X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

তালেবান ফ্যাক্টর: ভারতে যেভাবে দেখা হচ্ছে

আশিষ বিশ্বাস
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:৪৭আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:৪৭

আশিষ বিশ্বাস অভিজ্ঞ বিশ্লেষকরা চরম জটিল ঘটনা সম্পর্কে যে বর্ণনা ব্যবহার করেন, আফগানিস্তানের নিত্য ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের পটভূমি সেটির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়: অনেক সময় ঐতিহাসিক ঘটনাবলির এত দ্রুত উত্থান-পতন ঘটে যে প্রায় তা বোধগম্যতা অস্বীকার করে!

এমনকি স্বাভাবিক সময়ে সংঘাতপূর্ণ সিরিয়া-ইরাক-আফগানিস্তান অঞ্চল নিয়ে রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী করা বিপজ্জনক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তবু, যখন তালেবান সরকার ক্ষমতায়, একটি নতুন ধারা ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ হচ্ছে, যার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর সৃষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে ন্যূনতম সামঞ্জস্য নেই।

বৃহৎ অর্থে এটা বলা যায় যে, সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে স্বল্প/মধ্য মেয়াদে চীন সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ঘটনার নেপথ্যে থেকে পাকিস্তান হয়তো কাবুলে তালেবান সরকারের ঘুঁটি নাড়ছে। কিন্তু তাদের এই আকস্মিক প্রভাব বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি বিভ্রমের মতো। চীন এই অঞ্চলের একমাত্র শক্তি, যাকে গোনায় ধরা হয় এবং পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করে চীন! যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার, ইউরোপীয় দেশগুলো এবং আইএমএফ/ বিশ্বব্যাংকের নতুন আফগান সরকারকে স্বীকৃতি/আর্থিক সহযোগিতা না দিতে একরোখা অবস্থানের ফলে নতুন শাসকদের মধ্য মেয়াদে টিকে থাকার একমাত্র আশা চীন। আজকের পরিস্থিতি বিবেচনায় এই মধ্য মেয়াদ অন্তত আগামী তিন/চার বছর হতে পারে।

আফগানদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, যা কট্টরপন্থী তালেবান নেতারাও প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন, তা হলো বড় অঙ্কের অর্থ এবং বিপুল পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। বেইজিংয়ের শাসকরা এই ঘাটতি মেটাতে নিশ্চিতভাবে উদ্যোগ নেওয়ার সামর্থ্য রাখে। এই পরিস্থিতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিড়ম্বনা হলো, যেখানে শয়তানরাও বাণিজ্যে ভয় পায় চীন সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়বে না, সতর্কভাবে পদক্ষেপ নেবে। স্বল্পমেয়াদে তালেবানের টিকে থাকার নিশ্চয়তা এবং চীন, ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, সিরিয়া, লিবিয়া কিংবা রাশিয়ার মতো দেশগুলোর কাছ থেকে ন্যূনতম স্বীকৃতি পেয়ে গেলে তারা পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মন জয় করতে আগ্রহী থাকবে না। কিংবা বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাগুলোর পরোয়া করবে না।

অন্যদিকে, নিজেদের মুক্ত বিবেচনা করে চরম রক্ষণশীল ইসলামিকরণের এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে যেতে তালেবানরা বিশ্বের মতামত নিয়েও ভাববে না।

অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক যারা আফগানিস্তানের ঘটনাবলি এবং কাশ্মির উপত্যকায় এর প্রভাব নিয়ে নিজেদের হতাশা গোপন রাখেননি, তারাও অস্বীকার করতে পারবেন না যে চীন এমন অবস্থায় রয়েছে, তারা কাবুল বা ইসলামাবাদের ‘শাসকদের’ জন্য মুলা ঝুলানোর নীতি গ্রহণ করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের চলে যাওয়াতে অঞ্চলটি চীনের পাতে তুলে দিয়েছে! ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কিছু মানুষের ধাপ্পাবাজি ও তর্জন-গর্জনকে পাত্তা না দেওয়া দিল্লিভিত্তিক ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতা এবং চীনকে মোকাবিলায় কোয়াডে যুক্ত হওয়ার ফলে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে নয়া দিল্লিকে রাজনৈতিকভাবে কানাগলিতে নিয়ে গেছে।

এখন পর্যন্ত ভারত চীনবিরোধী পদক্ষেপ থামানোর কোনও ইঙ্গিত দেয়নি। হোক তা উঁচু হিমালয় সীমান্ত কিংবা গভীর সমুদ্র। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকরা স্বীকার করুন বা না করুন, তাদের কিছু সময়ের জন্য চীনবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। মজার বিষয় হলো, অনাহূত এই সহিষ্ণুতাকে ভারত ও চীন উভয় পক্ষই নিজেদের জয় হিসেবে হাজির করতে পারবে।

চীনের নেতারা এখন আফগানিস্তানের দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে নিজেদের অনেক বেশি সক্রিয় করে ফেলার কারণে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চলে চলমান বিরোধ কিছুটা আড়ালে চলে যায়। তাই বড় ধরনের কোনও সমস্যা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। দিল্লির জন্যও এটি প্রযোজ্য। আফগানিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের পুরনো নীতি যখন ভারত গ্রহণ করেছিল তখন তারা সাময়িক জয় পেয়েছিল।

চীনের আর্থিক সহযোগিতার চড়া মূল্য দিতে হয়। অনেক সময় তা দ্রুতই সামনে আসে না। জিনজিয়াংয়ের উইঘুর ভিন্নমতাবলম্বীদের পরিস্থিতির নিশ্চিতভাবে উন্নতি হবে না। এই ক্ষেত্রে বেইজিং মস্কোর উদাহরণ অনুসরণ করতে পারে। রাশিয়া চেচেন/দাগেস্তান বিদ্রোহীদের প্রতি সহযোগিতা থামাতে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যাক-চ্যানেল কূটনীতি গড়ে তোলে। একই সঙ্গে তারা অঞ্চলটিকে কিছুমাত্রায় স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চর্চার ক্ষেত্রে তুরস্কের অনেক কাছাকাছি থাকা উইঘুরদের সহযোগিতা থামাতে আফগান ও আরবদের সঙ্গে এমনটি করার ক্ষেত্রে চীনের কোনও বাধা নেই।

এছাড়াও চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাস্তবায়নে সহায়তা দিতে আফগানিস্তানকে প্ররোচিত করতে পারে। খনিজ সম্পদ ও গ্যাস অনুসন্ধানের অধিকার এবং এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার অধিকারও পেতে পারে বেইজিং। আগে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো মিত্রদের নিয়ে এসব সম্পদ অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখালেও হঠাৎ করে তাদের পিছুটান পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে।

সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছে ভারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্যে রাশিয়ার প্রশংসা করেছেন। বিগত ৭০ বছরে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দীর্ঘ অবিচল সমর্থনের কারণেই মোদির এই প্রশংসা (মজার বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. সুব্রানিমানিয়াম সোয়ামি মনে করেন, মোদির আসলে উচিত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রশংসা করা, রাশিয়ার নয়। রাশিয়ার যাত্রা শুরু কেবল ১৯৯১ সালের পর!)। ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে গত কয়েক বছরে রাশিয়া ও পাকিস্তানের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে উষ্ণ হয়েছে, যা দিল্লির জন্য সতর্কতামূলক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে ‘কৌশলগত সহযোগী’র মর্যাদা দেওয়া আর ইন্দো-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর পশ্চিমের ওপর নির্ভরতা বাড়ায় দিল্লিভিত্তিক নীতিনির্ধারকদের সুনির্দিষ্ট পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। আশ্চর্যের কিছু নেই, কাশ্মির বিরোধ নিয়ে ভারতের প্রতি মস্কোর সমর্থন সম্প্রতি হালকা শব্দে নেমে এসেছে।

অন্যদিকে রাশিয়ার সরকারি টিভি চ্যানেল আরটি ডকুমেন্টারির মাধ্যমে ক্রমাগত ভারতীয় জীবনযাত্রার নেতিবাচক দিক তুলে ধরছে। ভারতের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত অবনতি, শিক্ষা বঞ্চিত দরিদ্র নারীদের দুর্ভোগ, ভারতের মেডিক্যাল অবকাঠামোর পিছনমুখিতা নিয়ে ডকুমেন্টারি প্রচার করছে আরটি। আর এসবই শুরু হয়েছে পাকিস্তান যখন রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কেনা এবং রুশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে কয়েকটি এলাকায় যৌথ মহড়া শুরু করেছে তারপর। পরিষ্কারভাবে, এসবের পর সব ক্ষেত্রেই কট্টরপন্থী নেতা পুতিনের মন জয় করা মোদির জন্য ধারণার চেয়েও কঠিন হবে।

ভারতের জন্য খানিক স্বস্তির কারণ হতে পারে এটা যে আফগান সংকট নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে কয়েকজন বিশ্বনেতার সঙ্গে ফোনালাপ করেছেন, তাদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদিও রয়েছেন। কোনও পাকিস্তানি নেতার সঙ্গে কথা বলেননি তিনি। পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে খারাপ হলো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন কংগ্রেস সদস্যদের বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াইয়ের সময়ও তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়নের কথা বলেছেন তিনি। অন্যভাবে বলা যাচ্ছে যে পশ্চিমা সামরিক এবং আর্থিক সহায়তা পাকিস্তান আর আগের মতো সহজে পাবে না।

কিন্তু এতে পাকিস্তান খুব বেশি অবাক হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গত কয়েক বছর ধরেই তিক্ত হচ্ছে।

দীর্ঘমেয়াদে চীন চূড়ান্ত গন্তব্য হয়ে উঠলে পাকিস্তান তাদের অবশিষ্ট সার্বভৌমত্বও হারিয়ে ফেলতে পারে। ইসলামাবাদের হাতে খুব বেশি বিকল্পও নেই, তাদের টিকে থাকা নির্ভর করে ভারতবিরোধিতার ওপর। আফগান মিলিট্যান্ট এবং জয়েশ-ই-মুহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈয়্যবা-এর মতো রাষ্ট্রহীন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর কাশ্মির অঞ্চলের রাজনীতিতে গভীর কামড় বসাতে আর দিল্লির সঙ্গে পুরনো বোঝাপড়া ঠিক করে নিতে বেশি দেরি করবে না ইসলামাবাদ।

ভারত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের পুরনো উষ্ণতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টার প্রস্তুতি নেওয়ার পরও তারা স্বল্পমেয়াদে আফগানিস্তান ইস্যুতে ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ নীতি নিয়েছে। বাংলাদেশের চেয়ে এ অবস্থান খুব আলাদা নয়। তবে একটা পার্থক্যও রয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতকে যতটা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, বাংলাদেশকে ততটা হবে না। কেননা, দেশটি অনেক বেশি স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির চর্চা করে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলকাতা

/জেজে/এএ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই জ্বালানি রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা জরুরি
ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই জ্বালানি রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা জরুরি
ফিরে দেখা: ১ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ১ জুলাই ২০২৪
এনবিআরের আন্দোলনে এক বন্দরে হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
এনবিআরের আন্দোলনে এক বন্দরে হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
টিভিতে আজকের খেলা (১ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (১ জুলাই, ২০২৫)
সর্বশেষসর্বাধিক