X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থপাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা কী বার্তা দিলো?

আমীন আল রশীদ
০২ জুন ২০২২, ১৮:৫৩আপডেট : ০২ জুন ২০২২, ১৮:৫৩
আপনার বাড়িতে চুরি হয়েছে। চোর কে, তা জানেন না। আপনি মামলা করলেন। কিন্তু পুলিশ চোর ধরতে পারছে না অথবা ধরছে না। তখন আপনি ঘোষণা দিলেন, চোর যদি চুরি করা মালামাল ফেরত দিয়ে যায়, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আপনার কি ধারণা এই ঘোষণার পরে চোর আপনার জিনিসপত্র ফেরত দিয়ে যাবে? হয়তো আপনি তাকে ক্ষমাই করলেন। কিন্তু এটি ফেরত দিয়ে তার লাভ কী? তাছাড়া চোর জিনিস ফেরত দেওয়ার পরে যদি লোকে তার পরিচয় জেনে যায়, তাহলে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ঝুঁকি সে কেন নেবে? অনেকটা সে রকম একটি ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। যিনি এর আগে জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, কারা দেশ থেকে টাকা পাচার করে তা তিনি জানেন না (বাংলা ট্রিবিউন, ২৭ নভেম্বর)।

সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দেখা যাক, পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমার বিষয়ে তিনি কী বলেছেন?

গত ২৬ মে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, আগামী বাজেটে ট্যাক্স দিয়ে পাচার হওয়া টাকা বৈধ পথে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হবে। ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সেই দেশেও এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ার ফলে অনেক টাকা দেশে ফেরত এসেছে। অর্থমন্ত্রী জানান, বিদেশ থেকে ৫ হাজার ডলারের বেশি পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনও ডকুমেন্টস লাগবে না। আর সুনির্দিষ্ট কর দিয়ে পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আগামী বাজেটে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে। বলেন, অর্থ পাচারকারীরা এ সুযোগ গ্রহণ করে বিদেশে গচ্ছিত টাকা দেশে ফিরিয়ে আনবেন।

প্রশ্ন হলো, এ পর্যন্ত কত টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে? কারা টাকা পাচার করেন? কীভাবে টাকা পাচার হয়? টাকা পাচার হলে দেশের কী ক্ষতি এবং এখন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটির আইনি ও নৈতিক ভিত্তি কী? এরকম দায়মুক্তির মধ্য দিয়ে দুর্নীতি ও টাকা পাচার আরও উৎসাহিত হবে হবে কিনা—যে প্রশ্নটি প্রতি বছরই বাজেটে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে বা নির্দিষ্ট কিছু খাতে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে সাদা বা বৈধ করার সুযোগ দেওয়ার সময়ও সামনে আসে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পরের বছরই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যারা বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন জাতির পিতা ব্ঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে যাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও প্রমাণ আছে, বঙ্গবন্ধু তাদের ক্ষমা করার ঘোষণা দেননি। দেননি বলেই দেশ স্বাধীন হওয়ার ৩৮ বছর পরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কার্যক্রম শুরু হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এ পর্যন্ত সাধারণ ক্ষমার আওতায় অনেক বড় বড় অপরাধীও পার পেয়ে গেছে। অনেককে মানবিক বিবেচনায়ও সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। অনেক অপরাধীকে কারাগারে ভালো আচরণের কারণে বিশেষ দিবসে সাধারণ ক্ষমার আওতায় এনে কারামুক্ত করে দেওয়ারও রেওয়াজ আছে। কিন্তু পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনলে তাদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনার ঘোষণা দেশে এই প্রথম।

কারা টাকা পাচার করেন এবং কেন করেন, সেটি বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ না হলেও চলে। কেউ বৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা পাচার করেন না। কারণ, বৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ মানে সেই আয়ের উৎসটি দৃশ্যমান। যেমন আপনি চাকরি করেন। মাস শেষে এক লাখ টাকা বেতন পান। অফিস সেই বেতনের একটি অংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) হিসেবে কেটে রাখে এবং বছর শেষে আপনি টাক্স রিটার্ন জমা দেন। সুতরাং এটা আপনার বৈধ টাকা। এই টাকা পাচার করার কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ, এই টাকার একটি অংশ ব্যাংকে রাখলে ব্যাংক এর উৎস জানতে চাইলেও মন্দ কিছু পাবে না। কিন্তু যে টাকা আপনি অবৈধ উপায়ে অর্জন করলেন, ধরা যাক আপনি ঘুষ নিলেন কিংবা সরকারি কোনও প্রকল্প থেকে মোটা অংকের টাকা সরিয়ে ফেললেন, মানে লুট করলেন, অথবা আপনি কোনও ব্যাংকের শীর্ষ কর্তা হিসেবে অন্যদের যোগসাজশে জনগণের অর্থ নানা কায়দা-কানুন করে নিজের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নিলেন ইত্যাদি। অথবা আপনি ব্যবসায়ী কিংবা অন্য পেশাজীবী—যিনি তার আয় নিয়ে প্রশ্ন করলে  সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না, কিংবা এমন পরিমাণ অর্থ আপনি সংগ্রহ করলেন যেটি মূলত অবৈধ পথে অর্জিত—সেই টাকা আপনি কী করবেন? সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেখা গিয়েছিল একজন বন সংরক্ষক, ওসমান গনি যার নাম, তিনি তার ঘুষ ও অন্যান্য অবৈধ পথে অর্জিত টাকা বালিশের ভেতরে রেখেছিলেন। সবাই তো আর ওসমান গনির মতো টাকা বালিশের ভেতরে রাখেন না। আবার মোটা অংকের টাকা ব্যাংকে রাখতে গেলে সেটার যদি উৎস দেখানো না যায়, সেটি বিপদ। এরকম পরিস্থিতিতেই টাকা বিদেশে পাচার করা হয় এবং টাকা পাচারেরও নানারকম তরিকা আছে। তার মানে যারা টাকা পাচার করেন, তাদের সবাই অসৎ লোক। সুতরাং, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরেও যে সেই অসৎ লোকের নির্দিষ্ট অংকের ট্যাক্স দিয়ে টাকা দেশে ফিরিয়ে আনবেন—এমনটি ভাবার কী কারণ আছে?

তাছাড়া পাচারকারীরা কি এতই বোকা যে তারা পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে এনে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে দেবেন? কারণ, সরকার টাকা পাচারকৃতদের পরিচয় গোপন রাখলেও সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করে তাদের পরিচয় ঠিকই বের করে ফেলবেন। এটি পাচারকারীরাও জানেন। সুতরাং ইন্দোনেশিয়ার মডেল অনুসরণ করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে বিরাট অঙ্কের টাকা দেশে ফিরে আসবে, তার সম্ভাবনা কম।

তাছাড়া যারা টাকা পাচার করেন, তারা কেন করের সুবিধা নিতে অর্থ ফেরত আনবেন? রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং আমলারাই তো টাকা পাচার করেন বলে ধারণা করা হয়—যাদের অনেকেরই কানাডার বেগমপাড়া-খ্যাত এলাকায় বাড়ি রয়েছে; মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম রয়েছে; যারা ওইসব দেশে রাজার হালে বসবাস করছেন অথবা নিজে দেশে থাকলেও স্ত্রী-সন্তানরা বিদেশে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন, তাদের কী ঠেকা পড়েছে যে করের সুবিধা নিয়ে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত নিয়ে আসবেন?

ধরা যাক কোনও রাজনীতিবিদ বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনবেন। এটি কি গোপন থাকবে? সেক্ষেত্রে তার ক্যারিয়ারের কী হবে? তিনি কি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন? আমলারা কি টাকা ফেরত আনবেন? সরকারের নথিতে তারা কেন নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করবেন? ব্যবসায়ীরাই বা পাচার করা অর্থ কেন ফেরত আনবেন? তারা নিজেদের প্রয়োজনেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টাকা ও বাড়ি গাড়ি কিনে রাখেন। কারণ পাচারকৃত অর্থ দেশে এনে কেন জটিলতায় পড়তে চাইবেন?

তার চেয়ে বড় কথা, পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা কি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য? এটি কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীলতা নীতির বিপরীত নয়? এটি কি অর্থপাচার রোধে প্রণীত মানি লন্ডারিং আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক নয়? অর্থপাচারকে এভাবে ক্ষমা ঘোষণার ফলে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে চলমান মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে? অর্থপাচারের মামলায় অভিযুক্তরাও কি তখন এই সুযোগ গ্রহণ করতে চাইবেন না? দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সম্প্রতি এক বিবৃতিতে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনলে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণাকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে উল্লেখ করেছে। সংস্থাটি বলছে, নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় পাচারকৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার যে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, বাস্তবে তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গর্হিত এই অপরাধের জন্য শাস্তির বদলে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা করার এসব উদ্যোগকে অর্থপাচারকারী তথা দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার শামিল।

বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য না থাকলেও ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণায় এ বিষয়ে একটি ধারণা দিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। তার তথ্যমতে, বিগত ৪৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

তবে কারা টাকা পাচার করেন, অর্থমন্ত্রী তা জানেন না বলে দাবি করলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় অর্থপাচারকারীদের একটি তালিকা তিনি পেয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই আমলা (বিবিসি বাংলা, ১৯ নভেম্বর ২০২০)। গণমাধ্যমের খবরও বলছে, অর্থপাচারকারীদের একাধিক তালিকা সরকারের হাতেই আছে। অর্থমন্ত্রীর নিজের মন্ত্রণালয়ের অধীন একাধিক সংস্থাসহ সরকারের কয়েকটি সংস্থা ও মন্ত্রণালয় এসব তালিকা তৈরি ও সংগ্রহ করেছে (নিউজ বাংলা, ৮ জুন ২০২১)। অর্থপাচারকারীদের বিষয়ে তদন্ত করার দায়িত্বে সরকারের যেসব সংস্থা আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টিগ্রেশন সেল (সিআইসি) এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

প্রশ্ন হলো, এসব সংস্থার হাতে যেহেতু তালিকা আছে এবং স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, তাহলে টাকা ফেরত আনা যাচ্ছে না কেন বা পাচারকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা যাচ্ছে না কেন? আলোচিত টাকা পাচারকারী পি কে হালদারও গ্রেফতার হয়েছেন ভারতে। বাংলাদেশ সরকার তাকে ধরতে পারলো না কেন? সমস্যা কি আইনে নাকি রাজনৈতিক সদিচ্ছায়? আবার অর্থমন্ত্রীর কথা সত্য ধরলে এ প্রশ্নও তুলতে হয় যে, পাচারকারীদের চিহ্নিত করতে না পারা কি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা নয়? বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির কূলকিনারা কি এখনও করা গেলো?
চোরকে ক্ষমা করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে চুরির মাল ফেরত পাওয়ার আশা করা কোনও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বর্জনকারীদের ‘অনুসারীরাও’ ভোটে, সহিংসতার শঙ্কা দেখছে না ইসি
বর্জনকারীদের ‘অনুসারীরাও’ ভোটে, সহিংসতার শঙ্কা দেখছে না ইসি
দুর্ঘটনার পর থেকেই পড়ে আছে ৬০ লাখ টাকার অ্যাম্বুলেন্সটি, ভয় পুলিশের
দুর্ঘটনার পর থেকেই পড়ে আছে ৬০ লাখ টাকার অ্যাম্বুলেন্সটি, ভয় পুলিশের
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ