X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উৎসবমুখর সম্প্রচার নয়

হাসান মামুন
২৬ নভেম্বর ২০১৫, ১২:৩০আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৬:৪১

Hasan Mamunএকাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও তার দণ্ড কার্যকরের ঘটনা এদেশে নতুন, একথা ঠিক। এর কিছু রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে, এটাও মনে হয় না কেউ অস্বীকার করবে। কিন্তু এ ধরনের বিচারের পর যখন কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মতো ঘটনা ঘটছে, তখন কেমন হবে আমাদের আচরণ? এ পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধে চারজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সরকার। সবশেষে একসঙ্গে দু'ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। দীর্ঘদিন পর গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার সম্পন্ন হওয়াটা নিশ্চয়ই স্বস্তির, আনন্দেরও; কিন্তু কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়াটা কি আনন্দের?

বিশ্বের একশ্রেণির দেশ বা এমনকি একই দেশের কিছু রাজ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। তবে আমাদের দেশে রয়েছে। কোনও অপরাধে কারও সর্বোচ্চ শাস্তি হলে সেটা এখানে মৃত্যুদণ্ড হবে, এটাই স্বাভাবিক। এ পর্যন্ত একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে যাদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, তারা আপিল বিভাগ পর্যন্ত লড়েছেন। শেষ দু'জন তো দেখা যাচ্ছে মার্সি পিটিশনও দাখিল করেছিলেন রাষ্ট্রপতির কাছে। সেটি গৃহীত হওয়ার মতো হলে আশা করা যায়, গৃহীত হতো। সেটা হয়নি বলে দ্রুত তাদের দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। সরকার হয়তো আরেকটু দেরি করতে পারতো। কিন্তু তাতে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই মিলত না আসামিদের।

এর সবই ঠিক আছে। তারপরও সব দেখেশুনে মনে প্রশ্নটা জাগল যে, যারা এ বিচারের পক্ষে, তারা কী করব? আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর পুত্র। তিনি একজন সুপরিচিত সাংবাদিকও। দুই মানবতাবিরোধী অপরাধীর ফাঁসি হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে টিভি চ্যানেল ও অনলাইন পত্রিকায় দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, কারও ফাঁসি হওয়াটা আনন্দের নয়। তার এ উক্তিতে সুরুচি ও শুভবুদ্ধি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে বলে একটু হলেও ভরসা পেলাম। এ নিবন্ধে আলোচ্য বিষয়ে কিছু কথা বলার উৎসাহও পেলাম বলা যেতে পারে।

একটা সময় ছিল যখন চিন্তাও করা যেতো না, একাত্তরে স্বজাতির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণকারী ও তার নেতাদের বিচার করা যাবে এদেশে। কাঙ্ক্ষিত অনেক কিছু না হওয়ার মাঝে এটি যে শুরু করা গেছে, তা কম কী? মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে নানা প্রতিবন্ধকতাও তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে। সরকার সেগুলো উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা দেখাচ্ছে, এও লক্ষণীয়। বিধিবদ্ধ উপায়ে বিচার সম্পন্ন করে একাত্তরের চারজন বড় অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সরকার। তারা জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা।

মতিউর রহমান নিজামীসহ আরও বেশ ক'জন রয়েছেন মৃত্যুদণ্ডের জন্য অপেক্ষমাণ। ব্যাপারটিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে কি? এর ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের একটি সংগঠিত রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির প্রায় সবাই দৈহিকভাবে অনুপস্থিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা সামনে এসে গেছে। দলটিও নাকি বেআইনি হয়ে পড়বে। আমাদের রাজনীতিতে ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে এর প্রভাব। ক্ষমতাসীন ও তার প্রতিপক্ষ দলে এরই মধ্যে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ।

এর সবই ঠিক আছে। কিন্তু এ ধারায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মুহূর্তে কী করব আমরা? 'আমরা' বলতে বোঝাচ্ছি তাদের, যারা এ বিচারের পক্ষে। যারা মনে করছি, অনেক দেরিতে হলেও এটি ঘটার প্রয়োজন রয়েছে। তাদের একাংশ কিন্তু 'আনন্দিত' হয়ে মিষ্টি বিতরণ করছে অনেকদিন ধরে। অন্যকে খাওয়াচ্ছে; নিজেও খাচ্ছে। নিজ থেকে নিবৃত্ত না হলে বলেকয়ে এদের নিবৃত্ত করা যাবে না। তবে একটি কাজ করা যেতে পারে, তা হলো এ ধরনের স্থির বা সচল ছবি মিডিয়ায় প্রচার না করা। তাহলে হয়তো এদের মিষ্টি খেয়ে আনন্দ প্রকাশের উৎসাহে একটু ভাটা পড়বে। এ ধরনের খবর লেখার ক্ষেত্রেও সতর্কতা প্রয়োজন। রিপোর্টার যা-ই লিখুন, ডেস্কে এর ভালো সম্পাদনা হতে হবে।

দুই মানবতাবিরোধী অপরাধীর দণ্ড কার্যকরের মুহূর্তে শেষবারের মতো যখন আসামির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন তার ব্যথিত স্বজনরা, সেই মুহূর্তে এক ব্যক্তিকে দেখেছি লাঠিতে উঁচু করে তাদের ফাঁসির রজ্জু দেখাতে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তাও কি ওই সময় জেলগেটে ছিলেন না, যিনি তাকে ওই রকম আচরণ থেকে নিবৃত্ত করবেন? দীর্ঘ সময় ধরে তিনি বারবার কাজটি করেছেন, উভয় পরিবারের যন্ত্রণাকাতর স্বজনদের সঙ্গে। টিভি পর্দায় ওই দৃশ্য দেখতে দেখতে লজ্জিত হয়েছি, যখন শুনেছি একজন রিপোর্টারকে সেটি আবার বিশেষভাবে উল্লেখ করতে।

কোনটি নিউজ আর কোনটি নয়, তা বোঝার ক্ষেত্রে অদক্ষতা থাকতে পারে; কিন্তু আমরা কি মানবিক অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ব? এর আগে কোনও একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর দেখেছিলাম এক টিভি চ্যানেলের কর্মীদের গাড়ি নিয়ে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে ছুটতে ছুটতে অনেকটা পথ যেতে। তাদের কী ওই রকম করতে বলা হয়েছিল? জানি না, এসবের জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয়েছে কিনা। মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রথমবারের মতো মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল একটি টিভি চ্যানেলের কর্মীদের পার্শ্ববর্তী কোনও এক ভবনে চিত্র ধারণের জন্য গিয়ে হাজির হতে। তাদের মাথায় কি ওটা ‘সরাসরি সম্প্রচারের’ আইডিয়া ছিল?

অনেকে বলতে পারেন, প্রথমবার বলে ওই রকম হয়ে গিয়েছিল বা এভাবেই আমরা শিখছি। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ইতিহাস দীর্ঘ এবং টিভি সাংবাদিকতাও একেবারে কম দিনের নয়। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে একটু জানার মনোভাব থাকলে এগিয়ে থাকা দেশগুলোয় এসব ঘটনা কীভাবে 'কভার' করা হয়ে থাকে, সেটা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। আমরা তো নতুন মানদণ্ডও তৈরি করতে পারি। খালি অনুসরণ করতে হবে কেন? মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে এদেশ কি নতুন মানদণ্ড তৈরি করেনি? ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ কি দেয়নি বাংলাদেশ? বয়সের বিচারে একাধিক মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধীকে কি তা থেকে রেহাই দেওয়া হয়নি? এদের মার্সি পিটিশনের সুযোগও কিন্তু বহাল রাখা হয়েছে।

সাংবাদিকতায়ও নতুন কিছু করার সুযোগ রয়েছে-- যা করছি, তা না করে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে বলে খবর পাওয়া মাত্র জেলগেটে হাজির হয়ে এর সমস্ত খুঁটিনাটি উত্তেজিত কণ্ঠে দর্শক-শ্রোতাকে জানানো বা ধারাভাষ্য দেওয়াটা বোধকরি আমাদের মৌলিক আবিষ্কার। যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দণ্ড কার্যকর তো আরও কিছু দেশে হয়েছে এবং হচ্ছে। কোথাও কী এভাবে মৃত্যুদণ্ডের খুঁটিনাটি সরাসরি ও সচিত্র প্রচারিত হয়েছে বা হচ্ছে? কোথাও এমনটি হয়ে থাকলেও আমাদের তা অনুসরণ করতে হবে কেন?

এমনটা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে অতিউৎসাহে বিভ্রান্তিকর বা ভুল তথ্যও পরিবেশন করা হয়ে গেছে। কিছু অপ্রশিক্ষিত রিপোর্টার দীর্ঘ সময় ধরে একই কথা বা যা খুশি বলে গেছেন অনেক ক্ষেত্রেই। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। অফিস থেকে তাদের সম্ভবত এভাবেই 'পারফর্ম' করতে বলা হয়। আর পাল্লা দিয়ে এমনটা করতে গিয়ে জেলেগেটে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে কী? বিচার ও দণ্ড কার্যকরের ঘটনা তো উৎসব নয়। একাধিক পরিবারের দু'তিনটি শিশুর খবর জানি--টিভি পর্দায় এসব হতে দেখে যারা বড়দের কাছ থেকে সদুত্তর পায়নি যে, দু'জন মানুষকে কেন এমন উৎসব করে মারতে হবে!

আবারও বলছি এবং পরিষ্কার করে বলছি, বিচার কার্যক্রম চলবে; ফাঁসি হলে হবে। তার প্রয়োজনীয় সমস্ত খবর পাঠক ও দর্শকদের জানাতে হবে। তথ্য, খবর, এমনকি খবরের বিশ্লেষণ থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু সেটা কি এভাবে? সমস্ত কিছু সরাসরি সম্প্রচার করা যায় কি? আদালত কক্ষের ভেতরে তো ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ করা যায় না এবং সেটা বিশ্বজুড়ে রীতি। অথচ আমরা চাইছি ফাঁসির দৃশ্যটাও ধারণ বা সরাসরি প্রচার করতে! ফাঁসির সময় যাদের বাধ্যতামূলকভাবে ওখানে হাজির থাকতে হয়, তাদের কাছ থেকে শুনে সেসব বর্ণনার ক্ষেত্রেও সংযত ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজন রয়েছে।

একটি জাতির রুচি, বিচারবোধ ও মানস গঠনে মিডিয়ার ভূমিকা বিস্মৃত হওয়া চলে না। এমন হৈ-হট্টগোলের মধ্যেও কিছু মিডিয়াকে তেমন ভূমিকা পালনে যে উৎসাহী দেখা যায়নি, তা অবশ্য নয়। এদের দেখে কিছুটা হলেও আশা জাগে। কোনও কোনও মিডিয়া অবশ্য রাজনৈতিক মনোভাব বা পক্ষপাত থেকেই সংযত ভূমিকায় ছিল বলে মনে হয়েছে। জানি না, বিপরীত ক্ষেত্রে তারা কী করতেন। আমাদের এ সমস্যা তো রয়েছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালও নির্দিষ্ট এ ক্ষেত্রটিতে নির্দেশনা দিতে পারে মিডিয়াকে। তবে ভালো বিকল্প হলো নিজেরাই অভিজ্ঞতা থেকে শেখা ও সম্মিলিতভাবে এ জাতীয় খবর প্রচারের একটা গাইডলাইন তৈরি করা। প্রশাসন থেকে সময়মতো প্রয়োজনীয় তথ্য জোগানোর ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা ভাব থাকলে সে বিষয়েও স্মার্টনেস দাবি করা। মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা সম্ভবত আরও ঘটবে। তখন আমরা যেন ভিন্ন আচরণ করে প্রয়োজনীয় সব খবর মানুষকে দিই বা দিতে পারি।

তেমন অবস্থান নিতে পারলে প্রথমত রাজনৈতিক অঙ্গন এবং শেষত জনগণের মধ্যে এর একটা প্রভাব পড়বে। বিভক্ত জনমতের এ দেশটায় একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়েও নানা রকম ভিন্নমত রয়েছে। আন্তর্জাতিক, এমনকি পশ্চিমা মহলেও এর এক ধরনের বিরোধিতা থাকায় দেশে ওইসব মত কিছুটা হলেও হয়ে উঠেছে শক্তিশালী। এ প্রশ্নে দোদুল্যমান জনগোষ্ঠীও রয়েছে। আর কিছু না থাকুক-- একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য যাদের ফাঁসি হচ্ছে, তাদের স্বজন আর বন্ধুরা তো রয়েছেন। এরা নিশ্চয়ই সে রকম কোনও অপরাধ করেননি। তদের আরও ব্যথিত ও বেদনার্ত করে, এমনভাবে কিছু করা অন্তত মিডিয়ার কোনও অংশ থেকে কাম্য নয়।

রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এটা ভুল কাজ। কেননা এতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও তার অনুসারীরা লাভ করছে এক ধরনের সহানুভূতি।

বিচার ও প্রতিশোধ যে এক নয়, সেটা বুঝলে আর মানলেই কিন্তু সব স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা।

২৪ নভেম্বর, ২০১৫

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
নারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
জরিপের তথ্যনারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ