X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারি গাড়িতে পতাকা-স্ট্যান্ড থাকার প্রয়োজন কতটুকু?

সাকিব রহমান
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:৫৩আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:৫৩

সাকিব রহমান
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেটশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ঠিক পরবর্তী সময়ে আমি আমার গাড়ির সামনে ও পেছনে ‘অ্যাডভোকেট’ লেখাযুক্ত স্টিকার ব্যবহার করতাম। যাহোক, ২০১৬ সালের মে মাসে আমরা ঢাকা মহানগর পুলিশ কর্তৃক অবহিত হলাম যে অপরাধীরা পুলিশি অনুসন্ধান ও তদন্ত এড়ানোর জন্যে এ ধরনের পেশার নামযুক্ত স্টিকার অহরহ ব্যবহার করছে।  

অতঃপর পুলিশ কমিশনার এ ধরনের ‘অননুমোদিত লেবেল’ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করে সংবাদ সম্মেলনে বললেন, গাড়িতে গাড়িতে কেন এ ধরনের পুলিশ, সাংবাদিক বা আইনজীবী লেখাযুক্ত অতিরিক্ত স্টিকার ব্যবহৃত হবে? আমরা সকলেই সমভাবে ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং তা মানতে বাধ্য। এ ধরনের স্টিকার ব্যবহারের কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই।  

দৃশ্যত মনে হচ্ছিল যে, নির্দেশনাটি বাস্তবিকই অনুসরণ করা হচ্ছে এবং আমিও আমার নিজস্ব গাড়ি থেকে ‘অ্যাডভোকেট’ লেখাযুক্ত স্টিকার সরিয়ে ফেললাম। সত্যি বলতে পুলিশের পক্ষ থেকে এ ধরনের নির্দেশনাকে ব্যক্তিগতভাবে ‘হাস্যকর’ মনে হয়েছিল, কারণ কার্যত পুলিশকে কারও গাড়ি থামানো, তদন্ত ও পুলিশি অনুসন্ধান করা থেকে বিরত রাখার ক্ষমতা থাকা উচিত নয়! আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে যখন, যেখানে, যে গাড়িতেই প্রয়োজন অনুভব করবে সে গাড়িই থামাবে এবং তদন্ত-অনুসন্ধান করবে।

যদিও এ ধরনের নির্দেশনা আইনজীবী ও সাংবাদিকদের তাদের ‘জাহির করা মনোভাব’ থেকে বিরত রাখতে পেরেছিল কিন্তু সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের যানবাহনগুলোর ওপর সত্যিই কি এই নির্দেশনা কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল?

যদি এ কথা ধরেও নেওয়া হয় যে, সরকারি যানবাহনগুলোতে এখন আর কেউ স্টিকার ব্যবহার করে না, তবু আমি হলফ করে বলতে পারি যে তাদের বেশিরভাগের গাড়িতেই যে পতাকা-স্ট্যান্ড রয়েছে তার চেয়ে ভালো ‘লেবেল’ আর কোনও কিছুই হতে পারে না।

উল্লেখ্য, ডিএমপি এটাও বলেছিল যে সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত লেবেলগুলো গ্রহণ করা হবে।

সুনির্দিষ্ট একটি জাতীয় দৈনিকে এমন একটি উৎসাহব্যঞ্জক খবর এসেছিল যে, মন্ত্রিসভা দ্রুতই একটি গাইডলাইন তৈরি করতে যাচ্ছে এবং যখন এটি অনুমোদন পাবে সরকারি কর্মকর্তারা তাদের যানবাহনে পতাকা-স্ট্যান্ড, স্টিকার, মনোগ্রাম ও বিশেষ ধরনের সাইরেন ব্যবহারের পূর্বে অনুমতি নিতে বাধ্য থাকবে, যদিও খবরটির যথার্থতা পর্যাপ্ত ছিল না।  

নির্বিশেষে, এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়াটা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, বিভিন্ন অপরাধী বা সন্ত্রাসী তাদের যানবাহনে এ ধরনের পতাকা-স্ট্যান্ড ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত করছে বলে আমরা অহরহই জানতে পাই।

এই পতাকা-স্ট্যান্ডের অপব্যবহার নিমিত্তে সংঘটিত বহু অপরাধের কেস ফাইলও হয়েছে।  

আইন কী বলে?

পতাকা ব্যবহারের বিষয়ে বাংলাদেশের বিধিবিধানসমূহ সম্পূর্ণ পরিষ্কার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২-এর বিধি ৪-এর ১ অনুসারে, মোট ৪টি দিবস এবং উপলক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি ভবনসমূহে এবং বিদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনের অফিস ও কনস্যুলার পোস্টসমূহে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হবে। যথা– (ক) মহানবী (সা.)-এর জন্ম দিবস (ঈদে মিলাদুন্নবী); (খ) ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস; (গ) ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস; (ঘ) সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যেকোনও দিবস।

বছরের অন্য সকল দিনের ক্ষেত্রে, বিধি ৬-এর ৩ অনুসারে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী তাঁদের মোটরযান, জলযান এবং উড়োজাহাজে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ উত্তোলন করার অধিকারী হবেন। এবং ৬(৪) অনুসারে, মোট ৮ শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ তাদের মোটর গাড়ি ও জলযানে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ উত্তোলন করার অধিকারী হইবেন। যথা, (ক) জাতীয় সংসদের স্পিকার; (খ) বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি; (গ) মন্ত্রীবর্গ; (ঘ) চিফ হুইপ; (ঙ) জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার; (চ) জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা (ছ) মন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ; (জ) বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক/কনস্যুলার/মিশনসমূহের প্রধানগণ।

এবং সর্বশেষ বিধি ৬(৫) অনুসারে প্রতিমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ, উপমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ রাজধানীর বাইরে দেশের অভ্যন্তরে অথবা বিদেশে ভ্রমণকালীন তাদের মোটরযান এবং জলযানে ‘বাংলাদেশের পতাকা’ উত্তোলনের অধিকারী হবেন।

উল্লেখ্য, কেবল সংশ্লিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তিগণ মোটরযান বা জলযানে অবস্থানকালে ‘পতাকা’ উত্তোলনের অধিকারী হবেন।

একটি সতর্কবার্তা: উপরোক্ত আইন ও বিষয়সমূহ বিবেচনায় কেবল মুষ্টিমেয় কিছু প্রজাতন্ত্রের আমলা-কর্মকর্তাই প্রকৃতপক্ষে জাতীয় পতাকা ব্যবহারের অধিকার রাখেন, কিন্তু বাস্তবে সরকারি ইস্যুকৃত প্রায় সবগুলো যানই পতাকা-স্ট্যান্ড ব্যবহার করছে, যার কোনও আইনি বৈধতা ও বাস্তবিক প্রয়োজনীয়তা নেই।

উদাহরণস্বরূপ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের বিআরটিসি, বিআরটিএ, সড়ক ও জনপদ বিভাগসহ মোট ৫টি বিভাগ রয়েছে।

যেখানে আসলে শুধু মন্ত্রীর ব্যবহৃত বাহনটি ব্যতীত অন্য কারও বাহনে পতাকা-স্ট্যান্ড ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা বা যৌক্তিকতা, কোনোটিই নেই। এমনকি সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ‘সচিব’-এর গাড়িটির ক্ষেত্রও।

সম্ভাবনা কম থাকলেও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে হয়তো জরুরি ভিত্তিতে একজন মন্ত্রীকে তার অধীনস্থের গাড়িতে উঠতে হচ্ছে, সেক্ষেত্রেও কার্যতপক্ষে পতাকা ওঠানোর প্রয়োজনীয়তা কম।

কেন সব সরকারি যানবাহনকেই ভিআইপি দেখাতে হবে? একমাত্র কারণটি সম্ভবত, নিজের ‘রাজকীয় অবস্থান’ সম্বন্ধে অন্যদের ‘নগণ্য জ্ঞান’ করে জানান দেওয়া।

সরকারি যানবাহন কর্তৃক ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা সম্বন্ধে যথেষ্ট লেখালেখি রয়েছে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, এ ধরনের যানবাহনগুলোতে যদি অযথা এই পতাকার সংযুক্তকরণ এখনই রোধ করা না হয়, তাহলে সরকারি কর্মচারী ও তাদের যান চালকেরা সাধারণ নাগরিকদের নগণ্যজ্ঞান করে তাদের সাথে অনেক সময় যে খারাপ ব্যবহার করে তা থেকে বিরত থাকবে এবং অন্য সকল সাধারণ নাগরিকের মতোই তারা ট্রাফিক আইন-কানুন মেনে চলবেন।

সরকারি যানবাহনে বিদ্যমান এসব অপ্রয়োজনীয় পতাকা-স্ট্যান্ড সরিয়ে ফেলাটা এই মুহূর্তে খুবই দরকার।

এ ধরনের পতাকা-স্ট্যান্ড ব্যবহারে রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের অসম্মান বোধ করার সম্ভাবনা তৈরি করে। একজন করদাতা হিসেবে এ ধরনের অসমতা বা অন্যায্যতা নিশ্চয়ই আমাদের কাম্য নয়।

লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ