X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে যেখানে

জোবাইদা নাসরীন
১১ আগস্ট ২০২১, ১৭:৪৮আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২১, ১৭:৪৮

জোবাইদা নাসরীন বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমগুলো যখন পরীমণি ইস্যুতে চূড়ান্ত ধরনের উত্তেজনা এবং গরম গরম খবর পরিবেশনে ব্যস্ত, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চলছে পরীমণির পক্ষ-বিপক্ষ যুদ্ধ, তখন খুলনার রূপসা উপজেলার শিয়ালী গ্রামে চলছিল আরেক ধরনের উত্তপ্ত অবস্থা এবং সেখানে ঘটেছে সাম্প্রদায়িক হামলা। অথচ সেখানেই আমাদের মনোযোগ যাওয়া দরকার ছিল আরও বেশি।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গত শনিবার (৭ আগস্ট) খুলনার রূপসা উপজেলার শিয়ালী গ্রামে চারটি মন্দিরের ১০টি প্রতিমা, ছয়টি দোকান এবং দুটি হিন্দু বাড়িতে হামলা করা হয়েছে। ভাঙচুরকারী এবং হামলাকারীরা সেই গ্রামের মন্দিরগুলোর সব প্রতিমা এবং শ্মশানে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ ভেঙে দেয়। সেখানেই তারা নিজেদের ক্ষান্ত রাখেনি। জানা যায়, এরপর তারা শিয়ালী গ্রামেরই পূর্বপাড়া এলাকায় হামলা চালিয়েছে। সেখানকার হরি মন্দির, শিয়ালী পূর্বপাড়া দুর্গা মন্দির এবং শিবপদ ধরের গোবিন্দ মন্দিরের সব প্রতিমাই ভাঙচুর এবং নষ্ট করে। এতসব করেও ক্ষোভ মিটেনি হামলাকারীদের। এরপর তারা বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়িতে হামলা চালায়। তারা শিবপদ ধরের বাড়িতে হামলা চালায়। ব্যবসায়ী বলাই মল্লিকের দোকান ও বাড়িতে হামলা চালানো হয়। হামলা থেকে রেহাই পায়নি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অনির্বাণ হীরাও। তার চায়ের দোকানটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে।

এই হামলায় প্রীতম মজুমদারের মেশিনারিজের দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গণেশ মল্লিকের ওষুধের দোকানটিও এই হামলার টার্গেট হয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রীবাস মল্লিকের এবং সৌরভ মল্লিকের মুদি দোকানও রক্ষা করা যায়নি হামলাকারীদের তাণ্ডব থেকে।

কেন বলছি এ ধরনের ঘটনায় আমাদের যথাযথ মনোযোগ নেই, ছিল না। বড়সড় ঘটনা না ঘটলে কেউই সেটিকে আমলে নেয় না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ঘটনার সূত্রপাত কিন্তু এই হামলার আগের দিন। অর্থাৎ ৬ আগস্ট রাতে শিয়ালী গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বী কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা নামকীর্ত্তন করতে করতে শিয়ালী শ্মশান মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন। তারা পথিমধ্যে শিয়ালী জামে মসজিদ এলাকায় পৌঁছান এবং সে সময় মসজিদে এশার নামাজ চলছিল। তখন সেই মসজিদের ইমাম বের হয়ে আসেন এবং তাদের নামাজের সময় বাদ্যযন্ত্র বন্ধ করতে বলেন। তখন এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মসজিদের মুসল্লি ও সেখানে উপস্থিত নাম কীর্তন করতে শ্মশান মন্দিরমুখী হিন্দুদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় এবং সেখান থেকে পরবর্তীতে সেটি সাম্প্রদায়িক হামলায় রূপ নেয়।

বিষয়টি হলো, এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে বেশ কিছু দিন পরপরই হয়, বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন জেলায়। এবং প্রায়শই এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখানোর জোর তাগাদা থাকে। কখনও ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে,কখনও আবার দেখা যায় পোস্টদাতার কোনও আস্তিত্বই নেই, অথবা যার আইডি থেকে পোস্টটি দেওয়া হয়েছে তিনি অসচ্ছল এবং নিরক্ষর মানুষ। ফেসবুক কী তিনি সেটিও জানেন না। কিন্তু এই বেশিরভাগ ‘ভুয়া’ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া স্ট্যাটাস কেন্দ্র করেই গত দশ বছরে এই দেশে সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক হামলা, বৌদ্ধ এবং হিন্দু মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, প্রতিটি ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকজনকে গ্রেফতার করলেও পরবর্তীতে তাদের কী ধরনের সাজা হয়েছে কিংবা আদৌ তারা সাজা পেয়েছে কিনা সেই বিষয়ে কোনও তথ্য জানা যায় না।

কেন এগুলো বারবার ঘটছে? এ ধরনের ঘটনার পেছনে উদ্দেশ্য কী? এতদিনে আমরা জেনে গেছি এর পেছনের রাজনৈতিক অর্থনীতি কী এবং কারা কেন করছে। খুলনার ঘটনাও এর ব্যতিক্রম নয়। তা না হলে দুই ধর্মাবলম্বীরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাসের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করছিল, সেখানে তো তর্কাতর্কি হলেও সেটির মীমাংসা সেখানেই হওয়ার কথা। কিন্তু সেটি গল গল করে এগিয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে অনেক দূর। উৎসাহ পেয়েছে হামলা পর্যন্ত। এর আগে ব্যবস্থা নিলে হয়তো পরের দিনের হামলা থামিয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু সেই ধরনের কোনও উদ্যোগের খবর আমরা পাইনি। এই অবহেলাই আসলে ত্বরান্বিত করেছে পরবর্তী দিনের হামলাকে।
এখন প্রশ্ন হলো, এ ধরনের হামলা কী কী বিষয়ে আমাদের জানান দেয়। প্রথম যে বিষয়টি ঘটে তা হলো এক ধরনের ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা এবং সেই ভয়টি আসলে তৈরি করা হয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের জন্য। মন্দির, প্রতিমা ভাঙচুর, শ্মশানের জিনিসপত্র তছনছ এবং ব্যক্তির বাড়ি এবং বিভিন্ন ধরনের দোকানপাটে হামলা স্পষ্টতই জানান দেয় সেই অঞ্চলে সংখ্যালঘুরা ভীত হয়ে থাকবেন। হয়তো অনেকেই ভয়ে সে অঞ্চল ছেড়ে চলে যাবেন। পরবর্তীতে সমস্যা আরও বেশি হবে এবং সেগুলো এড়ানোর জন্য অনেক প্রত্যক্ষদর্শী হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এ বিষয়টি নিয়ে আর কথা বলতে চাইবেন না বা কোথাও সাক্ষ্য দিতে যাবেন না। কারণ, তারা ভয় পায়, বড্ড ভয় পায়। তারা জানে এ দেশে তাদের টিকে থাকতে হলে ‘রয়ে সয়েই’ টিকে থাকত হবে। তাই যত চুপ করে থাকা যায় ততই মঙ্গল।

প্রশাসন কয়েকজনকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়েই হয়তো আপাত তাদের দায়িত্ব শেষ করে কিন্তু এর পরবর্তীতে সেখানকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানসহ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিরাপত্তার সঙ্গে করতে পারার যে অধিকার সেটি ভোগ করার ক্ষেত্রে কতটা তাদের পাশে দাঁড়ান বা দাঁড়াবেন সেই প্রশ্নটি থেকেই যায়। আর সেটি হয় না বলেই প্রতি বছরই কোনও না কোনও অজুহাতে প্রতিমা ভাঙচুরের হিড়িক পড়ে এবং দুর্গাপূজার কাছাকাছি সময়ে এটি কেন জানি প্রতি বছরই ঘটে। তাই বিচ্ছিন্ন ঘটনার আওয়াজ এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা কোনোভাবেই একটি দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার আদর্শকে উপস্থাপন করে না; বরং এ ধরনের হামলাকে উৎসাহিতই করে। তাই আমাদের মন এবং চোখের মনোযোগ এই বিষয়গুলোর ওপর জারি থাকা খুবই জরুরি।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীপুত্র ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীপুত্র ইলহাম!
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ