একটি ছবি, তা নিয়ে তোলপাড় অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এক তরুণ আর তার কিছু বন্ধু এক নারী মূর্তি নিয়ে অশ্লীলতা করেছেন, আবার সেই ছবি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছেন। সমালোচনার মুখে তরুণটি ক্ষমাও চেয়েছেন। বিতর্ক কমেছে। কিন্তু বোঝা গেল কিভাবে দূষণ রন্ধ্রে-রন্ধ্রে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজে সংক্রমিত হয়েছে।
এমনটা হয় কেন, বা হচ্ছে কেন? আমাদের যারা নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে আছেন, তারা ঠিক সময়ে বাধা দিতে পারছেন না বা পারেননি। কিভাবে যেন দূষণের প্রবল স্রোত সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে যখন লিখছি, তখন পাঁচ বছরের নীরবের নিথর দেহ টেলিভিশের পর্দায়। শ্যামপুরের ওয়াসার ম্যানহোলে পড়ে মারা গেছে সে। গিয়েছিল খেলতে, মায়ের কোলে ফিরেছে লাশ হয়ে। যেমনটা হয়েছিল শিশু জেহাদের। এক বছর আগে, গত বছর ২৬ ডিসেম্বর শাহজাহানপুরে এমনিভাবেই খেলতে গিয়ে চিরদিনের হারিয়ে গিয়েছিল আরেক শিশু জিহাদ। জিহাদ-নীরবরা চলে যায় ওয়াসার কর্মচারীদের বেখায়ালিপনায়, তাতে যেন কারও কোনও দায়বদ্ধতা নেই। মানুষের জীবনের কত কম এখানে! যেখানে-সেখানে লাশ পড়ে থাকে, তরুণীর ধর্ষিতা শরীর পড়ে থাকে বনজঙ্গলে, তো যুবকের ক্ষত-বিক্ষত দেহ আবিষ্কৃত হয় রেল লাইনে, কালভার্টে। তারা হয়তো বারবারই চিৎকার করে করুণ প্রাণ বাঁচানোর আবেদন করেছিল, কিন্তু সমাজের তো সময় নেই তাদের ডাক শোনার।
শিশুরা মরে যায় কারও অবহেলায়, উদাসীনতায়, নিষ্ঠুরতায়, মেয়েরা ধর্ষিতা হয়, যুবকেরা খুন হয়, নিখোঁজ হয়ে যায়, কিন্তু আমরা এক হই না, প্রতিবাদ করিনা। দুই-একবার সমস্বরে কিছু চিৎকার হয়, তারপর আবার বিভাজন, আবার আমাদের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ, আবার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দ্বন্দ্বে আমরা প্রতিকারের পথগুলো বন্ধ করে দেই।
এটাই দূষণ। আমাদের সব ভালোবাসা, আমাদের সব ভালোচিন্তা, আমাদের সব সৃজনশীলতার আয়োজনে এখন স্লোগানটাই বেশি শুনতে পাই, কাজটা আর দেখতে পাই না। একদিকে সবকিছুর দখলে রাজনীতি, অন্যদিকে এক বিচিত্র আধুনিক শ্রেণির হাতে আমাদের বন্দিত্ব। এরা মোবাইল ফোনে নারীর ছবি তুলে ছড়িয়ে দেয় ইন্টারনেটে, সর্বনাশ ডেকে আনে একের পর এক পরিবারে। কোনও প্রতিকার নেই। দুই-একটি ঘটনা জানা যায়, বেশিরভাগ লুকোনো থাকে।
আমাদের লেখাপড়ার ধরনটাও বদলেছে। টিউটর রেখে, ছেলেমেয়েদের ভালো ফল পাইয়ে দেওয়ার সনাতনী প্রথার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে প্রশ্নপত্র কিনে ফেলা। প্রশ্নপ্রত্র কিনতে পারলেই সন্তান ডাক্তার হতে পারবে, যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক। এমনকি প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয় এদেশে। ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। একটাই কথা—যেভাবেই হোক, এগিয়ে থাকতে হবে। পড়াশোনার ছবিটা এমনই পাল্টে গেছে যে, ভর্তি পরীক্ষার ডিজিটাল জালিয়াতি ধরতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন সাইবার বিশেষজ্ঞ রাখতে হয়। কয়েকদিন আগে এক ভিডিওতে দেখলাম একটি পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীরা নকল করছেন, শিক্ষকরা, যারা পরীক্ষার হলে পাহারা দেওয়ার কথা, তারা সহায়তা করছেন। দুই-একজন হয়তো মৃদু তিরস্কার করেন, কিন্তু বেশি কিছু করতে ভয় পান। তাহলে তো রাস্তায় অপমানিত হওয়ার ভয় থাকে।
গণমাধ্যমাধ্যমের পাতায়-পাতায় এমন খবর। লেখালেখির জগৎটাকেও বানিয়েছি হিংসার ক্ষেত্র। মতানৈক্য ঘটলেই মেরে ফেলতে হবে। চাপাতি চালাতে একটুও হাত কাঁপে না আর কারও। সাহিত্য রচিত হচ্ছে, গদ্য–পদ্য–প্রবন্ধ প্রভৃতি নানা শাখাপ্রশাখায় বিস্তৃত হচ্ছে, কিন্তু সুকুমারবৃত্তিগুলো হারিয়েই যাচ্ছে। কবিতা–গল্প–সংগীতে ওপর আকর্ষণ দেখছি ঠিকই, তার চেয়েও বেশি দেখছি কুসংস্কারবাজের চিৎকার আর আস্ফালন।
যেকোনও উপায়ে অর্থবিত্ত আদায়ের পথকে এখন আর দুর্নীতি বা অনীতি বলে না। বলে এটা হলো স্টেপ মেলাতে জানা বা তাল মেলানো। চ্যানেল সার্ফিংয়ের মতো সবকিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কাল যা মূল্যবোধ ছিল, আজ তা গেঁয়ো ভাবনা। মূল্যবোধ, এথিক্স, ন্যায্য-ন্যয়বোধ—এ সব আবছা-কাটিং শব্দ। তাই তা আর সমাজ নেয় না। মূল্যবোধ মানেই হয়তোবা কোথায় বেশি মূল্য পাওয়া যাবে, সেই ভাবনা বিস্তৃত করা।
তোমাকে জিততে হবে, মার্কেটে থাকতে হবে। নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাও, সব দল তোমাকে চাইবে, তুমি বুঝবে রেটিং বাড়ছে। রেটিংটা ঠিক করতে পারলে একটা মঞ্চ পেয়ে যাবে, বিবেকের জায়গায় ঘোরাফেরা করার কী দরকার? শুরুতে যা বলেছিলাম, তরুণটি এমন করেছেন, কারণ এটি তার কাছে আপত্তিকর কিছু মনে হয়নি। আশার কথা এই যে, ও কিছুটা বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়েছেন, না চাইলেই বা কী করা যেত। সেও অনেক স্মার্টের মতো ভাবতে পারত এটা তো ফান, এ নিয়ে এত ভাবনার কী আছে?
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন