেখে দেখে আজ বড় জানতে ইচ্ছে করে, আসলে ঠিক কোন দেশে বাস করি আমরা? এ কি কোনও সভ্য দেশের চিত্র? এ কি কোনও সুস্থ সমাজের প্রতিচ্ছবি? আদৌ কোনও নীতিনির্ধারক, কোন প্রশাসক, সরকার সংশ্লিষ্ট কেউ কি আছেন যারা এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভাববেন কোনোদিন? নাকি তারা মনে করেন এগুলো গুরুত্ব দেওয়ার মতো কোনও বিষয় নয়?

ধর্ষণ পুরুষের যৌনতা যতটা, তারচেয়ে অনেক বেশি তার শক্তি প্রদর্শনের ইচ্ছা। নারীকে অবদমন আর নারীকে শোষণ করে এক ধরনের স্যাডিস্ট বিকৃতি চরিতার্থ করতেই ধর্ষণ করে পুরুষ। নারীর ‘না’, নারীর আপত্তিকে প্রবল বিক্রমে ভূলুণ্ঠিত করে তাকে ভোগ করে ফেলে যাওয়া কিংবা হত্যা করে ছুঁড়ে দেওয়ার মধ্যে নিজের পৌরুষের বিজয় বলে মনে করে পুরুষ, যা পুরুষতন্ত্র তাকে শেখায়। পুরুষতন্ত্রের চোখে নারী ভোগের বস্তু, তার 'না' বলবার কোনও অধিকার নেই। আর অনলাইনে যে নারী লেখককে, যে অভিনেত্রী বা মডেল বা ক্রিকেটারের সুন্দরী স্ত্রীকে তারা ধর্ষণের হুমকি দিয়ে বেড়ায়, সেটি তার পৌরুষের অক্ষম আস্ফালন। নারীকে কাছে পেলে সবার আগে তাকে ধর্ষণ করার বিকৃত বর্ণনা লিখে লিখে প্রকাশ তার কাছে বীরত্ব, আর দিনের পর দিন অনলাইনে এই বীরত্ব প্রকাশ করেও যখন সে ধরাছোয়ার বাইরেই থেকে যেতে পারছে, তখন আর তার কিসের চিন্তা? কেনই বা সে করবে চিন্তা? ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার তাকে বিকৃতি চর্চার সুযোগ করে দিয়েছে। অবাধ নোংরামোর পথ খুলে দিয়েছে। কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, কোনও আইনের প্রয়োগ নেই। তবে কিসের ভয়ে চুপ করে থাকবে ওরা?

যে লেখক নারীর মুক্তির কথা বলছে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে, সে তো অনলাইনে ঘাপটি মেরে থাকা সেইসব ধর্ষক পুরুষের প্রতিপক্ষ। সেইসব পুরুষেরা তাদের প্রতিপক্ষকে কেন ছেড়ে দেবে?

দেশে নারী জাগরণের যে জোয়ারটি এসেছে, সেটি সময়ের প্রয়োজনে অবধারিতভাবেই এসেছে। একে কোনোভাবেই আটকে রাখার উপায় নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে এভাবেই রুখে দাঁড়ায় নিপীড়িত মানুষ। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আর অত্যাচারের শেষ আছে। কিন্তু লড়াইয়ের পথটি খুব কঠিন। এটা ভাবার কোনও কারণ নাই, লড়াকু নারীরা কোনোদিন এতে ইস্তফা দেবেন। বরং দিনে দিনে বাড়বে সৈন্য-সামন্ত, লড়াইয়ে আরও দক্ষ হয়ে উঠবো আমরা, লড়াই হবে আরো বিস্তৃত। আর এইসব ঝড়ঝাপ্টা যে আসবে, সেও আমাদের জানা। এসব জয় করেই সামনে এগোবো। ঠিক যেরকম কাঁটাগুলো ঝেড়ে কেটে পথ করে এগিয়ে যেতে হয় ঘন জঙ্গলে, ঠিক সেরকম। বেদনা আর দুঃখ শুধু একটাই, আমাদের বিরুদ্ধে অনলাইনে এইসব নোংরা আক্রমণ চাইলেই বন্ধ করতে পারেন সংশ্লিষ্ট মহল, কিন্তু তারা তা করেন না। কড়া মনিটরিং আর কয়েকজনের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলেই অনেকটা কমে আসতো এইসব বিকৃতির চর্চা। বিশেষ করে সাংবাদিকতার নামে নোংরামি আর অসততার ব্যবসাগুলো বন্ধ করা একমাত্র সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের পক্ষেই সম্ভব। এই তথ্য প্রযুক্তির দিনে এগুলোর কোনোটাই কঠিন নয়।

কিন্তু যেভাবে ধর্ষণ থামে না, প্রতিবাদের পর প্রতিবাদ করে গলা চিরে রক্ত ঝরে, তবু ধর্ষিত হয় পাঁচ বছরের শিশু, গণধর্ষণের পর ছুঁড়ে দেওয়া হয় রূপাদের চলন্ত বাস থেকে। চলতেই থাকে। লেখক হিসেবে যখন কলম ধরি, বিচার প্রার্থণা করি রূপার ধর্ষকের, তখন দলে-দলে ফিরে আসে তারা, প্রকাশ্যে জানিয়ে দেয় নারী লিখলেও তাকে ধর্ষণ করতে সদা প্রস্তুত তারা। হাজার হাজার ধর্ষণের আকাঙ্ক্ষায় ভরে ওঠে চারপাশ। কেউ দেখে না। কে‌উ না...

লেখক: প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
করোনায় একদিনে আরও ২১ জন শনাক্ত
করোনায় একদিনে আরও ২১ জন শনাক্ত
পরবাসে থেকে পারসার উপলব্ধি  
পরবাসে থেকে পারসার উপলব্ধি  
যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগে ইসরায়েলকে সতর্ক করলেন ট্রাম্প
যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগে ইসরায়েলকে সতর্ক করলেন ট্রাম্প
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রাখা সবার দায়িত্ব: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনআইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রাখা সবার দায়িত্ব: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
সর্বশেষসর্বাধিক