X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা যা শিখছি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০২ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:১৯আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:৫৫

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা শিক্ষিত মানুষের আচরণও যে কত গুরুতর হতে পারে, তার প্রমাণ দিয়েছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মু‌জিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযু‌ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনে পরাভূত হয়ে অবশেষে তিনি পদত্যাগ করেছেন। তিনি ছাড়তে চাননি। তিনি একজন ভিসি, একজন শিক্ষক, যিনি ক্যাম্পাসে রক্তাক্ত পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেন, বহিরাগতদের দিয়ে নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের মার খাওয়াতে পারেন। এখন আরেকজন উপচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ক্যাম্পাস অশান্ত রয়েছে। আর তিনি হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলাম, যিনি ক্যাম্পাস উন্নয়নের অর্থ ছাত্রলীগের নেতাদের চাঁদা হিসেবে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আর প্রক্টরদের দেখে আমরা সবাই জ্ঞানসমৃদ্ধ হচ্ছি। আমরা দেখছি কেমন হতে পারেন জাতির বিবেকরা, প্রজ্ঞা আর জ্ঞানের নির্মাতারা। কিন্তু এই যে আমাদের এত এত পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সেগুলোর কোথাও কিন্তু শিক্ষা বা গবেষণা নিয়ে সমাজে কোনও আলোচনা নেই। আছে শুধু অনিয়ম, দুর্নীতি আর অস্থিরতা নিয়ে। এই অস্থিরতা গোলযোগপ্রিয় ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বা ক্যাম্পাসে বিরাজমান চাঁদাবাজি সংস্কৃতি নিয়ে।

আমাদের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই কোনও গ্লোবাল র‌্যাংকিংয়ে নেই, কারণ এগুলোর মান সেই পর্যায়ে নেই। শিক্ষার মান নির্ভর করে ভালো শিক্ষকের ওপর। আমরা ঠিক জানিই না আমাদের স্যারেরা কবে থেকে শিক্ষক হিসেবে ফেল করতে শুরু করেছেন। তারা শিক্ষক হিসেবে যতটা নিয়োগ পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি বিবেচিত হয়েছেন শিক্ষক রাজনীতির ভোটার হিসেবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের মাসে মাইনে এখন লাখ টাকার বেশি। আরও কত কী উপায় তাদের উপার্জনের। খুবই ভালো। শিক্ষকদের আর্থিক উন্নতির নিশ্চয় প্রয়োজন আছে। তবে, তারা যেন পড়ানোর কাজটা করেন, সেই ব্যবস্থাপনাটা কোথায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে? সেটা জানার বড় সাধ এখন আমাদের।

উচ্চশিক্ষার মান কী ও কেমন হওয়া উচিত, এ নিয়ে তর্ক অনেক। উৎকর্ষ বলতে আমরা আসলে কোনও বেঞ্চ মার্ক ঠিক করতে পারবো না। তাই শিক্ষার মান কী করে উন্নত করা যায়, এ অঙ্ক সত্যিই কঠিন। মানোন্নয়নের লক্ষ্যে, সবার আগে যেটা করতে হবে, কোনোরকম আপস না করে ভালোকে ভালো আর খারাপকে খারাপ বলার অভ্যেস করতে হবে। এটুকুই কি শিক্ষকরা প্রাণ খুলে বলতে পারছেন আজকের সব ক্যাম্পাসে?

একজন শিক্ষার্থীর কাছে উচ্চশিক্ষা বাধ্যবাধকতা, কারণ সেটা ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। এই সনদ দিয়ে সে একটা চাকরির জন্য অপেক্ষা করে বছরের পর বছর। 

দেশের অগ্রগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি সমাজে এখন এক ধরনের প্রবল বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে। বিতৃষ্ণার কারণ কী? একটা হতে পারে, অবশ্যই এই শিক্ষা প্রাঙ্গণগুলোয় অতি অপরাজনীতির প্রাদুর্ভাব, যে কারণে শিক্ষার পরিবেশে যুক্তি-তথ্য-অনুসন্ধিৎসুর আবহটা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি আনুকূল্যে সব শ্রেণির ছাত্র অল্প খরচে উচ্চশিক্ষা পেয়ে আসছে। সরকারি উদ্যোগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য সামাজিক ন্যায় ও জাতীয় মানবসম্পদ সৃষ্টি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ আর যেন পারছে না সেই সেবা দিতে।

কিছু কিছু উপাচার্য আজ যেভাবে রাষ্ট্রে আলোচিত, ক্যাম্পাসগুলোর যে চিত্র আজ উন্মোচিত, তাতে মনে হয় উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থকরী বিদ্যার প্রশিক্ষণ। ব্যাপকতর চিন্তা-গবেষণা নয়, জ্ঞানতন্ত্র নয়,  দুর্বৃত্ত কীভাবে হতে হয় তার প্রশিক্ষণ। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে যারা এভাবে কব্জা করে চলেছে, তারা এটা করছে সমাজকে শায়েস্তা করার জন্যই। আজ প্রায় সবাই বলে ‘রাজনীতির কারণে উচ্চশিক্ষা গোল্লায় গেলো। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এই ছাত্র আর শিক্ষক রাজনীতি আসল রাজনীতি নয়, রাজনীতির নামে চাঁদাবাজি আর দখল সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানো।

সোজাসুজি কয়েকটা প্রশ্ন যদি করা যায়—গত ১৫-২০ বছরে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার হাল ভালো না খারাপ হয়েছে? লেখাপড়া-গবেষণার সাধারণভাবে উন্নতি ঘটেছে কি? আগেকার ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎকর্ষ অক্ষুণ্ণ আছে কি? নতুন যেগুলো হলো, সংখ্যা ছাড়া অন্য বিচারে এরা নজর কেড়েছে? আমরা জানি কোনও প্রশ্নেরই কোনও সদুত্তর আসবে না।

ভর্তি নিয়ে অভিযোগ এসেছে, হানাহানির যে প্রকোপ ছিল তার পাশাপাশি এসেছে উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে ভাগাভাগির প্রসঙ্গ, কমিটি বাণিজ্যসহ আরও কত কিছু। শিক্ষাঙ্গনে শান্তিপূর্ণ, সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার সব প্রতিশ্রুতি আজ পরিহাসে পর্যবসিত হয়েছে।

উচ্চশিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে বলে তো শুধু শিক্ষকদের দুষলে চলে না। আমাদের সম্মিলিতভাবেই পথ খুঁজতে হবে। শিক্ষক, রাজনীতিক আর সমাজের সব স্তরের মধ্যে একটা আন্তরিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা আমরা সবাই এখন অনুভব করছি। শিক্ষকদের প্রতি সম্মান ও শিক্ষা বিকাশে সমাজের আগ্রহটা অনেক বড় বিষয়। আর সেটা এই বৈরী রাজনীতির পরিসরে কতটা সম্ভব তা বলা মুশকিল।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচাতে হবে। এটা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের প্রশ্ন নয়, দেশেরও। মানুষ চায় তাদের সন্তানরা এখানে মানুষের মতো মানুষ হোক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সরকার সবার কাছেই মানুষের সনির্বন্ধ আবেদন—শিক্ষাব্যবস্থাকে নষ্ট রাজনীতির হাত থেকে বাঁচাবার প্রয়াস নিন। বহু দিনের হতাশা থেকে মুক্তির কোনও উপায় যদি আমরা এখনই বের করতে না পারি, তবে ভবিষ্যতের কাছে আমরা সবাই অপরাধী হয়ে থাকব।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ