X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

আয়কর নথি করদাতার জন্য ভয়ের নয়, সম্মানের হোক

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন
২৯ নভেম্বর ২০২১, ০০:১৮আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০২১, ০০:১৮

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, মহামারি প্রতিরোধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, বেকার সমস্যা সমাধান, উৎপাদন স্থিতিশীল রেখে বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, দ্রব্যমূল্যের বাজার স্থিতিশীল রেখে নাগরিক অসন্তোষ রোধ করা, নতুন দারিদ্র্য রোধে উদ্যোক্তা তৈরিতে বিনিয়োগ, এসডিজি অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখা, ৮ম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, সরকারি পরিসেবাগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তর বা ডিজিটালাইজেশন করার উদ্যোগ নেওয়া, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রেখে প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহ করে স্থানীয় উন্নয়ন কাজে ব্যাপক অর্থ দরকার।  এসব খাতের উৎসের মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয়ই ভরসা। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সীমিত হয়ে আসছে। ফলে সরকারকে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যার ফলে রাজস্ব বৃদ্ধি করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি একটি ভারসাম্যমূলক কর নীতি বাস্তবায়ন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এজন্য সরকারকে নিতে হবে ভারসাম্যমূলক কৌশলগত পরিকল্পনা।

বর্তমানে আমাদের রাজস্ব আদায়ে ভ্যাটের পরই করের অবস্থান। যাকে আমরা প্রত্যক্ষ কর বলে থাকি। আরেকটি রাজস্ব খাত হলো শুল্ক। শুল্ক থেকে ব্যাপক রাজস্ব আদায় হতো। কিন্তু আন্তর্জাতিক বর্তমান পরিবর্তিত বাজার ব্যবস্থার কারণে শুল্কের হার কমে আসছে। ভবিষ্যতের দিনগুলোতে শুল্কের হার আরও কমবে। আন্তর্জাতিক ভারসাম্য বাজার নীতির কারণে শুল্ক হার কমানো সরকারের জন্য আবশ্যক দাঁড়াবে। তাই প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থার দিকে সরকারকে বেশি নজর দিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কর ব্যবস্থাপনার বা কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে গেলে একটি সময়োপযোগী আইনও দরকার হবে। এতে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। কতিপয় আমলানির্ভর আইন যেন বারবার না আসে, সেদিকে নজর দেওয়া সরকার ও নাগরিকদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইতোমধ্যে ওয়েবসাইটে খসড়া আয়কর আইন-২০২২ নামে একটি আইন প্রকাশ করেছে এবং মতামত চাওয়া হয়েছে। এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যতটুকু দেখেছি পুরনো আইনের বাংলা অনুবাদ ছাড়া অতিরিক্ত তেমন কিছু নেই। কর পেশাদার এবং অভিজ্ঞজনের সমন্বয়ে জাতীয় কমিটি করে পারস্পরিক সংলাপ করে বা মতামত নিয়ে কর আইন প্রস্তুত করা দরকার। যা সরকারের পাশাপাশি করদাতাকেও সুরক্ষা দেবে এবং নাগরিকদের উৎসাহিত করবে কর পরিশোধ করতে। সেখানে যেন ভয়ভীতির বা বেশি বেশি শাস্তি বা জরিমানার কথা বলা না থাকে। আইনে করদাতার সুরক্ষাই শুধু নয়, আইনটা এমন হতে হবে, যাতে আইন থেকে করদাতাগণ অভ্যস্ত হবে কর পরিশোধ করতে বা নিজ উদ্যোগে কর পরিশোধ করার প্রয়াস নেবেন। যেমন, বাসায় মেহমান এলে ভালোমন্দ খাবার ব্যবস্থার জন্য হোস্ট পরিবার আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করেন, ঠিক তেমনি আয় করলে সরকারকে ট্যাক্স দেওয়ার জন্য করদাতা আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবেন। এজন্য জনগণের খুব কাছে চলে যেতে হবে। আইন-কানুন, নির্দেশনাই শুধু নয়, জনগণকে সম্পৃক্ত করাই হবে বড় সফলতা। এটাই সু-কর প্রশাসনের লক্ষ্য হওয়া উচিত এবং আয়কর আইনের উদ্দেশ্য হওয়া দরকার। 

এ কথা সত্য, আমাদের জনসংখ্যার দিক দিয়ে প্রত্যক্ষ করদাতার সংখ্যা খুবই সীমিত। ২০১৯ সালের আয়কর সংক্রান্ত একটি জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশে মাত্র ১% মানুষ আয়কর দিচ্ছেন। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১% মানুষ আয়কর দিয়ে থাকেন। এ সংবাদ আমাদের জন্য সুখকর নয়। আমরা এ তথ্যকে নানা দিক থেকে ভেবে দেখতে পারি। যেমন, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের তুলনায় ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কর ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়ন কচ্ছপ গতিতে এগোচ্ছি। এর মানে হলো, যেভাবে আগানোর কথা তা হচ্ছে না। এর মূল কারণ হতে পারে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়নি বা ব্যক্তি হিসেবে আমি যেমন ছিলাম তেমন আছি, অথবা খুব বেশি আমাকে নিয়ে ভাবছি, অথবা রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব কী তা বুঝতে ভুলে গেছি। একইভাবে রাষ্ট্র আমাকে প্রতিপক্ষ ভেবে বসে আছে। রাষ্ট্র মনে করছে কর দেওয়া নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক, আইন আছে, না দিলে জরিমানাসহ দিতে হবে!

সুতরাং কর নাগরিকদের দিতেই হবে। এই দুই চিন্তার ফলাফলই হচ্ছে মোট জনসংখ্যার ১% করদাতা। অনেক করদাতার কর পরিশোধের জন্য উপযোগী, যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে। কিন্তু আয়কর অফিসে আসছেন না বা তার আইনজীবীর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলছেন না। কোথাও যেন একটা ভয় তার মধ্যে কাজ করছে। এর মানেই হলো একটা মেসেজ সে বহন করে বেড়াচ্ছে। আয়কর অফিসে হয়রানি করা হয়। আমাদের সমাজে মন্দ কথা বাতাসের আগে দৌড়ায়। হ্যাঁ, একেবারে যে হয়রানি হচ্ছে না তা আমি বলছি না। তবে যতটা প্রকাশ পাচ্ছে হয়তো বা ততটা নয়। কোনও কোনও কর অফিসে কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের দ্বারা নাজেহাল হয়েছেন, অনেকে এসে বলেছেন। আমিও মাঝে মাঝে তা লক্ষ করি। কিন্তু আমার কাছে এমনও উদাহরণ রয়েছে অত্যন্ত সম্মানের সাথে কথা বলেছেন এবং কর কমিশনার মহোদয় তাঁর কক্ষে ডেকে নিয়ে চা খাইয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, সমস্যাগুলো কোথায় তা শুনেছেন, ব্যবস্থাও নিয়েছেন। তাহলে ভালো দিকও আছে। তা আমরা প্রচার করি না, প্রচার করতে অভ্যস্ত নয়।

অফিসের যিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থাকবেন তাঁর অনেক দায়িত্ব আছে। বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে যতটুকু সেবা করা যায় সেটুকু যেন করদাতাগণ পেয়ে থাকেন, তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি অনেক কিছু করতে পারেন, এটা কঠিন কিছু নয়। কর্মচারীদের বোঝা দরকার জনগণের করের টাকায় তার বেতন হয়, তার পরিবার পরিজন খেয়ে-পরে ভালোভাবে বেঁচে থাকার একটা উপায় হয়েছে। সুতরাং করদাতাদের উন্নত সেবা না দিতে পারেন- অন্তত ভালো ব্যবহারটুকু তাঁর প্রাপ্য, সেটুকু যেন তিনি পান, তা নিশ্চিত করা। সু-কর প্রশাসন নিশ্চিত করার জন্য এ বিভাগে পোস্টিং দেওয়া বা চাকরি দেওয়ার আগে কমপক্ষে অতীত রেকর্ড ও পারিবারিক পরিচিতিটা নিশ্চিত করা বেশি প্রয়োজন। একজন দুর্নীতিমুক্ত/ ভালো কর্মকর্তা ৫০/১০০ জন কর্মচারী বা তার পুরো অফিসকে দুর্নীতিমুক্ত করে করদাতাবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য যথেষ্ট।    

করের পরিমাণ বৃদ্ধির তুলনায় করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধির কোনও বিকল্প নেই। এখন করদাতা বৃদ্ধির জন্য নাগরিকদের তুলনায় সরকারকে বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। করদাতা বৃদ্ধির জন্য নিম্নবর্ণিত সুপারিশগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:

১. আয়কর আইন সহজ সরল ও বোধগম্য ভাষায় প্রকাশ করা;

২. আয়করের হার কমানো;

৩. নাগরিকদের মাঝে করভীতি দূর করা;

৪. ব্যাপক হারে করদাতার সুবিধাগুলো প্রচার করা;

৫. করদাতাদের অভিন্ন কর আইডি কার্ড প্রদান করা;

৬. কার্ডপ্রাপ্ত করদাতাকে নাগরিক পরিষেবাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়ার অধিকার প্রদান করা;

৭. করদাতা কর অফিসে গেলে সম্মানের সহিত কথা বলা;

৮. করদাতাকে হয়রানি থেকে মুক্তি দেওয়া;

৯. কর আদায় কর্মকর্তাদের ব্যাপক হারে প্রশিক্ষণ  প্রদান করা এবং কৌশলী হওয়ার দক্ষতা অর্জন করা;

১০. এলাকাভিত্তিক জরিপ করে করের আওতায় আসে এমন করদাতাদের তালিকা তৈরি করা এবং কর ফাইল করার জন্য পরামর্শ প্রদান করা;

১১. আয়কর আইনজীবীদের (আইটিপি) সনদ প্রদান করার ক্ষেত্রে হিসাববিজ্ঞান এবং আইনে বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সনদ বাধ্যতামূলক করা;

১২. এলাকাভিত্তিক একজন আয়কর আইনজীবীকে করদাতা শনাক্ত করার দায়িত্ব প্রদান করা;

১৩. আয়কর আইনজীবীদের ১০ বছরের অধিক পেশায় নিয়োজিত থাকলে কর পরিদর্শকের পদমর্যাদা প্রদান করা এবং সম্মানীর ব্যবস্থা রাখা;

১৪. আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে যাতে কর নথি প্রদান করতে পারে তা কার্যকরভাবে চালু করা ও ব্যাপক হারে প্রচার করা;

১৫. এলাকাভিত্তিক করদাতাদের বার্ষিক পুরস্কারের ব্যবস্থা করা (ইউনিয়ন পর্যায় থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে);

১৬. আয়ের ক্ষেত্রভেদে আয়করের হার নির্ধারণ করা;

১৭. নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য ব্যবসার শুরু থেকে কমপক্ষে ৫ বছর সকল প্রকার করদায় থেকে মুক্ত রাখা;

১৮. করদাতার সন্তানদের সরকারি স্কুল-কলেজে বিনা বেতনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অধ্যয়নের সুযোগ দেওয়া;

১৯. নির্ধারিত জাতীয় সেবাগুলোতে আয়কর পরিশোধের প্রমাণাদি দাখিল বাধ্যতামূলক করা;

২০. নাগরিকদের দেওয়া করের অর্থের অপচয় বন্ধ করা এবং যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা;

২১. করদাতা ও কর আদায় কর্মকর্তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা;

২২. Good Governance and Modern Management ( ফ্রেম ওয়ার্ক) এর আওতায় 5P (Political Guidance, People, Partnership, Planning, Performance) বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া।

আমাদের সুপারিশের পাশাপাশি একটি বড় ব্যাপার হলো সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখানে সরকার ইচ্ছা করলে সু-কর প্রশাসন তৈরি করা কয়েকটা মাসের দরকার মাত্র। এখন সরকারকে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আসলে কর ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য তারা আন্তরিক কিনা?

পরিশেষে করদাতাদের উদ্দেশ্য বলবো, আপনি-আমরা যারা কর দিচ্ছি তারা শুধুই সরকারের আইনের কারণে দিচ্ছি তা কিন্তু নয়। আমরা কর দিচ্ছি দেশের নাগরিক হিসেবে দায়িত্ববোধ থেকে। দেশটা আমাদের সবার। একজন শ্রমিকের, একজন দিনমজুরের, একজন সাধারণ মানুষের, একজন শিক্ষিত মানুষের, একজন কর্মচারীর, একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার, একজন শিল্পপতির, একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর, একজন পেশাজীবীর, একজন বিচারকের, একজন রাজনীতিবিদের, একজন ছাত্রের, একজন নারীর, একজন পুরুষের। এক কথায় আমাদের সবার একটা দায়িত্ববোধ আছে, দায়িত্বশীল ভূমিকায় আমরা থাকতে চাই বলে আয়কর দিচ্ছি, দেবো। আবার একইভাবে আমাদের দেয় অর্থের যথাযথ ব্যবহার, জবাবদিহিতা আদায়ের জন্য এবং প্রাপ্য অধিকারগুলো আদায়ের জন্যও সজাগ থাকবো।

আমরা যারা আয়কর দিচ্ছি, তাদের একটা কথা বলার সাহস অন্তত আছে, আমি করদাতা! আমার করের টাকায় সরকার পরিচালিত হচ্ছে। সুতরাং এখানেই আমাদের গৌরবের এবং অহংকারের জায়গা। আয়কর আইন, আয়কর নথি করদাতার জন্য হয়রানির না হয়ে সম্মানের হোক  এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: আয়কর আইনজীবী

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ