X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পর্কের নাম পরকীয়া

রেজানুর রহমান
২৪ মে ২০২২, ১৭:১৩আপডেট : ২৪ মে ২০২২, ১৭:১৩

মানুষ নতুন যা দেখে তাই শেখার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে টেলিভিশন বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় টেলিভিশন মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এখনও সেই প্রভাব যে নেই তা বলা যাবে না। তবে টেলিভিশনের চেয়ে ব্যাপক প্রভাব রাখছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। টেলিভিশন দেখতে হলে সাধারণত একটি ঘরে গিয়ে বসতে হয়। সেজন্য মানসিক একটা প্রস্তুতিরও প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু হাতে যদি থাকে একটি স্মার্ট ফোন তাহলে শুয়ে, বসে, পথে যেতে যেতে যেখানে খুশি পৃথিবীর তাবৎ ইনফরমেশন সংগ্রহ করা সম্ভব।

কী দেখতে চান আপনি? নাটক নাকি সিনেমা? খেলাধুলা, টকশো? ব্যবসা-বাণিজ্যের তাজা খবর, ভ্রমণ, সাহিত্য, জানা-অজানা সব কিছুই– শুধু চাইতে হবে। ব্যস, আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই দৈত্য এসে হাজির হবে এবং নিমিষেই কাঙ্ক্ষিত সব কিছু হাজির করে দেবে। ফলে শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দিনে দিনে আতংকজনক ভাবে আলগা হতে শুরু করেছে। মোবাইল ফোন খুবই জরুরি অনুষঙ্গ। মোবাইল ফোন ছাড়া জীবন ধারণের কথা ভাবাই যায় না। সেই মোবাইল ফোনও দিনে দিনে আতংকের বিষয় হয়ে উঠছে। এখানে মোবাইল ফোনের দায় যতটা না তার চেয়ে বড় দায় ব্যক্তির মন-মানসিকতার ওপর। যন্ত্রটি কীভাবে ব্যবহার করছি সেটাই হলো আসল কথা।

একটা সময় ভিসিআর প্রযুক্তি যখন এলো তখন ভিসিআর-এ লুকিয়ে লুকিয়ে পর্নো সিনেমা দেখার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এখনও মনে পড়ে সেই বিব্রতকর দৃশ্য। পুরনো ঢাকা সহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ক্লাব ঘরে ভিসিআর-এর মাধ্যমে পর্নো সিনেমার গোপন প্রদর্শনী শুরু হয়েছিল। তখন ভিসিআর-এর বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছিলেন অনেকে। অথচ ভিসিআর তো একটি বাহন মাত্র। এর মাধ্যমে শুধু যে পর্নো ছবি দেখা যায় তাতো নয়। ভালো ছবি অর্থাৎ ভালো সিনেমাও দেখা যায়। এখানে জরুরি বিষয় হলো ব্যক্তির মানসিকতা। একইভাবে মোবাইল ফোনের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ বলেন, মোবাইল ফোন মানুষকে অসামাজিক ও মিথ্যুক বানাচ্ছে। কাউকে হয়তো ফোন করা হলো। সভা অথবা সেমিনারে, কিংবা অফিসের মিটিংয়ে তার পৌঁছার কথা সকাল ১০টায়। অথচ নির্ধারিত সময়ে সে এসে পৌঁছায়নি। ফোন করা হলো। বাস্তবে ব্যক্তিটি হয়তো তখনও তার বাসায় রয়েছে। কিন্তু অবলীলায় মিথ্যা বলতে শুরু করলেন। বললেন, ভাই আমি তো রাস্তায়। ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়েছি। এই যে ব্যক্তিটি মিথ্যা কথা বললেন, এখানে মোবাইল ফোনের অপরাধটা কোথায়? অপরাধ যদি করে থাকে তাহলে মানুষ করেছে। প্রযুক্তির কোনও দোষ নেই। অথচ আমরা অনেকে মোবাইল ফোনকেই দোষারোপ করি। এটা হলো দায় এড়ানোর চেষ্টা।

একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, কী গ্রাম, কী শহর সব জায়গাতেই মানুষের মন মানসিকতা আচার-আচরণ পাল্টে যাচ্ছে। আগের সেই সামাজিক বন্ধন যেন নেই। ঈর্ষা, প্রতিশোধ পরায়নতা, পরকীয়া, খুন রাহাজানি এবং কাউকে বিপদগ্রস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনের চেষ্টা যেন অনেকের মাঝেই বেশ স্পষ্ট। কাউকে বিপদে ফেলতে পারলেই বিপুল আনন্দ।

আমার এক বন্ধু একটি ঘটনার কথা বললেন। গ্রামের এক গৃহবধু ঢাকা শহরে এসেছিল চাকরির আশায়। একটি গার্মেন্টেসে চাকরি পেয়ে যায়। বছর খানেকের মধ্যেই তার মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। গ্রামে যাকে সে বিয়ে করেছিল তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে। শহরের এক তরুণের সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। মেয়েটির দ্বিতীয় স্বামীও গার্মেন্টেসে চাকরি করে। এক সাথে কাজ করতে করতেই দু’জনের মধ্যে সখ্যতার সৃষ্টি হয়। মেয়েটির কাছে তার গ্রামের স্বামী গুরুত্বহীন হয়ে ওঠে। অথচ প্রেম করে বিয়ে করেছিল তারা। শহরে এসে সেই প্রেম ভুলে দ্বিতীয় বিয়ে করে। এটাও প্রেমের বিয়ে। ৬ মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয় বিয়েও ভেঙে যায়। শহরের এক ধনাঢ্য বাড়িওয়ালার বখাটে ছেলের প্রেমের জালে ফেসে যায় সে। তৃতীয় বিয়ে করে। এই বিয়ে টিকে মাত্র দেড় মাস।

মেয়েটি ৪র্থ বিয়ের চেষ্টা করছে। এর মধ্যে সে বেশ অর্থ বিত্তের মালিক হয়ে উঠেছে। গ্রামে বাবা-মায়ের সাথে তার তেমন যোগাযোগ নেই। শহর তাকে বদলে দিয়েছে।

এই যে মেয়েটি বদলে গেলো। বলা হচ্ছে শহর তাকে বদলে দিয়েছে, এখানে শহরের ভূমিকা কতখানি? বদলে যাচ্ছে মানুষ অথচ দোষ হচ্ছে শহরের। শহর কি মানুষকে বদলায়? নাকি মানুষ শহরকে বদলায়?

লেখার শুরুতে টেলিভিশনের কথা বলছিলাম অনেকেই বলছেন টেলিভিশন বদলে দিয়েছে মানুষকে। টেলিভিশন নাটক এক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে বলে অনেকের ধারণা। এই লেখায় গ্রামের যে মেয়েটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় টেলিভিশন নাটক। পাশের দেশের বাংলা ভাষার কয়েকটি টেলিভিশন নাটকের সে একনিষ্ঠ দর্শক। দেশের টেলিভিশনে বাংলায় ডাবিং করা বিভিন্ন বিদেশি সিরিয়ালেরও সে গুণ মুগ্ধ দর্শক। তার আত্মীয় স্বজনের ধারণা শহরে  সে বিভিন্ন টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটক দেখে দেখে মেয়েটি অবাধ স্বাধীনতার ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে অর্থ আয়ের চাতুর্য্যের পথও খুঁজে পায়। শুধু ওই মেয়েটি নয় আরও অনেক নারী, পুরুষ টেলিভিশনের বিদেশি সিরিয়াল দেখে দেখে প্রতিনিয়ত জীবনকে জটিল করে তুলছে। এটা গ্রাম এবং শহরে একই ঘটনা ঘটছে।

পাশের দেশের বাংলা ভাষার বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন টেলিভিশনেও বাংলায় ডাবিং করা যে সব টিভি ধারাবাহিক প্রচার হচ্ছে সেই সব নাটকের কাহিনির সাথে আমাদের সামাজিক বাস্তবতার কোনোই মিল নেই।

প্রায় প্রতিটি টিভি সিরিয়ালে পারিবারিক ভাঙ্গন, পরকীয়া, শঠতা, নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি সৎ মানুষের বিপদগ্রস্থ হবার কাহিনি গুরুত্ব পায় বেশি। একই পরিবারে বড় ভাইয়ের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর সাথে ছোট ভাই প্রেম করেছেন, অথবা ছোট ভাইয়ের প্রেমিকাকে বিয়ে করেছেন বড় ভাই, ওই পরিবারে একজন পুরুষ অথবা মহিলাকে দেখা যাবে ভিলেনের ভূমিকায়। যার কাজই হলো পরিবারের ভালো মানুষগুলোকে প্রতিনিয়ত অসহায় করে তোলা, বিপদগ্রস্থ করা। অধিকাংশ সিরিয়ালে দেখা যায় বিয়ে করার পর কোনও কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বনিবনা হচ্ছে না। ব্যস বিচ্ছেদ হলো তাদের। অথচ পরিবার থেকে যাচ্ছে না। বরং পরিবারে থেকেই অন্যকে ভালোবাসতে শুরু করলো।

বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে একটি ধারাবাহিক নাটকের কাহিনি তুলে ধরছি। দুই সন্তান সহ স্ত্রী হারিয়ে গেছে। তাদেরকে খুঁজে না পেয়ে স্বামী বিয়ে করেছেন এক ধর্নাঢ্য পরিবারের মেয়েকে। ওই পরিবারের কর্তা তার মেয়ের সমান বয়সী এক নারীকে ভালোবাসে। ওই নারীর সাথে তার মেয়ের জামাইয়ের একদা প্রেম ছিল। ভাবুন একবার মেয়ের জামাই যাকে ভালোবেসেছিল সেই নারীকে রক্ষিতা বানিয়েছে শ্বশুর। প্রেম, পরকীয়া, ঈর্ষা, সংঘাত আর ভালো মানুষকে বিপদগ্রস্থ করে তোলার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের বাংলায় ডাবিং করা বিভিন্ন বিদেশি টিভি সিরিয়ালে। দেশের সাধারণ টিভি দর্শক এই সিরিয়ালগুলোর প্রতি বেশ আসক্ত হয়ে উঠেছে। ফলে দেশীয় অনেক নির্মাতাও বিদেশি টিভি সিরিয়ালের অনুকরণে নাটক, টেলিফিল্ম ও ধারাবাহিক নির্মাণের পথে হাঁটতে শুরু করেছেন।

একথা সত্য, আমাদের নাটক সিনেমার ক্ষেত্রে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকার দিন শেষ। নাটক সিনেমার কনটেন্ট বদলাতে হবে। কিন্তু বদলাবেন কতখানি? এক চিমটি ভালোবাসা, এক বালতি প্রেমের সঙ্গে এক নদী সমান পরকীয়া, ঈর্ষা আর প্রতিশোধ পরায়নতাকে যুক্ত করে জমজমাট কাহিনির নাটক বানালেন। হৈ হৈ রব পড়ে গেলো। এটাকে কি আপনি সাফল্য বলবেন?

সময় এসেছে নিজেকে, নিজেদেরকে বদলানোর। কিন্তু আপনি কতটা বদলাবেন সেটাই আগে ঠিক করুন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি: প্রধানমন্ত্রী
খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি: প্রধানমন্ত্রী
মননের প্রথম আইএম নর্ম, হাতছানি জিএম নর্মের
মননের প্রথম আইএম নর্ম, হাতছানি জিএম নর্মের
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার হুমকি আব্বাসের
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার হুমকি আব্বাসের
টি-টোয়েন্টির পাওয়ার প্লেতে ১২৫ রান করে হায়দরাবাদের বিশ্ব রেকর্ড!
টি-টোয়েন্টির পাওয়ার প্লেতে ১২৫ রান করে হায়দরাবাদের বিশ্ব রেকর্ড!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ