X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রূপান্তরিত নারীদের পেছনে ফেলে আন্তর্জাতিক নারী দিবস নয়

শারমিন আকতার
০৮ মার্চ ২০২১, ১৬:৪৪আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২১, ১৬:৪৪

শারমিন আকতার ‘হিজড়া’ বা ট্রান্সজেন্ডার শব্দটির সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। তবে এই হিজড়া সম্প্রদায়ের মধ্যেও যে লিঙ্গ বিভাজন রয়েছে সে বিষয়ে খুব কমই সচেতনতা লক্ষ করা যায়। হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার মূলত একটি বিস্তৃত প্রত্যয়, যেটি যেসব ব্যক্তির জন্মগতভাবে নির্ধারিত লিঙ্গ তাদের লিঙ্গীয় পরিচয় হতে আলাদা তাদের সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে। ট্রান্স নারী, পুরুষ ও আন্তলিঙ্গীয় সক ব্যক্তিই এর আওতায় পড়েন। অন্যদিকে ট্রান্স নারীরা হলেন শুধু তারাই, যারা পুরুষ দেহ নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও একটি নির্দিষ্ট সময় পর তাদের মধ্যে নারী বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে থাকে এবং তারা নিজেদের সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নারী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাদের কি বলে সম্বোধন করা হবে, সেটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে একটি বিতর্ক রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যদিও তাদের হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার নারী বলেই সম্বোধন করা হয়, তবে ট্রান্সসেক্সুয়াল শব্দটিই এক্ষেত্রে অধিক প্রযোজ্য। আর বাংলা ভাষায় তাদের ‘রূপান্তরিত নারী’ বলে সম্বোধন করাটাই অধিক শ্রেয়।

বাংলাদেশে এই রূপান্তরিত নারীর সংখ্যা কত সেটি নিয়েও নিদিষ্ট কোনও পরিসংখ্যান নেই। কেননা, সর্বশেষ আদমশুমারিতেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সমাজকল্যাণ অধিদফতরের ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত হিজরা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ হাজার। তবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর হিসাবে এটি কয়েক লাখেরও বেশি। যাদের প্রায় সকলেই জন্মগতভাবে পুরুষ থাকলেও পরে নারী বলে চিহ্নিত হন। তাহলে সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.০০৬ শতাংশ রূপান্তরিত নারী। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহ থেকে শুরু করে বাজেট কোনও কিছুতেই অনুপাতে ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠীর অবস্থান লক্ষণীয় নয়। এমনকি আন্তর্জাতিক নারী দিবসেও যখন বিশ্বজুড়ে সমতার জন্য নারীদের সংগ্রাম ও বিভিন্ন অঙ্গনে তাদের সাফল্য তুলে ধরা হয়, তখনও রূপান্তরিত নারীদের কথা খুব কমই উঠে আসে। পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন এই নারীরা সব বিষয়ের পাশাপাশি এক্ষেত্রেও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার কারণেই মূলত স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে এই জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ব্যাহত হচ্ছে। কারণ, এর ফলে তারা তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন এবং রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত রূপান্তরিত নারীদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে, তারা সর্বপ্রথম তাদের পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন, যদিও এ বিষয়ে দেশে এখন পর্যন্ত কোনও গবেষণা হয়নি।

তবে রূপান্তরিত নারীদের প্রতি সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফলই হচ্ছে পারিবারিক এই বিচ্ছিন্নতা। ছোটবেলা থেকে পুরুষ হিসেবে বিবেচিত পরিবারের একজন সদস্যের মাঝে যখন নারী বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাওয়া শুরু করে তখন সমাজে তার পরিচয় নিয়ে পরিবারকে এক ধরনের বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই তাকে নিয়ে উপহাস ও তাচ্ছিল্য করা হয়। ফলে একটা সময় পরিবারও তাদের বোঝা বা দায় মনে করে। এই দায় থেকে মুক্তি পেতে পরিবার তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

দেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে রূপান্তরিত নারীদের উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোতে তাদের জন্য কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হলেও পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কোনও উদ্যোগ ছিল না। যেমন- ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে সমাজকল্যাণ অধিদফতরের আওতায় পরিচালিত ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’-র মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা, ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের জনপ্রতি মাসিক বিশেষ ভাতা প্রদান, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম হিজড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে তাদের সমাজের মূল স্রোতধারায় আনয়ন ও প্রশিক্ষণোত্তর আর্থিক সহায়তা প্রদান। সম্প্রতি আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হলেও এটি তাদের পারিবারিক বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কমাতে খুব সামান্যই অবদান রাখবে। সরকারি প্রকল্পের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওগুলোও শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরিবার যদি তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে তাহলে এসব প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে না।

ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত সামাজিক গবেষণাগুলোতেও দেখা যায় তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে পারিবারিক সমর্থন সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ফুলার ও রিগস-এর (Fuller and Riggs) একটি গবেষণায় দেখা যায়, পারিবারিক সমর্থনপ্রাপ্ত ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের মাঝে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়ার হার পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এছাড়াও কানাডিয়ান ইনস্টিটিউটস অব হেলথ রিসার্চ পরিচালিত ট্রান্স পালস প্রকল্পটির প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, পরিবার থেকে সমর্থনপ্রাপ্ত ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর ৭৮ শতাংশই তাদের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট। অপরদিকে পরিবার থেকে সমর্থন না পাওয়াদের মাঝে এই হার মাত্র ১৫ শতাংশ। স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও পারিবারিক সমর্থন পাওয়া ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় এই প্রতিবেদনে। সমর্থনপ্রাপ্তদের ৬৬ শতাংশ ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও মাত্র ৩১ শতাংশ সমর্থন না পাওয়া ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি তাদের স্বাস্থ্য ভালো বলে জানান। বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর মাঝে এই হার কেমন সেটি জানতে এবিষয়ে সামাজিক গবেষণা করা প্রয়োজন।

সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকজন রূপান্তরিত নারী তাদের অর্জনের মাধ্যমে আলোচনায় উঠে এসেছেন। এদের মাঝে বাংলাদেশের প্রথম রূপান্তরিত নারী সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে তাসনুভা শিশির আনান, নার্স হোচিমিন ইসলাম ও ট্রান্সজেন্ডারদের সংগঠন 'সম্পর্কের নয়া সেতু'-র সভাপতি জয়া সিকদারের নাম উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে দেশের সব নারীর পাশাপাশি এসব রূপান্তরিত নারীর অর্জনচিত্র বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হলে পরিবার ও সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। সঠিক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যে এসব নারী লিঙ্গ নির্ধারণজনিত জটিলতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন, এ বিষয়ে পরিবারগুলোর মাঝে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। দেশে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হলেও এর প্রচার খুবই কম। ফলে নামমাত্র মূল্যে বা বিনা মূল্যে চিকিৎসার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ২০১০-২০১৩ এই চার বছরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাত্র ১৮টি অস্ত্রোপচার হয়। তাই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিবারগুলোর মাঝে লিঙ্গ নির্ধারণজনিত জটিলতার চিকিৎসার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ধরনের জটিলতা প্রকাশ পাবার পরপরই তারা যাতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন সে বিষয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশের গণমাধ্যমগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমেও রূপান্তরিত নারীদের পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা রোধ করা যেতে পারে। ধর্মীয় স্কলার, আলেম ও ইমামরা তাদের আলোচনায় এসব বিষয় তুলে ধরতে পারেন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে গৃহীত প্রকল্পসমূহে তাদের পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা রোধে নির্দিষ্ট কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলেই তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছেও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

লেখক: গবেষক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট।
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ