X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

সিপিবি কি বাকশালের বিরোধিতা করেছিল?

বিভুরঞ্জন সরকার
২০ আগস্ট ২০১৯, ১৯:৪৫আপডেট : ২০ আগস্ট ২০১৯, ১৯:৫১

বিভুরঞ্জন সরকার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজনীতি সচেতন মহলে কিছুটা বিতর্ক শুরু হয়েছে। সিপিবির রাজনৈতিক লাইন ও নীতি-কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিপিবির অতীত গৌরবকে নস্যাৎ করার চেষ্টাও লক্ষ করা যাচ্ছে। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে দেখা যাক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কী বলেছেন, “১৯৭৫ সালে সিপিবি ‘একদলীয় ব্যবস্থা’ তথা ‘বাকশাল’ গঠন না করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরামর্শ দিয়েছিল। তিনি পার্টির পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এমতাবস্থায়, ‘বাকশাল’ গঠিত হয়ে যাওয়ার পরে পার্টিকে প্রকাশ্যে ‘বিলুপ্তির’ ঘোষণা দিতে হলেও আসলে পার্টি বিলুপ্ত করা হয়নি। খুবই গোপনে, অনেকটা সংকুচিত আকারে, পার্টির অস্তিত্ব ও তার কাঠামো বহাল এবং সক্রিয় রাখা হয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই সে কথা প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি অনেক পার্টি সদস্যকেও সে বিষয়টি অবগত করে ওঠা সম্ভব হয়নি। গোপনীয়তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ধীরে ধীরে পার্টি কাঠামো সম্প্রসারিত করা হচ্ছিল। এরকম একটা ‘হার্ড কোর’ আগাগোড়া গোপনে সংগঠিত ছিল বলেই ১৫ আগস্টের পর সব পার্টি সদস্যদেরকে তাই দ্রুত পার্টি কাঠামোতে সংগঠিত করা সম্ভব হয়েছিল।”
আমার জানা মতে, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভুল তথ্য দেননি। সিপিবিতে বাকশাল প্রশ্নে ভিন্নমত ছিল। অবশ্য পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদসহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাকশালের পক্ষে ছিলেন। যারা বিরুদ্ধে ছিলেন তাদের অবস্থান সম্পর্কে বাইরের কেউ কিছু জানতেন না। বরং বাইরে সিপিবিকে বাকশাল নিয়ে অতি উৎসাহী অবস্থানেই দেখা গেছে। সিপিবি বাকশাল চায়নি বা বাকশালের বিরোধিতা করে বঙ্গবন্ধুকে কোনও পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বলেও অনেকেরই জানা নেই। এতদিন পরে এসে বর্তমান বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাকশাল সম্পর্কে ‘সত্য’ প্রকাশ কেন কমরেড সেলিমের কাছে জরুরি মনে হয়েছে, প্রশ্ন সেটাই। বাকশাল সম্পর্কে আমাদের দেশে অনেকের মধ্যেই বিরূপতা আছে। সেটা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা ‘ক্যাশ’ করার জন্যই কি এই সত্য প্রকাশ? রাজনীতি সচেতন অনেকের প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে, কমরেড সেলিম সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে ভুল বার্তা দিয়েছেন মানুষের কাছে। এটা সিপিবি রাজনীতির এক ট্র্যাজেডি যে, দলটি যা বলতে চায়, মানুষ সেটা না বুঝে বোঝে উল্টোটা।

বাকশাল প্রশ্নে সিপিবির ভেতরের এবং বাইরের অবস্থান সবার জানার কথা নয়। সিপিবি বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল না করার পরামর্শ দিলে তা দিয়েছিলো গোপনে আর বাকশালের পক্ষে অবস্থান ছিল প্রকাশ্য। এমনকি তখন এমন প্রচারও ছিল যে, সিপিবির পরামর্শেই বঙ্গবন্ধু একদলীয় ব্যবস্থায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তখন এই প্রচারণার বিরোধিতা সিপিবি করেনি, বরং এক ধরনের অহংকার সিপিবির অনেকের মধ্যে ছিল যে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাও তাদের ‘পরামর্শ’ শুনে ‘সিদ্ধান্ত’ নেন।

প্রসঙ্গত এটা স্মরণ করা যেতে পারে যে, সিপিবির প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি বিশেষ বোঝাপড়া আগাগোড়াই ছিল। সিপিবির বর্ষীয়ান নেতা কমরেড মণি সিংহ ও খোকা রায়ের সঙ্গে গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকেই ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মধ্যস্থতায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই বৈঠকের আলোচনার ভিত্তিতেই পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ও  সিপিবির মধ্যে মৈত্রী সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়েছিল। আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি তার বিভিন্ন গণসংগঠনের মাধ্যমে বড় ভূমিকা রেখেছিল। তবে আওয়ামী লীগের বরাবরই অন্য দলের সঙ্গে ঐক্যের প্রশ্নে অনীহা ছিল।

কমরেড সেলিম বলেছেন, বাকশাল গঠনের সময় কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে বিলুপ্ত করে একটি গোপন কাঠামো রাখা হয়েছিল। এটা দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টির কৌশল। আবার এটা পার্টির সবাই জানতেন না, জানতেন নীতিনির্ধারক দু’চার জন। বৈরী পরিস্থিতিতে পড়লে কমিউনিস্টরা অন্য দলে ঢুকে কাজ করে, পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে না আসা পর্যন্ত। সময়মতো আবার আত্মপ্রকাশের সুযোগ হাতে রাখে। বাকশালের ক্ষেত্রে হয়তো তেমন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে সমাজতন্ত্রের পথে যেতে চেয়েছিল সিপিবি। সিপিবির ত্যাগ-দেশপ্রেম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সংশয় ছিল না। কিন্তু তাদের জটিল তত্ত্ব ও প্রায়োগিক কৌশল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মনেও প্রশ্ন ছিল। সিপিবি অনেক ক্ষেত্রেই ঘোড়ার আগে গাড়ি নিয়ে মাতামাতিতে অভ্যস্ত। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এর উল্লেখ আছে। সিপিবির কথা শুনে চললে বাংলাদেশ স্বাধীন করা কঠিন হতো- মনে করতেন বঙ্গবন্ধু। সিপিবি মুক্তিযুদ্ধের সময় দলিল রচনা করেছিল যে, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হইবে’। ওই দলিল ছাপাখানায় থাকতেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। কাজেই সিপিবির দলিল বা কিতাবে কী লিপিবদ্ধ আছে সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে বাস্তবে কি ঘটেছে সেটাই দেখা উচিত।

স্বাধীন বাংলাদেশে সিপিবি বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রতি ‘ঐক্য ও সংগ্রামের’ নীতি নিয়েছিল। কিন্তু মানুষ ঐক্যটাই দেখেছে, সংগ্রামটা দেখেনি। সদ্য স্বাধীন দেশে একশ্রেণির আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর দুর্নীতি-অনিয়ম-লুটপাটের বিরুদ্ধে সিপিবি কার্যকর বিরোধী অবস্থান নিতে পারেনি। তাই দ্রুত সংগ্রামের জায়গা দখল করে নেয় জাসদ-আওয়ামী লীগ ত্যাগী একদল বিভ্রান্ত মানুষ। দেশটাকে ক্রমশ গভীর খাদের কিনারে নিয়ে যেতে বড় ভূমিকা পালন করেছে জাসদের হটকারী রাজনীতি। সিপিবি ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘সৎ ও দক্ষ’ সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিল। তবে সেই সৎ ও দক্ষ ব্যক্তি কোথায় পাওয়া যাবে তার কোনও নির্দেশনা তাদের ছিল না। আওয়ামী লীগ খারাপ কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভালো- সিপিবির এই নীতি মানুষের কাছে খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছিল বলে মনে হয় না। যাক, সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়।

গোপন অবস্থান কী ছিল সেটা মানুষ জানতো না। মানুষ দেখেছে বাকশাল নিয়ে সিপিবির উচ্ছ্বাস। সিপিবির প্রধান নীতিনির্ধারণী নেতা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে আমি এমন অনেক তথ্য জানি, যা থেকে এটা বলতে পারি যে বাকশাল নিয়ে সিপিবিতে দোদুল্যমানতার চেয়ে দৃঢ়তাই বেশি ছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে, বাকশাল টিকে গেলে সিপিবি নিঃসন্দেহে ‘ক্রেডিট’ দাবি করতো, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয় তাতে সিপিবি যে কিছুটা দিশাহারা হয়েছিলো তাতে সন্দেহ নেই। বাকশাল ব্যাপকভাবে সমালোচিত হওয়ায় সিপিবি গা থেকে বাকশালের গন্ধ মুছতে গিয়ে ‘উল্টাপাল্টা’ কাজ করে বসে। তারা জিয়াকে ‘সীমিত অর্থে জাতীয়তাবাদী’ বলে তকমা দিয়ে তার ‘খাল কাটা’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। সিপিবি একসময় আওয়ামী লীগের ‘বি-টিম’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু তখন দলটির জনসমর্থন ও সাংগঠনিক শক্তি ক্রমবর্ধমান ছিল। এখন সিপিবি স্বাধীন অবস্থানের নামে আওয়ামী লীগ থেকে দূরে থাকার নীতি নিয়েছে। আমাদের দেশের রাজনীতির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো আওয়ামী লীগ থেকে দূরে মানে প্রতিক্রিয়াশীলতার কাছে যাওয়া। সিপিবি এখন আওয়ামী লীগ থেকে দূরে এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার কাছাকাছি আছে বলে যে সমালোচনা তা কাটানোর জন্যই হয়তো কমরেড সেলিম অহেতুকভাবে ‘বাকশাল’ বিতর্ক সামনে এনে মানুষের ফোকাস বদলাতে চান বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এশিয়ান কাপে ওঠার অনুভূতি বলে প্রকাশ করতে পারছেন না ঋতুপর্ণা
এশিয়ান কাপে ওঠার অনুভূতি বলে প্রকাশ করতে পারছেন না ঋতুপর্ণা
সরকারের জাতীয় ঐকমত্যের উদ্যোগে বাধা একটি দল: জামায়াত সেক্রেটারি
সরকারের জাতীয় ঐকমত্যের উদ্যোগে বাধা একটি দল: জামায়াত সেক্রেটারি
বিচার, সংস্কার এবং নতুন সনদের বাস্তবায়নে জনগণই আমাদের একমাত্র শক্তি: নাহিদ ইসলাম
বিচার, সংস্কার এবং নতুন সনদের বাস্তবায়নে জনগণই আমাদের একমাত্র শক্তি: নাহিদ ইসলাম
কাবরেরার পদত্যাগ চেয়ে নিজেই অপসারিত শাহীন!
কাবরেরার পদত্যাগ চেয়ে নিজেই অপসারিত শাহীন!
সর্বশেষসর্বাধিক