X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

খাবারের সঙ্গে রাগ করতে নেই

হারুন উর রশীদ
০১ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৫০আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:১৪

হারুন উর রশীদ ছেলেবেলায় এই অভিজ্ঞতা মনে হয় সবারই আছে। মা-বাবার সঙ্গে রাগ করে ভাত  খাওয়া বন্ধ রাখা। আমারও আছে। তবে আমি কিছুটা পেটুক হওয়ায় এক বেলার বেশি পারতাম না। দু’বেলাও হয়েছে কখনও কখনও। তবে সেটা হতো প্রতীকী অনশনের মতো। গোপনে বড় বোনের সহায়তায় ভাত ঠিকই খেতাম।
এবার আমরা সেই ‘খাবো না’ বিষয়টি জাতীয় রাজনীতিতেও দেখতে পাচ্ছি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বৃহস্পতিবারের সংলাপে খাওয়া-দাওয়াকে না করে দিয়েছে। তারা কি ভাতের সঙ্গে রাগ করেছেন, না প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে?
আলোচনা সংলাপের সঙ্গে চা পান আমরা এর আগেও দেখেছি। চা পান বা ডিনার (রাতের খাবার) সংলাপের  ভালো অনুষঙ্গ। আমরা সাংবাদিকরাও মাঝে মাঝে এরমকম পেশাগত আলোচনার আমন্ত্রণ পাই। বলা হয়, লাঞ্চ আওয়ারে আসুন, খেতে খেতে কথা হবে। আবার সময় বুঝে কেউ কেউ বলেন, আসুন একসঙ্গে চা খাই। আজকাল সংবাদ সম্মেলনের আমন্ত্রণপত্রে লেখাও থাকে, ‘ফলোড বাই লাঞ্চ’ অথবা ‘ডিনার’। তাতে কিন্তু সংবাদ সংগ্রহে আমাদের সমস্যা হয় না।

সংলাপের সময় গণভবনে, সন্ধ্যা ৭টায়। তাহলে এটা ডিনার দিয়ে শেষ হওয়াই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে দেশের বরেণ্য নেতারা যাবেন। সেটা যে বিষয় নিয়েই হোক না কেন, তিনি তো ডিনারের  ব্যবস্থা রাখবেনই। সেটা হয়তো আমাদের কালচারে রাতের খাবার বললে আরও জুতসই হবে। বলাও হয়েছে তাই নৈশভোজ।

ইউরোপ,আমেরিকায় ব্রেকফাস্ট মিটিং বেশ হয়। বড় বড় আলোচনা, দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, সংকট সমাধান ব্রেকফাস্ট মিটিংয়ে সেরে ফেলা হয়। আর আমরা প্রায়ই দেখি আমাদের এই অঞ্চল থেকে কেউ ওই অঞ্চলে গেলে খবর হয় ‘ট্রাম্প তাকে ব্রেকফাস্টে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন’। সেই ব্রেকফাস্ট কিন্তু ব্রেকফাস্টে সীমাবদ্ধ থাকে না। আলোচনাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। আমরা এখনও শুনিনি কেউ বলেছেন ব্রেকফাস্ট করবো না, শুধু আলোচনা করবো। অথবা ব্রেকফাস্টের কারণে আলোচনায় ব্যাঘাত হয়েছে।

বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত খবরে যা জানা যায়, তাতে প্রধানমন্ত্রীর  অতিথি আপ্যায়নে আন্তরিকতার প্রকাশ পেয়েছে। তিনি তার লোকদের দিয়ে রীতিমত ব্যক্তিগত পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপে যাওয়া নেতাদের কে কী খেতে পছন্দ করেন তা দিয়ে খাবারের মেন্যু সাজিয়েছেন। আর সেই মেন্যু হয়েছে ১৭ পদের। আমরা জানতে পারলাম ড. কামাল হোসেন চিজ কেক পছন্দ করেন। আমরা পাঁচকের নামও জেনেছি। আমরা ধারণা, শুধু তাদের পছন্দ নয়, প্রধানমন্ত্রী নিজের পছন্দেরও দু-একটি আইটেম রেখেছেন।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোচিত সংলাপে, খাবারের মৌ মৌ গন্ধে পানি ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা কি ঠিক হলো?

ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘নৈশভোজে অংশ নিলে তো আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটবে। সময় তো খুব মূল্যবান।’

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘দেশের একটি সংকটকালে আলোচনার জন্য আমরা গণভবনে যাচ্ছি; রাতের খাবার গ্রহণের জন্য নয়।’

তবে যতদূর জানা যায় আপত্তি আসে বিএনপির দিক থেকে। বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নৈশভোজে অংশ নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত রাজি হননি। আমার প্রশ্ন হলো, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপি নেতারা কি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন? তাদের ঘরে কি কোনও উৎসব আয়োজন হয় না? তারা কি রঙিন পোশাক ছেড়ে দিয়ে সাদা কাপড় পরা শুরু করেছেন?

আর সময় নষ্ট হওয়ার প্রশ্ন তো অবান্তর।  নৈশভোজের কারণে কি সংলাপ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে? নাকি আগে নৈশভোজ পরে সংলাপের কথা বলা হয়েছে?

মান্না সংকটকালের কথা বলে নৈশভোজে অংশ না নেওয়ার যে কথা বলেছেন তা শুনলে আমার হাসি পায়।  তিনি যখন কারাগারে ছিলেন তখন তার জীবনে একটি সংকটকাল ছিল। রিমান্ডে সেই সংকটকালেও তো তিনি তার বাসা থেকে খাবার নিয়ে খেয়েছেন।

আবারও সেই কথা মনে পড়লো। আর তা হলো– বাঙালির সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।  আমরা বিষয়গুলোকে সহজভাবে নিয়ে স্বাভাবিক পরিবেশে হাস্যরসের মাধ্যমে আলোচনা করে সমাধান বের করতে পারি না। আমরা যেন খুব সিরিয়াস। মনে হচ্ছে সংলাপে গিয়ে কেউ হাসতেও পারবেন না। এরইমধ্যে ঐক্যফ্রন্ট হয়তো সংলাপে গিয়ে আলোচনার সময় হাসির ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকতে পারেন। এটা এমনই এক দেশ, যেখানে কনে  বিয়ের আসরে ফিক করে হেসে দেওয়ায় তার বিয়ে ভেঙে যায়। সংলাপে আবার কেউ হেসে দিলে না সংলাপই ভেঙে যায়!

এটা ঠিক যে বাংলাদেশে সংলাপ সফল হওয়ার নজির তেমন নেই। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংলাপে বিদেশিরাও  এসেছেন। স্যার নিনিয়ান স্টিফেন,  জিমি কার্টার বা  তারানকো কেউই মধ্যস্থতা করে সংলাপের সফলতা আনতে পারেনি।  ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিল এবং বিএনপির মহাসচিব প্রয়াত আব্দুল মান্নান ভুঁইয়ার সংলাপের কথা এখনো অনেকে ভুলে যাননি।  ওই সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার বেশ কিছু দিন পর আমি মান্নান ভুঁইয়ার  সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তিনি তখন কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি আর জলিল ভাইতো এক ছিলাম। আমরা তো একমত হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের কারোর দলই তো একমত হয়নি। আমরা একমত হয়ে দলের কাছে ফিরে গিয়ে আবার ফলোআপ বৈঠকে দ্বিমত করতে বাধ্য হয়েছি।’

তাহলেও তারপরও সংলাপ কেন? কারণ, সংলাপ ছাড়া তো সংকট সমাধানের আর কোনও গণতান্ত্রিক পথ নেই। সমাধান যদি আসে এটাই পথ। আর  সমাধান না আসলেও একটাই পথ। রাজনৈতিক সংকটের সমাধান রাজনীতি দিয়েই করতে হবে। গণতন্ত্রের সংকট গণতন্ত্র দিয়েই দূর করতে হয়।

তাই রাগ করে ভাত না খেয়ে কোনও লাভ নেই। না খেলে কি সংলাপ সফল হবে? খাবারে  সংলাপ বিরোধী কোনও মসলা দেওয়া হবে! না মেন্যুতে সংলাপবিরোধী কোনও বিশেষ খাবার আছে?

একজন খাবারের আয়োজন করেছেন। আমি সেই খাবার না খেয়েও আয়োজনে অংশ নিতে পারি। আলোচনার পর নৈশভোজে খেতেই হবে তা নয়। অংশ নেওয়াটার মধ্যেই আন্তরিকতা ও পারস্পরিক সম্মানের বিষয়। তাই কারোর আয়োজনকে প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে কোনও সৌজন্যবোধ আছে বলে আমার মনে হয় না। প্রত্যাখ্যান নয়, প্রয়োজন গ্রহণ করার মন। এটা কোনও সিরিয়াসনেস নয়। সিরিয়াসনেস হলো মূল লক্ষ্য অর্জন করা। লক্ষ্য অর্জনে বিনয়ী ও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল নেওয়া। যার রান্না করা খাবার খেতে আমার আপত্তি , তার সঙ্গে কথা বলায় আপত্তি থাকবে না, এটা কোনও ভালো কৌশল নয়।

আর সাংবাদিকদেরও আমি কিছুটা দোষ দেই। তারা বিস্তারিত খাবারের মেন্যু ছেপেছেন। সাংবাদিকরা ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের এমন প্রশ্নও করেছেন, আপনাদের জন্য নাকি অনেক খাবারের আয়োজন করা হয়েছে? এসব কথায় হয়তো ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বিব্রত হয়েছেন। তারা  শেষ পর্যন্ত খাওয়া দাওয়াকে ভিন্নভাবে দেখেছেন।

কিন্তু আমার কথা হলো প্রধানমন্ত্রীর এই নৈশভোজের বিষয়টি তার আন্তরিকতার প্রকাশ। তিনি অতিথিকে তার বাড়ি থেকে খালি মুখে ফেরাতে চান না। আমাদের গ্রাম দেশে কোনও বাড়িতে গিয়ে কেউ পানি খেতে চাইলে গৃহস্থ শুধু পানিই দেন না,সাথে গুড়, নাড়ু, মুড়ি বা অন্য কোনও খাবার দেন। এটা আমাদের সংস্কৃতি।

আপনারা চা খেতে চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নৈশভোজের ব্যবস্থা করেছেন। তাতে দোষের কী করেছেন!

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল:[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকা সেনানিবাসে এএফআইপি ও সেনাপ্রাঙ্গণ ভবন উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
ঢাকা সেনানিবাসে এএফআইপি ও সেনাপ্রাঙ্গণ ভবন উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
চালককে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রিকশা ছিনতাই করতো তারা
চালককে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রিকশা ছিনতাই করতো তারা
হলফনামায় তথ্য গোপন, ওবায়দুল কাদেরের ভাইয়ের মনোনয়নপত্র বাতিল
হলফনামায় তথ্য গোপন, ওবায়দুল কাদেরের ভাইয়ের মনোনয়নপত্র বাতিল
মানবপাচার: মিল্টন সমাদ্দার আবার ৪ দিনের রিমান্ডে
মানবপাচার: মিল্টন সমাদ্দার আবার ৪ দিনের রিমান্ডে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ