X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

চাকরির আবেদন প্রক্রিয়া ডিজিটাল করা জরুরি

গোলাম মোরশেদ
২২ মার্চ ২০২২, ২০:৫৩আপডেট : ২২ মার্চ ২০২২, ২০:৫৩
গোলাম মোরশেদ বাংলাদেশে বর্তমানে চাকরি প্রত্যাশীদের সংখ্যা নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা। দেশে বর্তমানে প্রকৃত বেকার বা চাকরি প্রত্যাশীর সংখ্যা কত তা জানা কঠিন। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যদিও দুই বছর পর পর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক শ্রমশক্তি জরিপ করার কথা, কিন্তু ২০১৭ সালের পর বিবিএস এখনও কোনও প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। তাই দেশের বেকারত্বের সাম্প্রতিক উপাত্ত জানা অসম্ভব। সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে কর্মহীনের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৭ লাখ। আর প্রতিবছর গড়ে ১৮ লাখ নতুন শ্রমশক্তি শ্রমবাজারে যুক্ত হয়, যেখানে গড়ে ৬-৭ লাখ কর্মসংস্থান কিংবা উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে বিদেশে যায়। অবশিষ্ট ১১-১২ লাখ শ্রমশক্তির জন্য দেশে কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করতে হয়। কিন্তু প্রতিবছর আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান করা সম্ভব হয় তাতে প্রতিবছর কয়েক লাখ কর্মহীন থেকে যায়।

অপরদিকে করোনার কারণে গত দুই বছরে দেশে আশানুরূপ কর্মসংস্থান করা সম্ভব হয়নি। বিপরীতে করোনাকালীন শ্রমবাজারে অতিরিক্ত আরও প্রায় ২৬ লাখের বেশি নতুন বেকার যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ দেশে এখন অর্ধকোটির বেশি চাকরি প্রত্যাশী।

চাকরি প্রত্যাশীরা নিয়মিত বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে আবেদন করে। কিন্তু আবেদনের ক্ষেত্রেই চাকরিপ্রার্থীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সাম্প্রতিককালে এসেও বাংলাদেশে চাকরির আবেদনের কোনও একক পদ্ধতি দাঁড় করানো হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কোনও একক পদ্ধতি অনুসরণ না করে নিজেদের পছন্দমত পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত অনলাইন ও অফলাইন দুভাবেই আবেদনের চর্চা চালু রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কেউ কেউ তাদের নিজেদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদনের নির্দেশনা দেয়, কেউ কেউ ইমেইলে আবেদনপত্র ও জীবনবৃত্তান্ত পাঠাতে বলে, আবার কেউ কেউ বিভিন্ন চাকরির বিজ্ঞাপনের পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন করতে বলে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান এখনও স্বহস্তে লিখিত, সরাসরি যোগাযোগ, কিংবা ডাক/কুরিয়ারের মাধ্যমে আবেদনপত্র পাঠানোর নির্দেশনা দেয়। কিছু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের মতো করে অনলাইনে জীবনবৃত্তান্ত বা সিভি তৈরির ব্যবস্থা চালু করেছে। এক্ষেত্রে জীবনবৃত্তান্ত তৈরির ক্ষেত্রে একেক প্রতিষ্ঠান একেকরকম ফরমেট অনুসরণ করে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের কোনও নির্দিষ্ট ফরমেট অনুসরণ করার নির্দেশনা নেই। তখন প্রার্থীরা নিজেদের তৈরি ফরমেটে জীবনবৃত্তান্ত পাঠায়।

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদন প্রক্রিয়ার মাঝে যেমন রয়েছে ভিন্নতা, তেমনি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে আবার প্রতিষ্ঠানভিত্তিক রয়েছে আলাদা আলাদা নির্দেশনা। যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সরকারি ব্যাংকগুলোতে আবেদনের জন্য তাদের নিজেদের ওয়েব পোর্টালে এককালীন সিভি তৈরির ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলো আবার প্রতিষ্ঠান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করছে। একইভাবে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে চাকরির বিজ্ঞাপন ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে।

আবেদন প্রক্রিয়ায় কোনও একক পদ্ধতি অনুসরণ না করায় চাকরিপ্রার্থীরা বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির শিকার হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদা আলাদা ফরমেটে সিভি তৈরি এবং আবেদন প্রক্রিয়া চালু রাখায় চাকরি প্রার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন চাকরির আবেদনের জন্য প্রতিবার নতুন করে অনলাইনে ফরম পূরণ কিংবা জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করতে হয়। এমনকি একই ব্যক্তি যখন একই প্রতিষ্ঠানের একাধিক পদের বিপরীতে আবেদন করতে চায় তখনও তাকে প্রতি পদের বিপরীতে নতুন করে আবেদন ফরম পূরণ করতে হয়। একই ব্যক্তি যখন একাধিক আবেদন করছে তখন তাকে প্রতিটা আবেদনের বিপরীতে আলাদা আলাদা সময় খরচ করতে হচ্ছে। এটা এক ধরনের মানসিক ভোগান্তি, যেখানে একবার আবেদন করলেই ওই প্রার্থীর সব তথ্য প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে জমা হয়ে যায়। যেই তথ্য পূর্বের আবেদন প্রক্রিয়ায় একবার প্রদান করা হয়েছে সেখানে বারবার করার প্রয়োজনীয়তা নেই। বরং এটা আবেদনকারীর ভোগান্তি সৃষ্টি করে। আবার কখনও কখনও একেক চাকরির জন্য একেকরকম ফরমেট থাকে, সেটাও এক প্রকার ঝামেলা তৈরি করে বৈকি! বারবার আবেদন করার কারণে তথ্য প্রদানে ভুল-ভ্রান্তি ঘটার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।

তাই শুধু চাকরিতে আবেদনের উদ্দেশ্যেই একজন প্রার্থীকে একই কাজ বারবার করতে হয়। প্রতিবার আবেদনের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম, সময় ও অর্থ খরচ করতে হয়। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে এখনও সশরীরে আবেদনপত্র পাঠাতে হয় কিংবা ডাক অথবা কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠাতে হয়, সেখানে অতিরিক্ত সময়ের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে না পৌঁছানো বা হারানোর আশঙ্কা থেকে যায়। একজন চাকরি প্রার্থীকে প্রত্যেক বিজ্ঞাপনের বিপরীতে আবেদন করতে কমপক্ষে ২ ঘণ্টা সময় খরচ করতে হয়। অপরদিকে আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় সমাজে অনেক চাকরিপ্রার্থী রয়েছে, যাদের নিজেদের কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুবিধা নেই। তাই তাদের অন্য কোনও কম্পিউটার সেন্টারে গিয়ে টাকার বিনিময়ে আবেদন করতে হয়।
এক্ষেত্রে চাকরির আবেদন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীভূত করতে পারলে এবং জাতীয়ভাবে একই পদ্ধতি ও ফরমেট অনুসরণ করে জীবনবৃত্তান্ত বা সিভির পোর্টাল তৈরি করলে ভোগান্তি কমানো যাবে। অবশ্য এক্ষেত্রে কাজের ভিন্নতা ও প্রতিষ্ঠানের ধরন বিবেচনায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা ভাবনার দরকার আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তত সরকারি প্রতিষ্ঠানের আবেদন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীভূত করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একক সার্ভারে সব প্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করতে হবে। যেখানে পরবর্তী সময়ে সিভি আইডেন্টিফিকেশন নম্বর দিয়ে চাকরিপ্রার্থীরা যেকোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে পারবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদন প্রক্রিয়া অনুসরণীয় হতে পারে। প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের জন্য একই রকম ফরমেটে জীবনবৃত্তান্ত তৈরির সুযোগ থাকলে চাকরি প্রার্থীদের ভোগান্তি কমে যাবে। পাশাপাশি ভুল-ভ্রান্তি দূরীকরণ, সময় ও অর্থের অপচয় হ্রাস পাবে। এতে চাকরি প্রার্থীদের বেঁচে যাওয়া সময় ও অর্থ অন্য কার্যকরী কাজে ও দক্ষতা উন্নয়নে ব্যবহার করতে পারবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) যেভাবে সমরূপ পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও নিয়োগদান একসঙ্গে সম্পন্ন করে, সরকারের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো গুচ্ছ পদ্ধতিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।

যেমন, কম্পিউটার অপারেটর পদের জন্য প্রতিটা প্রতিষ্ঠান আলাদা করে নিয়োগ কার্যক্রম চালু না রেখে গুচ্ছ পদ্ধতিতে করলে সময়, অর্থ এবং পরিশ্রম সাশ্রয় হবে। অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে যদিও প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরন ও বিবিধ কারণে চাকরির আবেদন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীভূত করা জটিল প্রক্রিয়া তবু বিডিজবস কিংবা লিংকডইনের মতো জব পোর্টালের মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। আবেদন প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল করলে নিশ্চিতভাবেই চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক হবে। ডিজিটাল টুলগুলো ব্যবহার করলে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান খুব সহজেই যোগ্য প্রার্থীদের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে পারবে, যাতে চাকরি প্রার্থী এবং চাকরিদাতা উভয়েই লাভবান হবে। তাছাড়া সরকারের কাছেও চাকরি প্রত্যাশীদের উপাত্ত সংরক্ষিত থাকবে, যা কর্মসংস্থান সম্পর্কিত উন্নয়ন কর্মসূচি তৈরিতে সহায়তা করবে।

লেখক: প্রোগ্রাম অফিসার, প্রজ্ঞা বাংলাদেশ।
[email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাইটনের বিপক্ষে হাল্যান্ডকে পাচ্ছে না ম্যানসিটি
ব্রাইটনের বিপক্ষে হাল্যান্ডকে পাচ্ছে না ম্যানসিটি
ফেসবুক পোস্ট দিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় দুপক্ষ, বোমায় আহত ৪
ফেসবুক পোস্ট দিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় দুপক্ষ, বোমায় আহত ৪
‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৪০ শতাংশে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে’
‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৪০ শতাংশে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে’
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ