X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিচার চাইতে অনীহা কেন?

ফারাবী বিন জহির
২৫ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৩৭আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৫১

ফারাবী বিন জহির বাংলাদেশ একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন করে শত্রুমুক্ত হয় বাংলাদেশ। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে নবগঠিত রাষ্ট্রের সূচনা হয়। ত্রিশ লাখ শহীদের তাজা রক্ত এবং দুই লাখ নারীর দীর্ঘশ্বাসের বিনিময়ে জন্মলাভ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা; যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক-সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা হবে।

সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। এছাড়া ১৯৪৮ সালের “সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র”-এর ৭নং অনুচ্ছেদে কোনও ধরনের বৈষম্য ছাড়া আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সমান অধিকারের ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। একটি দেশে তখনই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যখন সে দেশের প্রতিটি নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান।

তবে এই কথাও দিবালোকের মতো সত্য যে সমাজে বসবাস করতে গিয়ে ব্যক্তিগত, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক জটিলতাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি হয়। মানুষ ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা আন্তর্জাতিক অনৈতিক প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে বিভিন্ন প্রকার অপরাধে প্রবৃত্ত হয়। এই ধরনের অপরাধের ফলে যে বা যারা ভিকটিম হন তাদের প্রয়োজন হয় আইনের আশ্রয় নেওয়ার। কিন্তু বিষয়টি তখনই উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে যখন একজন ভিকটিম আইনের আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করেন।

সাম্প্রতিক সময়ে এমন দুটি উদাহরণ আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত হয়েছে। একটি হচ্ছে ঢাকা কলেজের ছাত্র ও নিউ মার্কেটের দোকানিদের মাঝে সংঘর্ষকালে নিহত ডেলিভারি ম্যান নাহিদের (যিনি কোনও পক্ষেই ছিলেন না) পরিবার কোনও মামলা করতে চায় না!

অপরটি হচ্ছে শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা টিপু হত্যাকাণ্ডের সময় নিহত শিক্ষার্থী প্রীতির (যিনি কোনও পক্ষেই ছিলেন না) বাবা কোনও মামলা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন!

কী ভয়ংকর বার্তা আমাদের সমাজের জন্য! ভাবা যায়? একজন জন্মদাতা পিতা তার সন্তানের হত্যার বিচার চাচ্ছেন না? ন্যায়বিচার প্রাপ্তির বিষয়ে কতটা হতাশা জন্মালে পিতা তার সন্তানের হত্যার বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে ভাবলেশহীন। এ ধরনের ঘটনা সমাজকে কী ভয়াবহ বার্তা দিচ্ছে তা ভেবে দেখার মতো সময় আমাদের কর্তাব্যক্তিদের আছে কি? ইতিহাসে এতদিন উদাহরণ ছিল পিতৃস্নেহের কাছে মরণের পরাজয় হবার। আজ আমাদের সমাজে উদাহরণ তৈরি হচ্ছে যে পিতৃস্নেহ বেদনার দৃষ্টি নিয়ে সন্তানের লাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, তবু তিনি বিচার চাইছেন না।

শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিংবা জিডিপির সংখ্যাতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে একটি সমাজকে উন্নত সমাজ বলে দাবি সমীচীন নয়। বরং একটি সমাজকে তখনই উন্নত বলা যাবে যখন সমাজে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে সমাজে ন্যায়বিচারের পথ কতটুকু রুদ্ধ হলে বাবারা তাদের সন্তানদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে ন্যূনতম একটা মামলা করতেও অনীহা দেখাচ্ছেন। সমাজের এই ধরনের উদাহরণই বলে দেয় সমাজ কোন পথে যাচ্ছে।

যুক্তির খাতিরে আসতেই পারে যে তাদের হয়তো আর্থিক সঙ্গতি ছিল না মামলার খরচ বহনের। কিন্তু বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি করে লিগ্যাল এইড অফিস রয়েছে। এসব অফিসে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা চাইতে পারে। এছাড়া প্রত্যেক উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটি রয়েছে। প্রত্যেক লিগ্যাল এইড অফিসের হটলাইন রয়েছে যেখানে সরাসরি ফোন করে আইনগত সহায়তা সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে জাতীয় পর্যায়ে সম্পূর্ণ টোল ফ্রি ১৬৪৩০ নম্বরের মাধ্যমে হেল্পলাইন সার্ভিস কার্যক্রম বাস্তবায়ন চালু করেছে। কাজেই আর্থিক সঙ্গতির বিষয়টি ধোপে টেকে না।

মোগল সম্রাট শাহজাহানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল দুনিয়ার সবচেয়ে ভারী বস্তু কী? তার উত্তর ছিল– পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। পৃথিবীর এই ভারী বস্তুটিও একজন পিতা বুকে পাহাড় সমান কষ্ট নিয়ে বহন করেছেন, তবু তিনি তার বিচার চাননি। এই বিচার না চাওয়াটা শুধু তার বেদনার কিংবা অভিমানের ইঙ্গিত নয়। এই বিচার না চাওয়া তার রাষ্ট্রের প্রতি এক ধরনের তীব্র হতাশা এবং ক্ষোভ। একজন বিচারপ্রার্থী যখন বিশ্বাস করা শুরু করেন যে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন না তখন বোঝা যায় সমাজে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ কতটা দুরূহ। এই ধরনের বিশ্বাস সমাজে তখনই বসতি গাড়ে যখন একটি সমাজে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ বন্ধুর হয় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি উৎসাহিত হয়।

মনে রাখতে হবে একদিনে সমাজে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির বিষয়ে হতাশা তৈরি হয় না। মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির বিষয়ে হতাশা তৈরির দায় রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। দিনের পর দিনে রাষ্ট্রের অবিবেচকসুলভ কর্মকাণ্ড মানুষকে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করে। মানুষের এই ধরনের হতাশা থেকে এক ধরনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এই ক্ষোভ থেকেই একসময় মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়াসহ অনেক রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।     

তাই সামাজিক নিরাপত্তা ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সময় এসেছে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করার বিষয়ে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করার। তা না হলে এই হতাশা কিংবা অভিমান যাই বলি না কেন, আমরা যদি না ভাঙানোর চেষ্টা করি তবে সময়ের পরিক্রমায় এই অভিমানীদের মিছিল বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হবে। সেই মিছিলের ভয়াবহ স্রোত আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে এক অথৈ সাগরে নিমজ্জিত করবে।

লেখক: কলামিস্ট ও অ্যাকটিভিস্ট

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ