X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

করোনাকালীন শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি

মোস্তফা মোরশেদ
১৬ জুলাই ২০২১, ১৫:৫৮আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২১, ১৫:০০
মোস্তফা মোরশেদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দিয়ে শুরু করতে চাই। তিনি করোনাভাইরাসের অতিমারির এ সময়ে শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে বারণ করেছেন। একজন অভিভাবক হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে একমত পোষণ করছি। যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় তবে কয়জন অভিভাবক তার ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাবেন সেটি নিয়ে একটি জরিপ হতে পারে। আমি অন্তত প্রাথমিক ও নিম্ন-মাধ্যমিক স্কুলগামী আমার দুই ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে আরও কী কী চ্যালেঞ্জ নতুন করে যোগ হয়েছে সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই আজকের এ লেখা। করোনাকালীন শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার চারটি স্তরে ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ লক্ষণীয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্লাস না হওয়ার কারণে বাচ্চাদের জীবনের প্রথম স্তরে যে বুনিয়াদ গড়ে ওঠার কথা সেটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জানতে হবে, প্রাথমিক স্তরই একজন শিক্ষার্থীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দালানের ভিত্তি যত মজবুত হবে দালান তত উঁচুতে উঠতে পারবে। এছাড়া প্রাথমিক স্তরে ভর্তি ও ঝরে পড়ার সমস্যা তো রয়েছেই। প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী এখন ভর্তির অপেক্ষায়।

প্রাথমিকের মতো নিম্ন-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়েও ক্লাস ও পরীক্ষা না হওয়ার সমস্যা রয়েছে। তবে এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ের সমস্যা ভিন্নতর এবং অবশ্যই গুরুতর। পরীক্ষা নেওয়ার কোনও সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অটো পাসই একমাত্র ত্রাতা হিসেবে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অটো পাসের সুযোগ নেই। তাই শিক্ষার অ্যাকাডেমিক সময় বেড়ে গিয়ে সেশনজট তৈরি হয়েছে। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা অন্তত বিগত বছর থেকে এ অবধি ১৬ মাস পিছিয়ে আছে। ফলশ্রুতিতে, তাদের কর্মজীবনে প্রবেশ করা বিলম্বিত হয়ে পড়েছে।

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত অটো পাস হবে নাকি পরীক্ষা নিতে হবে– এ নিয়ে কার্যত সিদ্ধান্তে আসা খুবই কঠিন। বেঁচে থাকার গুরুত্ব বিবেচনায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সরকারের নেওয়া অটো পাস করিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক। এর দুটি কারণ রয়েছে– ক) স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করে সবার জন্য পরীক্ষা গ্রহণ করা অসম্ভব, এবং খ) যেকোনও পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করলে দেশের একটি বড় অংশের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হতে পারে।

আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো পরীক্ষা পদ্ধতি। আর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এ সময়ে কী পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে সেটি সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। আজকের এ আলোচনাটি দু’ভাবে করতে চাই।

প্রথমত, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ও দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়। উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির অনেক দুর্বলতা রয়েছে। পরীক্ষার প্রশ্নের যে মান তা ‘উন্নত বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে যথেষ্ট নয়।

পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত এ বিপদ থেকে উত্তরণের সমাধান কী? তিনটি বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।

এক) আগামী দিনে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তখন শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষা বছর ও সিলেবাস কমিয়ে ফেলা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণি মিলে এক বছর কিংবা করোনাভাইরাসের এ আপদ আরও দেরিতে বিদায় নিলে হয়তো তিন ক্লাস মিলে এক বছর করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে শিক্ষা বছর ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ার বিষয়টি মাথায় নিয়ে কৌশল ঠিক করা যায়।

দুই) সব শিক্ষার্থীর জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বর্তমানে পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে শুধু এমসিকিউ (MCQ) পদ্ধতি বিবেচনা করা যায়, যাতে শিক্ষার্থীরা অল্প সময়ে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। সব শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারলে শুধু এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। বিষয় ও বিষয়ের সিলেবাস উভয়েই কমিয়ে একটি যৌক্তিক জায়গায় পৌঁছানো যেতে পারে। তবে এখানে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো প্রশ্ন তৈরি করা। খুব গতানুগতিক ও প্রচলিত ধারার প্রশ্ন হলে তা সত্যিকার অর্থে কোনও কাজে আসবে না। এক্ষেত্রে পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি সংক্রান্ত একটি উচ্চ পর্যায়ের ‘বিশেষজ্ঞ প্যানেল’ তৈরি করে নেওয়া যায়। অভিজ্ঞতা থেকে লিখছি, আমি ২০১০ সালে ইউনিভার্সিটি অব এসেক্স থেকে ফলিত অর্থনীতিতে মাস্টার্স শেষ করি। ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মডিউলের প্রশ্ন আপলোড করা ছিল যাতে পরীক্ষা পদ্ধতি ও প্রশ্ন নিয়ে একটি ধারণা পাওয়া যেত। বিশ্বাস করুন, সেখানে কোনও একটি প্রশ্নেরও পুনরাবৃত্তি পাওয়া যায়নি এবং না বুঝে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এ দু’টি বিষয় অনেকাংশেই অনুপস্থিত।

তিন) পরীক্ষা গ্রহণ করার মতো অবস্থায় না পৌঁছাতে পারলে ষষ্ঠ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত কেন্দ্রীয়ভাবে অ্যাসাইনমেন্টের প্রশ্ন তৈরি ও সংশ্লিষ্ট স্কুলের মাধ্যমে তা মূল্যায়ন করা যেতে পারে। গত ২০২০ সালে এ পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে। তবে পূর্বে বর্ণিত এমসিকিউ পদ্ধতির মতো অ্যাসাইনমেন্টের প্রশ্ন তৈরির বিষয়টিও খুব দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে। বোধকরি, এ তিনটি সমাধানের বাইরে আসলে যথেষ্ট বিকল্প নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনের আওতায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আসতে হবে। এ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আসলে অটো পাসের সুযোগ করে দেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা নেই। ভাবুন তো, মেডিক্যালে পড়া কোনও শিক্ষার্থীকে অটো পাসের সুযোগ করে দিলে আগামী দিনে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কী হাল হতে পারে! প্রয়োজনের নিরিখে শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষা বছর ও সিলেবাস কমিয়ে ফেলে আবশ্যক পরীক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং শিক্ষা বছর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা না করলেও হবে বলে প্রতীয়মান।

ডিজিটাল ব্যবস্থার দুটি দিক আলোচনা করা দরকার। ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণে একজন শিক্ষার্থীর ন্যূনতম একটি আধুনিক মোবাইল সেট ও ইন্টারনেট সংযোগ লাগবে। দেশের একটি বড় অংশের শিক্ষার্থীদের হাতে ডিজিটাল ডিভাইস নেই যা প্রকারান্তরে আয় বৈষম্যের ফল। এক পরিসংখ্যান বলছে, শতকরা ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর বাড়িতে এ সুবিধা নেই। ফলে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একটি প্রোগ্রেসিভ আয়কর বসিয়ে কিংবা ভর্তুকি দিয়ে এ বৈষম্য নিরসনে এগিয়ে আসা যেতে পারে।

অন্যদিকে, ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে যেসব পরিবারে শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে তাদের সন্তানরা নেট দুনিয়ার ‘নতুন গ্রাহক’ হিসেবে কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন সেটি নিয়ে অভিভাবকরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। আগামী দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে তাদের কাছ থেকে এ মোবাইল ও নেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে কিনা সেটি একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।

এ কথা অনস্বীকার্য, ডিজিটাল পদ্ধতির সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে শিক্ষা বিস্তারে বৈষম্য সৃষ্টি। যেসব শিক্ষার্থী, যারা গত দু’বছর ধরে শিক্ষাদান কার্যক্রমের আওতায় রয়েছেন তারা আগামী দিনে অন্যদের চেয়ে অনেকাংশে এগিয়ে যাবেন। যেসব পরিবার তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে তাদের সন্তানদের পাঠদান কার্যক্রমে সম্পৃক্ত রাখতে পেরেছে শিক্ষা জীবনে তারা অন্যদের চেয়ে নিঃসন্দেহে ভালো করবে। তবে ডিজিটাল ডিভাইস থাকা সত্ত্বেও শুধু পারিবারিক মনিটরিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রেও অসঙ্গতি তৈরি হতে দেখা যায়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠগ্রহণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকা সত্ত্বেও কার্যত অনেক শিক্ষার্থীর কোনও উপকার হয়নি।

একটি বিষয় সত্য যে, অনেকেই করোনাকালীন বিগত দিনগুলোতে লেখাপড়া থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। কারণ, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগী হওয়ার মানসিকতা নেই। কিংবা পরিবার থেকে যথেষ্ট সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। এর বাইরেও কারণ থাকতে পারে। তবে যাদের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কম তাদের এবং তাদের অভিভাবকদের একটি বিষয় খুব মনোযোগ দিয়ে জানতে হবে যে একদল শিক্ষার্থী ঠিকই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে, যা আগামী দিনে ডিজিটাল ডিভাইসের অপ্রতুলতাজনিত বৈষম্যের পাশাপাশি লেখাপড়ায়ও বৈষম্য সৃষ্টি করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে সমাধান আছে কি?

সমাধান হিসেবে শুধু এটুকু বলতে চাই, নিম্ন-মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত যারা একেবারেই লেখাপড়া থেকে দূরে আছেন তারা অন্তত গণিত বইটি ঠিকমতো বুঝে শেষ করে রাখতে পারেন। গণিতের আবশ্যক পাঠ আগামী দিনে পিছিয়ে পড়া থেকে অনেকাংশে রক্ষা করবে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তার অংশ হিসেবে এ দায়িত্ব অভিভাবকদেরই পালন করতে হবে।

সার্বিক বিবেচনায় সরকারের গরিব ও দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে প্রয়াস তার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে অধিক আর্থিক বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলার আদলে গঠিত ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নে আগামী কয়েক বছরের বাজেটের প্রতিফলন দেখা খুবই জরুরি। দীর্ঘ সময় ধরে উত্থাপিত দাবি অনুসারে শিক্ষা খাতে বাজেটে বরাদ্দ জিডিপির ৬ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতি বিবেচনায় হয়তো এটিই সবচেয়ে ভালো সময়। প্রয়োজনে সমাজের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য সরকারের মাধ্যমে একটি ফান্ড গঠন করা যায়, যেখানে বিত্তশালী ও ধনী শ্রেণির মানুষ আর্থিকভাবে অবদান রাখতে পারেন। দেশ ও জাতির সার্বিক মঙ্গলের জন্য করোনাভাইরাসের এ অতিমারির হাত থেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সবাই মিলেই জয় করতে হবে।

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ